হোজ্জা তুমি কার!
চীনের শিনজিয়াং থেকে ফিরে...
তুর্কিদের কাছে তিনি নাসিরুদ্দিন হোচা, গ্রিকদের কাছে হোজ্জা, আরবদের কাছে তিনি যোহা, আবার আজারবাইজান, ইরান ও দক্ষিণ এশিয়ায় তিনি মোল্লা নাসিরুদ্দিন। তার পুরো নাম নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল খায়ী। নামের মতো তার জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে মতাধিক্য। অজস্র গল্প ছড়িয়ে আছে নাসিরুদ্দিনের নামে, যেগুলো সব বয়সের মানুষের কাছেই বুদ্ধিদীপ্ত নির্মল কৌতুকের আধার হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।
গল্পগুলো তার জীবনের ছোট ছোট ঘটনার বর্ণনা, যাতে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে সুক্ষভাবে খোঁচা দেওয়া হয়েছে সমাজের ক্ষমতাধরদের, আছে নৈতিকতার শিক্ষাও। কোনও কোন গল্পে তিনি বোকাও সেজেছেন।
খাসি ও বিড়ালের গল্পটা কমবেশি সবারই জানা।
এক সের খাসির মাংস এনে বউকে রান্না করতে বলেছিলেন মোল্লা। রান্নার পর স্বাদ চাখতে গিয়ে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিল বউ। খেতে বসে মাংসের জন্য অপেক্ষা করছেন মোল্লা। বউ বলল, বিড়াল খেয়ে ফেলেছে সবটুকু মাংস। মোল্লার সন্দেহ হলো। তিনি দাঁড়িপাল্লায় বিড়ালটাকে মেপে দেখলেন ওজন এক সের। তখন তার মোক্ষম প্রশ্ন-- এটা যদি বিড়ালের ওজন হয় তাহলে খাসির মাংস গেল কই! আর এটা যদি খাসির মাংসের ওজন হয় তাহলে বিড়াল গেল কই।
ত্রয়োদশ শতকের এ রহস্যময় তুর্কী দার্শনিকের এসব গল্প কিছুটা পরিবর্তিত ভাবে প্রচলিত আছে এশিয়ার মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে গত প্রায় সাতশ' বছর ধরে। প্রাচীন গ্রিস উপকথার ঈশপের গল্পের মতো হোজ্জার গল্পগুলোও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে; প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে মধ্য এশিয়া, ভারত উপমহাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য, আরব, আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত।
শতকের পর শতক ধরে পরিবর্তিত হয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে বইয়ে, অনুদিত হয়েছে নানা ভাষায়। সবগুলো গল্পই যে তিনি নিজে বলেছেন বা লিখে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। স্থানীয় উৎস থেকে তৈরি হওয়া অনেক গল্পও তার নামে প্রচলিত হয়ে গেছে। যেমনটি হয়েছে ইশপের ক্ষেত্রে, বা এ উপমহাদেশের গোপাল ভাঁড় বা প্রাচীন সংষ্কৃত কবি কালদাসের বেলায়।
কিছু কিছু গল্প তো হুবহু মিলে যায়। যেমন গাছের ডালে বসে সেই ডালটাই কাটার গল্প, হোজ্জার এ গল্পটা আবার কালিদাস পণ্ডিতের নামেও প্রচলিত আছে। এ গল্পটার একটা নৈতিক শিক্ষা আছে, তা হল উপযাচক হয়ে কেউ কোন পরামর্শ দিলে সহসা কেউ গায়ে মাখে না, পরে বিপদে পড়ে মানুষ বুঝতে পারে তার মর্ম। যেই ডালে বসেছিলেন, সেই ডালটাই কাটছেন দেখে এক পথচারী হোজ্জাকে সতর্ক করে বলেছিল, ডালের সাথে আপনিও তো পড়ে যাবেন। হোজ্জা গা করেননি, একটু পরেই যখন কাটা ডালসহ গাছ থেকে পড়লেন, তখন তার মনে হল পরামর্শদাতার কথা। লোকটাতো ঠিকই বলেছিল, তাকে বলা দরকার যে তার কথা না শুনে কী দশা হয়েছে। ততক্ষণে লোকটা চলে গেছে।
আবার উল্টো শিক্ষাও আছে অন্য গল্পে। সেটি তার প্রিয় বাহন গাধাকে নিয়ে।
হোজ্জা তার ছেলেকে নিয়ে কোথাও চলেছেন, সামনে হাঁটছে তার গাধাটা। পথে লোকজন বলল, কেমন বোকা দেখ, গাধার পিঠে না চড়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে।
