যে লাইব্রেরিতে একই সঙ্গে দুই দেশে বসে পড়াশোনা করা যায়!
বাইরে থেকে দেখতে হাস্কেল ফ্রি লাইব্রেরি অ্যান্ড অপেরা হাউজ বিশ শতকের আর দশটা ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের ভবনের মতোই, কাচের বড় বড় জানালা, বিশাল সম্মুখভাগ এবং স্লেটের তৈরি ছাদ। কিন্তু ভেতরে পা রাখলে আপনি এক বিস্ময়ের সম্মুখীন হবেন! বুঝতে খুব কষ্ট হবে না যে হাস্কেল ফ্রি লাইব্রেরি আদতে অন্যসব সাধারণ লাইব্রেরির মতো নয়। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তের মাঝামাঝি অবস্থিত। লাইব্রেরির বিভিন্ন অংশ পড়েছে দুটি আলাদা সীমানার মধ্যে। ফলে পাঠক ও থিয়েটারের দর্শকেরা ভেতরে প্রবেশ করবেন, একজন যদি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে তাহলে অপরজন থাকবেন কানাডায়!
হাস্কেল ফ্রি লাইব্রেরিতে মূলত ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় লেখা বইয়ের সংখ্যাই বেশি, সেই সাথে স্প্যানিশ ভাষার বইও রয়েছে- এবং সেটা পড়েছে কানাডার অংশে। লাইব্রেরির সাথেই সংযুক্ত অপেরা হাউজটিতে রয়েছে ৫০০ আসন এবং সেগুলো পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের ভেতরে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এই একই অপেরা হাউজের মঞ্চ- ১৯০৪ সালে যেখানে প্রথম পারফরমেন্স করা হয়, গম্বুজযুক্ত সিলিং ও বাহারি ঝাড়বাতিসহ সবকিছু পড়েছে কানাডার সীমান্তের মধ্যে!
শুধু তাই নয়, এই লাইব্রেরি ঠিকানাও দুটি- একটি কানাডিয়ান ও অন্যটি আমেরিকান। তবে লাইব্রেরির সামনের একমাত্র প্রবেশদ্বার অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায়। লাইব্রেরির প্রধান এনট্রান্স হল এবং শিশুদের পড়ার ঘরজুড়ে কালো টেপ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে যে কোন অংশ কোন সীমানায় পড়েছে।
লাইব্রেরিটির এই অভিনব বৈশিষ্ট্যের কারণে দুই দেশের সাধারণ মানুষ ও পর্যটকরাও এখানে পরিদর্শনে আসেন। দুই আন্তর্জাতিক সীমান্তের মধ্যবর্তী একটি স্থানে কাজ করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লাইব্রেরির বর্তমান পরিচালক মেলানি অবে বলেন, "আমি আসলে এটা অনুধাবনই করি না।"
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সীমান্তে যেখানে কড়া সামরিক পাহারা বসানো হয় এবং দুটি দেশের বিভাজনের প্রতীক হয়ে ওঠে সীমান্ত, সেখানে হাস্কেল ফ্রি লাইব্রেরি এমন একটি কালের সাক্ষী যেখানে একসময় কানাডার কুইবেক ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট প্রদেশের গ্রামীণ মানুষেরা অবাধে চলাচল করতো।
অপেরা হাউজ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর, ১৯০৫ সালে এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠান কথা প্রথম চিন্তা করেন স্থানীয় এক বিত্তশালী নারী মার্থা হাস্কেল। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সংহতির প্রতীক হিসেবে তিনি ইচ্ছা করেই দুটি সীমান্তের মাঝখানে এই লাইব্রেরি নির্মাণ করেন।
স্কুল বা চার্চে যাওয়া কিংবা বিয়ে করার জন্যেও দশকের পর দশক ধরে কানাডিয়ান ও আমেরিকান নাগরিকরা এই সীমান্ত পেরিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন। 'মার্থা হাস্কেলের আসল উদ্দেশ্যই ছিল সীমান্তকে 'ফাঁকি' দেওয়া', এনট্রান্স হলে থাকা বড় একটি পোট্রেটের দিকে আঙুল তুলে বলেন লাইব্রেরির তরুণ ট্যুর গাইড।
বহু বছর ধরেই এই দুই সীমান্তের সত্যিকার বিভাজন নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহল রয়েছে। কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের শেষ কোথায় কিংবা তার বিপরীত- এ নিয়ে মানুষের মনে হাজারো প্রশ্ন।
"ছোটবেলায় আমার এবং গ্রামের অন্য বাচ্চাদের কাছে সাইডওয়াকের ধারে বসানো আয়রন পোস্ট, যেখানে চিহ্নিত করা আছে যে মেইন স্ট্রিট কানাডার সীমান্ত কোন জায়গা অবধি চলে গেছে, সেটা ছিল এক বিরাট কৌতূহলের বস্তু", ১৯৪৯ সালে ভারমন্ট কোয়ার্টারলি ম্যাগাজিনে একথা লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্ট শহরের ডার্বি লেনের বাসিন্দা অস্টিন টি ফস্টার।
কানাডার কুইবেক প্রদেশের ছোট্ট শহর স্ট্যানস্টেডেরও রয়েছে আমেরিকার সঙ্গে যোগসূত্র। শহরের পৌরসভার ওয়েবসাইটে লেখা, ১৭৯০ সালের দিকে নিউ ইংল্যান্ডের পথিকৃতরা এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
বিবে প্লেইন, স্ট্যানস্টেড প্লেইন এবং রক আইল্যান্ডের ঐতিহাসিক গ্রামগুলো ঘিরে, স্ট্যানস্টেড একসময় 'পাচারকারী এবং অবৈধ ব্যবসায়ীদের স্বর্গ' ছিল। কিন্তু ১৮২১ সালে একটি শুল্ক স্টেশন (যা ছিল পূর্বাঞ্চলীয় টাউনশিপ অঞ্চলে প্রথম) প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
কিন্তু আজকের হাস্কেল লাইব্রেরি দুটি দেশের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত হওয়ার পেছনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। লাইব্রেরির কোনো ক্ষতি হলে কোন দেশের ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এর ব্যয়ভার বহন করবে তা নিয়ে কয়েক দশক আগে তুমুল ঝগড়ার পর লাইব্রেরির মেঝেতে কালো টেপ লাগিয়ে দুই সীমান্তের সঠিন অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, জানান ট্যুর গাইড।
