ডিএনএ সূত্র ধরে জন্মদাতা পিতামাতার পরিবারের খোঁজে তিন মহাদেশে!
১৯৬১ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এক দম্পতি দত্তক নেন শিশু টিম কুরানকে। বড় হয়েছেন পালক পরিবারেই। বড় হয়ে জানার ইচ্ছে জাগে, জন্মদাতা পিতামাতার পরিচয়। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেন মুখে কুলুপ এটে বসেছিলেন। রেকর্ডের অনেক নথিও ছিল টিমের নাগালের বাইরে। এক সময় যখন হতাশ হয়ে পড়ছিলেন, তখনই একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের ডিএনএ বিশ্লেষণের। ফলাফল হাতে আসতেই, তার সঙ্গে অনলাইনে থাকা সরকারি তথ্যের রেকর্ড ঘেঁটেই সমাধান পান শেষমেষ। সিএনএন অবলম্বনে
তবে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেয়ে চমকেও যান। কারণ, টিম এতকাল নিজেকে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান বলেই জানতেন। অর্থাৎ, ভেবেছিলেন জন্মদাতা বাবা-মাও শ্বেতাঙ্গও হবে হয়তো। কিন্তু, দেখা গেল এই ধারণা অর্ধসত্য। আসলে তার মায়ের জন্ম সেদেশে হলেও, দেখা গেল তার বাবা উত্তর আফ্রিকার কেউ।
এরপর অনলাইনে বংশক্রম খোঁজার কিছু প্ল্যাটফর্ম– অ্যানসেস্টরি ডটকম আর বেশকিছু সরকারি সাইটের তথ্য ঘাঁটাঘাঁটির পর জন্মদাতা পিতামাতার নামধাম তো পেলেনই, সাথে পেলেন তাদের কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের ঠিকানাও।
জানতে পারলেন, ১৯৩০ এর দশকের মধ্যভাগে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় জন্মগ্রহণ করেন তার বাবা। ১৯৫৯ সালে তিনি অভিবাসন করেন যুক্তরাষ্ট্রে। এক সময় থাকতে শুরু করেন সান ফ্রান্সিসকো শহরে। এরকাছেই সান দিয়াগোতে বেড়ে ওঠেন টিমের মা। হাইস্কুল পেরোনোর পর তিনিও পাড়ি জমান সান ফ্রান্সিসকোয়।
কিন্তু, আরো জানার তাগিদ কাজ করছিল টিমের মনে। আর সেটা যে আর ঘরে বসে সম্ভব নয়, সেটাও বুঝতে পারছিলেন। শুরু করেন, পিতামাতার আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা।
একটু দুর্ভাবনাও ছিল। এতদিন পর চেনা নেই জানা নেই, এমনকি যারা হয়তো টিম বলে কোনো আত্মীয় আছে বলেও জানেন না, তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন– এটা ভেবেই ছিলেন শঙ্কিত। তবে সেই শঙ্কা দূর হয় অনলাইনের যোগাযোগেই। তার বাবা ও মা দুজনের আত্মীয়রাই টিমকে আমন্ত্রণ জানান। এবার ঘর ছাড়ার পালা।
প্রথম সাক্ষাৎ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা
টিম কুরানের প্রথম গন্তব্য ছিল ফ্রান্সের প্যারিস। ইউরোপের এই শহরেই থাকেন তার মায়ের বোন ও তাদের সন্তানেরা। প্যারিসে তার সম্মানে জমকালো এক পার্টি দেন তার এক কাজিন।
টিমের ভাষায়, 'প্যারিসে এটা আমার তৃতীয়বার আসা। তবে এবারের অনুভূতিটা যেন অন্যরকম। সবকিছুই দেখছিলাম ভিন্ন চোখে। নিজেকে এই শহরেরই এক সন্তান ভাবতে শুরু করি'।
প্যারিসে কাজিনদের পরামর্শে বিখ্যাত কিছু রেস্তোরাঁর নানান পদের স্বাদ নিয়ে, এখানে-ওখানে ঘুরে বেশ কিছুদিন কাটালেন টিম। এবার বিদায়ের পালা। পরবর্তী গন্তব্য যে তাকে ডাকছে তখন।
প্যারিসের চেয়ে ভিন্ন আরেক জগত মরক্কো। টিমের ভাষায়, আগে কোনোদিন ইউরোপ বা আমেরিকার বাইরে তো বটেই, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশে পা রাখিনি। সেবারই ছিল প্রথম।
