পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল গোলমরিচ– কিন্তু কজনই তা জানেন?
মানব ইতিহাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো শোষণকারী বাণিজ্যিক সংস্থার নজির কমই আছে। ভারতীয় উপমহাদেশবাসী এই নামটির সাথে জড়িয়ে থাকা বেদনার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন। ১৬০০ শতকে ইংল্যান্ড-অধীশ্বরী রানি প্রথম এলিজাবেথ অনুমোদন দেন এই কোম্পানি গঠনের। তাদের প্রথম অভিযানগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল মসলার জন্য সন্ধান। ১৬০৩ সালে মিললো সেই সফলতা। দক্ষিণ এশিয়া অভিযান থেকে কয়েক জাহাজভর্তি গোলমরিচ নিয়ে লন্ডনে ভিড়ল কোম্পানির নৌবহর। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন জেমস ল্যাংকাস্টার। তারা যে সম্পদ নিয়ে ফিরেছিলেন, ইংল্যান্ড তো বটেই, গোটা ইউরোপেই তা ছিল অমূল্য। এক কথায়, মসলা বা সুনির্দিষ্টভাবে বললে– গোলমরিচই দিল কোম্পানিকে প্রাচ্যে বিপুল সম্পদের সন্ধান। দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে
গোলমরিচ গাছের আদিনিবাস বলে মনে করা হয় দক্ষিণ ভারতের কেরালা এবং বিশেষত পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে। ভারতের পশ্চিম উপকূলজুড়ে বিস্তৃত এই পর্বতশ্রেণির অঞ্চল- উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ুর জন্য পরিচিত। প্রাচীন রোমান সভ্যতাতেও ছিল গোলমরিচের কদর। ১১ শতক নাগাদ ইংল্যান্ডেও ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা পায় মসলাটির ব্যবহার। এসময় লন্ডনে প্রথমবারের মতো গড়ে ওঠে গোলমরিচ বণিকদের সমিতি– গিল্ড অভ পেপারার্স (কালেক্রমে মুদি দোকানিদের জোটে পরিণত হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আজো আছে)।
ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের সময়– মসলা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় একদমই নতুন ছিল একথা বলার জো নেই। বরং ইউরোপীয়রা প্রাচ্যের বণিকদের পাশ কাটিয়ে নিজেরাই এই বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল। এই আকাঙ্ক্ষা ইউরোপীয় অভিযানগুলোকে প্রাচ্যের দিকে চালিত করতে থাকে। উদ্দেশ্য মসলা ও অন্যান্য বহুমূল্য পণ্য সংগ্রহ এবং সেসব ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে উচ্চ মুনাফা অর্জন। এভাবেই মসলা সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এককথায় উপনিবেশ বিস্তারেরও চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। প্রাচ্য আরো পরিচিত হয়ে ওঠে এবং একে দখলযোগ্য সম্পত্তি বলে গণ্য করতে থাকে ইউরোপীয়রা।
এদিক থেকে বিচার করলে, বিশ্ব ইতিহাসের এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ছিল সেই দিনটি, যেদিন গোলমরিচ-বোঝাই জাহাজের বহর ভিড়েছিল লন্ডনে। সেদিন থেকেই বদলে যায় পশ্চিমা দুনিয়া, এই রুপান্তর ছিল অপরিবর্তনীয়।
প্রথম এলিজাবেথের চার্টারে মাত্র ১৫ বছর কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি পেয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কিন্তু, তার উত্তরাধিকারী রাজা প্রথম জেমস এক ঘোষণাতেই অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অনুমতি দেন। শর্ত ছিল- চার্টার বা সনদ ধরে রাখতে হলে কোম্পানিকে লাভজনক হতে হবে।
ঐতিহাসিক অ্যালেক্স ভন টুনজেনম্যান এপ্রসঙ্গে লিখেছেন, 'এভাবেই তৈরি হলো এক দানব, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল অর্থ…ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিখাঁদ পুঁজিবাদকে অবাধ তাণ্ডবের সুযোগ দেওয়া হলো'। আরেকটি অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, 'এটা (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) ছিল বেসরকারি খাতের অর্থচালিত এক সাম্রাজ্য; যার ছিল না বিবেকের দায়, এশিয়াজুড়ে তাণ্ডব চালায় তারা, যা ১৮৫০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল'।