সমালোচনা শুনে হোজ্জা তার ছেলেকে গাধার পিঠে উঠিয়ে নিজে হেঁটে চললেন। একটুখানি যেতেই তার কানে এলো আরেক পথচারীর মন্তব্য, দেখ কেমন ছেলে, বাপ হেঁটে যাচ্ছে, আর ছেলে গাধার পিঠে চড়েছে।
এবার হোজ্জা ছেলেকে নামিয়ে নিজেই উঠলেন গাধার পিঠে। এরপরও রক্ষা নেই। কানে এলো আরেক পথচারীর বক্রোক্তি, কেমন আক্কেল বাপটার, ছেলেকে হাঁটিয়ে নিচ্ছে, আর নিজে আরাম করছে গাধার পিঠে।
লজ্জা পেয়ে ছেলেকেও গাধার পিঠে তুলে নিলেন হোজ্জা। এবার আরো কড়া মন্তব্য- কেমন নিষ্ঠুর! গাধাটার জন্য একটু মায়া নেই, বাপ-ছেলে দুইজন উঠে বসেছে।
অতিষ্ট হয়ে হোজ্জা ছেলেকে নিয়ে নেমে গেলেন গাধার পিঠ থেকে। এবার দুজনে মিলে গাধাটাকেই কাঁধে তুলে হাঁটতে শুরু করলেন। মানুষের অযাচিত মন্তব্য শুনলে কী বিপত্তি হয় এ গল্পে তা দেখানো হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, হোজ্জার জন্ম ১২০৮ সালে, তুরস্কের আনাতোলিয়ার হোরতু গ্রামে। আকসেহির শহরে তখনকার দিনের জ্ঞানী ব্যক্তি সৈয়দ মাহমুদ হায়রানি ও সৈয়দ হাচি ইব্রাহিমের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে তিনি কাজী হিসেবে বিচারের কাজ করতেন। তার মৃত্যু হয়েছিল ১২৮৪ সালে।
তুর্কি ভাষায় হোচা বা হোজ্জা'র অর্থ শিক্ষক বা ধর্মীয় নেতা। কাজাকরা তাকে জানে কোজা নাসিরুদ্দিন, তাজিকদের কাছে তিনি পরিচিত মুশফিকি।
হোজ্জাকে নিয়ে দাবি মধ্য এশিয়ার দেশে দেশে। তুরস্ক তো আছেই, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান-- সবারই দাবি হোজ্জা তাদের লোক। ইউনেস্কোর সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় হোজ্জার অন্তর্ভূক্তি চেয়ে চিঠি লিখেছে দেশগুলোর সরকার।
নানা শহরে তার স্থাপত্য আছে। উজবেকিস্তানের বুখারা শহরে আছে গাধার পিঠে বসা। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী শিনজিয়াং অঞ্চলের দাওলাং উপজাতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ পার্কের প্রবেশপথেই আপনাকে স্বাগত জানাবে গাধার পিঠে উল্টো করে সওয়ার হওয়া হোজ্জার স্থাপত্য। তারাও মনে করে হোজ্জা তাদের।
গাধার পিঠে পেছন ফিরে কেন বসতেন তারও গল্প আছে। এভাবে বসার কারণ জানতে চাইলে তার উত্তর ছিল- 'আমি তো ঠিক পথেই আছি, উল্টোপথে হাঁটছে আমার গাধাটা'।
যাইহোক, শিনজিয়াং-এর এ পার্কে ঢোকার পথে গাধার পিঠে ফুলের পাগড়ি মাথায় উল্টোমুখে বসা হোজ্জাকে চীনের দাওলাং উপজাতির মানুষরা পরম শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী ও দয়ালু হিসাবে জানত। তাদের কাছে তিনি হলেন অবন্তি, যার অর্থ শিক্ষক, স্যার। তাদের দাবি, হোজ্জার জন্ম এই আওয়াত কাউন্টিতেই।
পাশের একটা ফলকে এমন কথাই লেখা রয়েছে।স্থানীয় গাইডও এ তথ্যই জানাল। তবে এ-ও জানাল যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার হতেও তো পারে। কারণ চীনের এ এলাকাটি তো প্রাচীন সিল্ক রুটের মধ্যেই ছিল। হোজ্জার জীবদ্দশায় তো এ রুট সচল ছিল। গাধার পিঠে উল্টোদিকে ফিরে বসে কোন বাণিজ্য কাফেলার সাথে তিনি যে এ এলাকায় আসেননি তা হলফ করে বলা যাবে না।
এখন আবার সেই সিল্ক রুট চালু হচ্ছে, চীনের এ অংশের সাথে মধ্য এশিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া হয়ে আফ্রিকা ও ইওরোপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যোগসূত্র হিসাবে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা থেকে যাবেন অনন্তকাল।