মরক্কো এসে প্রথম দিন ছয়েক কাটান সমুদ্রপাড়ের পর্যটন শহর দার বৌজ্জা'য়। তার পিতৃভূমি কাসাব্লাঙ্কা থেকে সড়কপথে যার দূরত্ব মাত্র ৪৫ মিনিটের। এখানেই তার বাবার পরিবার গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর চমৎকার কিছু বাড়ির মালিক। সেখানে সমুদ্রের কিনারে দিন ছয়েক যেন কাটে চোখের পলকে। গ্রীষ্মকালে কাসাব্লাঙ্কার অসহনীয় গরম থেকে মুক্তি পেতেই দার বৌজ্জা'য় কেনা তার দাদার জমিতে এসব বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
টিমকে পেয়ে দারুণ আনন্দিত ছিলেন তার চাচা-ফুফুরা। দারুণ দারুণ সব পদ রান্না করে টিমকে প্রতিদিন ভুরিভোজে আসক্ত করে তুলছিলেন। মরক্কোর আদি অকৃত্রিম ভেড়ার 'তাজিন' নামক পদ, পাস্তিলা– মোটামুটি এমন হরেক পদের আয়োজন লেগেই ছিল।
পিতৃভূমি ঘুরে দেখা
টিম বলেন, পিতার জন্মভূমি আরো ঘুরে দেখার সাধ তো ছিলই। তাই এক চাচাতো বোন ও তার স্বামীর সাথে ফেজ ও ম্যারাকেশ দেখতে বেড়িয়ে পড়ি একদিন। আর এখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল চমক। জানতে পারলাম, তার স্বামী আবার বিলাসবহুল এক ট্রাভেল কোম্পানিরও মালিক।
দুটি শহরই ছিল ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রাচুর্যে চোখ-ধাঁধানো রকমের প্রাণবন্ত। 'ভাগ্যিস, ডিএনএ পরীক্ষা করেছিলাম, সেই সূত্রেই আজ এদের দেখারও সৌভাগ্য হলো'- নিজ অভিজ্ঞতাকে টিম কুরান এভাবেই ব্যক্ত করেছেন।
ফেজে গিয়ে দেখলেন পরিবারের প্রাচীন সমাধি। এই শহরের মেদিনা তথা বাজারগুলির সৌন্দর্য তাকে সবচেয়ে অভুভূত করলো। দেখলেন অপরূপ কারুকার্যে নির্মিত মসজিদ, আর ম্যারাকেশে পেলেন ইহুদিদের সবচেয়ে বড় উপাসনালয় বা সিনাগগ।
শত শত বছর ধরে যে কারিগররা অসাধারণ হস্তশিল্প তৈরি করছেন, তাদের মাটির মাত্র, চামড়ার পণ্য বানানো দেখতে দেখতে তার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
মরক্কোর রাজধানী রাবাতের কাছে প্রাচীন রোম সভ্যতার ধবংসাবশেষ দেখলেন এরপর। তৃতীয় শতকে রোমানরা এই শহরটি ছেড়ে চলে যায়। তারপর দীর্ঘকাল চাপা পড়েছিল মাটির নিচে। ২০ শতকের শুরুতে মাটি খুঁড়ে এর সন্ধান মেলে।
প্রাচীন শহরের অনেক বাড়ির ভিত্তি, দেওয়াল ও মোজাইক করা মেঝে আজো অক্ষত। এই অনন্য অভিজ্ঞতা যে আমেরিকায় থাকলে কোনোদিনই হতো না সেটা অকপটে স্বীকার করেছেন টিম। তার ওপর ইতিহাস প্রিয় হওয়ায় এসব কিছু তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছিল।
তবে বিদায়ের দিনও ঘনিয়ে আসছিল। তাই এক সন্ধ্যায় এই সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে গেলেন সুউচ্চ অ্যাটলাস পর্বতমালা ভ্রমণে। এখানে তাকে বারবার জাতির রন্ধনশৈলীর অভিজ্ঞতা দিলেন আত্মীয়রা। শেখালেন কীভাবে তাদের মতো করে রাঁধতে হয় ভেড়ার স্ট্যু ও সবজির পদ।
পরিবারের প্রধান টিমকে মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী আলখেল্লা– দেজাল্লবা পরিয়ে দেন। আর তারপর সবাই মিলে তোলেন ছবি। এভাবেই আনন্দযাত্রায় শেষ হয় মরক্কো ভ্রমণ। না বলা ভালো- উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা অভিযান।
জন্মদাতা বাবা-মার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেশুনে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরেন টিম কুরান। আর যারা বংশপরিচয় জানতে ভ্রমণ করতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে সতর্ক পরামর্শ দেন, 'ডিএনএ পরীক্ষার ভিত্তিতে ভ্রমণ করতে চাইলে, চমকে যাওয়ার আর নতুন অভিজ্ঞতা লাভের প্রস্তুতি রাখুন। কেউ জানে না বিশ্বের কোন সুদূর প্রান্তে চলে যাবেন আপনি। তাই মনস্থির করার পর, সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে পারবেন'।