সীমান্তে এই লাইব্রেরির অবস্থানের ফলে কর্মীরা রাজনৈতিক ছোঁয়া বাচিয়ে চলতে চাইলেও সাম্প্রতিক সবছরগুলোতে তা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে। ভারমন্টের দিকে মুখ করে কানাডা সরকার একটি সাইনবোর্ড বসিয়েছে যাতে লেখা 'থামুন'; এর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে যে চাইলেই যে কেউ এখন আর কানাডায় আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়ই এই সতর্কবার্তা।
ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান, রোমানিয়ান ও হাইতিয়ান ক্রেওল ভাষায় অনুবাদ করা আরেকটি সতর্কবার্তায় সাধারণ মানুষকে সীমান্তবর্তী স্থানে ইতঃস্তত ঘুরাফেরা করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এছাড়া, লাইব্রেরির কৌশলগত অবস্থান অপ্রত্যাশিতভাবে এটিকে একটি অপরাধমূলক পরিকল্পনার অংশও করে ফেলেছিল। ২০১৮ সালে ভার্মন্ট থেকে কুইবেকে ১০০ টিরও বেশি হ্যান্ডগান পাচার করার জন্য জনৈক কানাডিয়ান নাগরিককে ৫১ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে কিছু অস্ত্র হাস্কেল লাইব্রেরির বাথরুমের একটি ঝুড়িতে ছোট ব্যাকপ্যাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল মার্কিন কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে সেখান থেকে এগুলো উদ্ধার করে কানাডায় নিয়ে আসা হয়েছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা স্থল সীমান্তে বেশকিছু কড়া নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও ফরমাল ক্রসিং - যেমন, লাইব্রেরি এবং অপেরা হাউস থেকে রাস্তার দিকে চলে যাওয়া ৬৪১৬ কিমি একটি পথের অনেক অংশেই পাহারা নেই।
সম্প্রতি ডিসেম্বরের এক শীতল সকালে একটি কানাডিয়ান পুলিশ ক্রুইজার হাস্কেল লাইব্রেরির কাছে পার্ক করা অবস্থায় দেখা যায়; যদিও সেটা ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, এরপরেই তারা চলে যায়।
হাস্কেল লাইব্রেরি ভবনে ঢুকতে চাইলে কানাডিয়ানরা সীমান্ত দিয়ে হেটে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার দিকে সম্মুখ দরজা দিয়ে ঢোকেন। এসময় কোনো পাসপোর্ট দেখানোর দরকার হয় না। কিন্তু লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সর্বক্ষণ তাদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে এবং নিজের সঙ্গে পরিচয়পত্রও রাখতে বলা হয়।
কিন্তু অবে জানান, লাইব্রেরিটি আসলে কোনো সীমান্ত ক্রসিং নয়। একসময় দুই দেশের নাগরিকরা দলে দলে এই লাইব্রেরিতে এসে আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতো এবং খাবার শেয়ার করতো, ফলে লাইব্রেরির পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ভয়ে এ ধরনের জমায়েত এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অবে বলেন, "এটা আসলে দুঃখজনক। আমরা খুশিমনে এটা করি না। আমরা চাই মানুষ তাদের পরিবার-পরিজনকে দেখুক। কিন্তু লাইব্রেরিতে যেসব সদস্য চাদা দিচ্ছে, তাদের সুবিধা-অসুবিধাও তো বিবেচনা করতে হবে।"
লাইব্রেরিটি পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ, যেহেতু এটি ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সংস্কারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা- দুই দেশেরই নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হয়।
তবে স্বতন্ত্রতা থাকা সত্ত্বেও হাস্কেলের কর্মীরা সহজেই স্বীকার করেন যে একসময় দর্শনার্থী আকর্ষণ করা যতটা সহজ ছিল এখন আর ততটা নেই; বিশেষ করে ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মাসব্যাপী বন্ধ থাকার পর তা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
তবুও এই লাইব্রেরিতে বাচ্চাদের জন্য বইয়ে ভরা একটি উজ্জ্বল ঘরে সাপ্তাহিক গল্পের আসর আয়োজন করা হয়। সেইসাথে এখানে রয়েছে একটি ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ বুক ক্লাব যা আমেরিকান ফ্রাঙ্কোফাইলদের পছন্দ। এছাড়া, অপেরা হাউসেও এখন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।
অবে জানান, স্থানীয় অনেকগুলো পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাস্কেল লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে এবং পর্যটকদের আগমনও অব্যহত রয়েছে। কারণ এটি বিশেষ একটি লাইব্রেরি।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এক দিনে লাইব্রেরির কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা যখন শেলফে বই সাজিয়ে রাখছিলেন এবং পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন- এমন সময় একজন নারী এসে সদর দরজায় টোকা দিলেন। বললেন, "আমার পড়ার জন্য কিছু একটা দরকার।" এপাশ থেকে জবাব এলো- "আপনি সঠিক জায়গায়ই এসেছেন।"
সূত্র: আল-জাজিরা