শাহজাহানের তাজমহলের আগেই স্ত্রীর জন্য সমাধিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন যে কবি!
তৃতীয় মোগল সম্রাট আকবরের সভার নবরত্ন নিয়ে কমবেশি সবাই নিশ্চয় জানেন। তার সভা আলোকিত করে ছিলেন নয়জন পণ্ডিত ব্যক্তি, যাদের একেকজনকে রত্নের সাথে তুলনা করা হতো। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এই জ্ঞানী মনীষীরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়। এক কথায়, তাদের তুলনা ছিলেন স্বয়ং শুধু তারা নিজেরাই!
তাদের মধ্যে একজন হলেন আব্দুল রহিম খান, যার জন্ম ১৫৫৬ সালের ১৭ ডিসেম্বরে। আকবরের জীবনী নিয়ে যদি কিছু ধারণা রাখেন, তবে বৈরাম খানের নাম জেনে থাকবেন। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুকালে আকবরের তখনো সিংহাসনের গুরুভার বহন করার মতো বয়স হয়নি। আকবর যতদিন না পরিপক্ক হয়ে ওঠেন, রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব ততদিন ছিল বৈরাম খানের কাঁধে। পাঁচ বছর ধরে পরম নিরাপদ ছায়া দিয়ে যান নাবালক আকবরকে।
মোগল সাম্রাজ্যের এই অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের অত্যন্ত আস্থাভাজন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; সম্রাট আকবরের কাছে ছিলেন একজন অভিভাবক। তারই যোগ্য পুত্র ছিলেন আব্দুল রহিম খান, হিন্দি সাহিত্যে যিনি রাহিমান নামেই বেশি পরিচিত। বৈরামকে যখন হত্যা করা হয়, রহিমের বয়স তখন কেবল চার বছর। তাই বাবার মৃত্যুর পর আকবরের দরবারেই প্রতিপালিত হন তিনি।
পরবর্তীতে সম্রাট আকবর তাকে মির্জা উপাধিতে ভূষিত করেন এবং মর্যাদাপূর্ণ খান-ই-খানা উপাধি দিয়ে পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাপতির দায়িত্ব দেন।
সম্রাট পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তো বটেই, পারিবারিকভাবেও তিনি সম্পর্কিত ছিলেন। তিনি শাহজাদা সেলিমের (পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর) গৃহশিক্ষক ছিলেন। তার এক কন্যা আকবরের তৃতীয় পুত্র দানিয়ালকে বিয়ে করেছিলেন।
আকবরের মৃত্যুর পর, রহিম খান জাহাঙ্গীরের দরবারেও কাজ করেন। কিন্তু পিতা আকবরের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, এই প্রাক্তন ছাত্রের সাথে তেমনটা হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার দুই পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। এমনকি তাদের মৃতদেহ সৎকার না করে নির্মমভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় শকুন ও শিকারি পাখিদের হাতে।
বহুজ্ঞ আব্দুল রহিম খান
দুই মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের অধীনে দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক কর্মজীবন ছিল তার। মোগল সাম্রাজ্যের সেনাপতি হিসেবে, একাধিক অভিযানে মোগল সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। মেওয়ারের রাজা প্রতাপ সিং ওরফে মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে আকবরের সৈন্যকে তিনিই পরিচালনা করেছিলেন।
গুজরাট, সিন্ধু এবং দাক্ষিণাত্য ইত্যাদি স্থানে মোগল সাম্রাজ্যের সামরিক বিজয়ে তার ভূমিকা ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল সামরিক দিক দিয়েই তার পাণ্ডিত্য সীমাবদ্ধ নয়। আকবর সভার এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও পরিচয় হলো, তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ স্থপতি এবং একজন বিখ্যাত কবি যিনি মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে লিখেছেন।
যুদ্ধক্ষেত্র এবং সাহিত্য—দুই জগতেই সমান পারদর্শী তরুণ রহিম খানের আরবি, ফার্সি, তুর্কি, সংস্কৃত, ব্রজ, আওয়াধি এবং খড়িবোলি ভাষা আয়ত্তে ছিল।
একাধারে কবি, গায়ক, গীতিকার এবং জ্যোতিষশাস্ত্রী এই রত্নকে মির্জা খানও বলা হতো। তার কবিত্বে এবং মধুর গায়কীতে রাজসভা প্রায়ই মেতে উঠতো এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে তার পারদর্শিতা তাকে রাজা-মন্ত্রী-উজির নির্বিশেষে সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
দোহাগান-এর কথা চলে উঠলে রহিম খানের কথা বলতেই হয়। যারা দোহাগানের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত, রহিমের হিন্দি দোহা তাদের কাছে অচেনা কিছু নয়। কারো কারো মতে, ইংরেজি কবিতা পড়তে শুরু করলে উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়র্থ দিয়েই শুরু করা উচিত। যদি তা-ই হয়, ভারতের ভক্তি আন্দোলন নিয়ে জানতে চাইলে, আব্দুল রহিম খানের দোহা পড়া উচিত।
তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তার কোনো লেখা ও কবিতায় তার সামরিক জীবন কিংবা যুদ্ধের কোন উল্লেখ নেই। ব্রজ ভাষায় লেখা মোট ২৮৯টি দোহা ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস এবং ধর্মের কথায় পরিপূর্ণ।
একটি শ্লোকে ভালোবাসা সম্পর্কিত উপদেশ দিতে দেখা যায় তাকে। তিনি লেখেন, 'রহিম, প্রেমের সুতোয় টান নাহি দিও, ছিড়িয়া যাইতে পারে/হয়তো ছেড়া সুতোয় এখন গিঁট দেওয়া আছে, সমসময় এমন রহিবে না।'
ভারতের সংস্কৃতিতে আব্দুল রহিম খানের অবদান
বিশিষ্ট এই পণ্ডিত তার পিতার মতোই সাহিত্যিক কৃতিত্বকে রাজনৈতিক মর্যাদার সমতুল্য বলে বিবেচনা করতেন। টিসিএ রাঘাবন তার বই অ্যাটেন্ডেয়ান্ট লর্ডস: বৈরাম খান অ্যান্ড আব্দুল রহিম, কোর্টিয়ার্স অ্যান্ড পোয়েটস ইন মোগল ইন্ডিয়া'তে লেখেন, "রহিম খানের অবস্থান ছিল 'ইসলাম এবং হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের মিলনে।' এটি এমন একটি সময় ছিল যখন ভারত 'আবার একটি কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্যের যুগে প্রবেশ করেছিল।'"
তার ওপর রামায়ন এবং মহাভারতের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তার কবিতায় হিন্দু দেবতা কৃষ্ণ, রাম, বিষ্ণু এবং শিবের উল্লেখ রয়েছে, যা হিন্দু ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
কৃষ্ণকে নিয়ে তার একটি কবিতার শেষ দুটো পঙক্তি ছিল এরকম: 'প্রতিদিন বৃন্দাবন হইতে তার প্রত্যাবর্তনের আশায় বসিয়া থাকি। শ্যামের প্রতিচ্ছবি যেন আমার মনকে ছাড়িয়া যেতে চাহে না।'
কথিত আছে, আকবর তাকে নিজের ব্যবহারের জন্য রামায়ণের ফারসি অনুবাদের রাজকীয় পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি রাখার বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন। রহিম খান তার অনুলিপটিতে লিখে রাখেন, 'ভারতের একটি সম্মানিত গ্রন্থ।'
ব্রজভাষা, আওয়াধি এবং খড়িবোলি প্রচারে আবদুর রহিম খান-ই-খানানের অপরিসীম ভূমিকা স্বীকার করেন হিন্দি সাহিত্যের পণ্ডিতেরা। তাদের লিখিত অসংখ্য বইয়ে দেখা মেলে এর প্রমাণ। এর মধ্যে একটি অন্যতম বই হলো, ড. বামবাম সিংয়ের রহিম সাহিত্য কি ভূমিকা।
হিন্দি সাহিত্যে রহিম খানের যে বর্তমান সংকলন রয়েছে, তা ১৮ শতকের শেষের দিকে এবং ১৯ শতকের গোড়ার দিকে শিক্ষাবিদদের বিস্তৃত গবেষণার ফসল। এ সংকলনে ২৮৯টি দোহা রয়েছে। এছাড়াও, বারভাই নায়িকা ভেদ-এ ১০০টিরও বেশি শ্লোক এবং প্রায় ১০টি চান্দ, মদনাস্তক, আটটি শ্লোক সম্বলিত ফুটকার এবং ১৪২টি শ্লোক সংবলিত নগর শোভা রয়েছে।
আজীবন ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্রবক্তা দিল্লির নিজামুদ্দিন পূর্ব অঞ্চলে এক সমাধিতে শায়িত আছেন।
মজার বিষয় হলো, এই সমাধিটি তিনি তার স্ত্রী মাহ বানুর জন্য তৈরি করেছিলেন এবং এটিই প্রথম মোগল সমাধি সৌধ যেটি একজন নারীর জন্য নির্মিত হয়েছিল। এর বয়স আগ্রার বিখ্যাত তাজমহলের চেয়েও বেশি। তিনি ১৫৯৮ সালে তার স্ত্রীর জন্য উপহার হিসাবে এই সমাধি নির্মাণ করেন এবং ১৬২৭ সালে তার মৃত্যু হলে, তাকেই সেখানে সমাধিস্থ করা হয়।
২০১৭ সালে, আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার সমাধিটি সংস্কার করে এবং পরবর্তীতে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
- সূত্র: দ্য প্রিন্ট