গোলমরিচের ইতিহাস নিয়ে গার্ডিয়ানের মতামত কলামে লেখা এক নিবন্ধে সুলেখক ও একাডেমিক ড. আন্না সুয়াল মেসিং লিখেছেন, "অভিবাসীদের জিজ্ঞেস করা হয়, সে কোথা থেকে এসেছে? গোলমরিচের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এই উত্তর সহজ নয় এবং পরিস্থিতি ভেদে ভিন্ন হবে। এর সাথে জড়িত যে, উপনিবেশবাদ ও সহিংসতার অজস্র কাহিনি। গোলমরিচের ইতিহাস সন্ধান করলে, আমরা পাব লুকানো অতীত ও চাপা পড়া অজস্র কণ্ঠস্বর। আমি সাবেক ব্রিটিশ কলোনির মিশ্র বংশোদ্ভূত একজন, বাস করছি ব্রিটেনেই। আমার পরিবার অন্যতম মসলা উৎপাদক অঞ্চল বোর্নিওতে গোলমরিচ চাষ করতো। ফলে আমার অস্তিত্বের গল্পও মসলার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত। এক কথায়, বৈশ্বিক এসব বাণিজ্যিক সংযোগের হাত ধরেই পৃথিবীর আলো দেখেছি আমি।"
তিনি জানান, ব্যক্তিগত এই যোগসূত্র থেকেই আমি বচর পাঁচেক আগে সারাওয়াক গোলমরিচের চাষ ও ব্যবহার সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করি। আগ্রহের শুরুটা হয়েছিল, লন্ডনে মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁর মেন্যু দেখে। সেদিন থেকেই পড়ে আছি গোলমরিচের দুনিয়ায়। আর এর আদিকথা যত জেনেছি, ততই হয়েছি বিস্মিত। এই কাহিনিগুলো কখনো হতবাক করে দেয়, কখনো নঅশ্রুসিক্ত করে কখনোবা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে। গোলমরিচের ইতিহাস রন্ধনশৈলীরও ইতিহাস, এবং কীভাবে এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে– তারও আখ্যান।
আন্না সুয়াল মেসিং তার গবেষণায় দেখেন, রেনেসাঁর যুগে খাবারের রঙ কালচে হোক, এমনটা পছন্দ ছিল না ফরাসীদের। এসময় ঝাঁঝালো মসলা হিসেবে গোলমরিচের ব্যবহার বাড়ে ফ্রান্সে। অথচ, রান্নার এই ধরনটি সুদূর চীনের হংকং ক্যান্টনিজ ঘরানার। বিশেষ করে, সেখানে সস ও ব্রথ ক্ষেত্রে এর চল ছিল ব্যাপক। আর তার সুগন্ধিও অনন্য। ব্রিটেনের ক্যাফেগুলোতে আজকাল এভাবে তৈরি সস ও ব্রথ খুবই প্রচলিত।
ডিমের মামলেট হোক বা পোচ–তাতে গোলমরিচের গুড়া আজ তাতে ব্রিটিশ রসনার অপরিহার্য অংশ। এটা এতটাই সাধারণ যে, বেশিরভাগ মানুষ তার পেছনের বহু সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পর্কে মাথাও ঘামায় না।
ড. আন্না সুয়াল মেসিং বলেছেন, মালয়েশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের সারাওয়াক রাজ্যের সাথে আমার আত্মীয়তার যোগ। সেখানকার গোলমরিচ আমাকে নিজের অতীত সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে। এভাবে ছোটবেলায় সারাওয়াকের যেসব স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছি– তাদের নতুন দৃষ্টিতে– শ্রম ও উৎপাদনের স্থান হিসেবে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আরো জেনেছি, বোর্নিওর মসলা বাণিজ্যের প্রাচীন পথগুলো সম্পর্কে আজো অনেক কিছুই অস্পষ্ট ও রহস্যের চাদড়ে মোড়া– যেমনটা ৫০০ বছর আগেও ছিল।
ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে সারাওয়াক গোলমরিচের আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কেও খোঁজ নেন মেসিং। কিন্তু, কেউ তাকে স্পষ্ট উত্তর দিতে চায়নি। কেউ তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, কেউবা দেখা করলেও তথ্য দিতে সরাসরি অস্বীকার করে।
ইউরোপের মসলা বণিকরা বলেন, পণ্যের মান দেখেই তার গুণ বিচার করা উচিত। অর্থাৎ, ভালো মান হওয়ায় পণ্যও নিশ্চয় সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা হয়েছে– এমন যুক্তি তাদের। কিন্তু, এই আরোপে চাপা পড়ে যায়- বাদামি ও কালো চামড়ার সেসব মানুষের কথা, যারা গোলমরিচ চাষে জড়িত। সারাওয়াকে স্থানীয় কৃষকরাই এর চাষ করে।
মালয়েশিয়ার গোলমরিচ বোর্ডের সাবেক সদস্য ল্যারি সেইত বলেন, এটি অর্থকরী ফসল, যা আয় হয় তাতে চাষিরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে, তিনবেলা খাবার নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু, এতটুকুই; ইউরোপের বণিকদের মতো উচ্চ মুনাফা আজো অধরা তাদের।
এজন্য দায়ী উপনিবেশবাদী পরিকল্পনাই, যার আওতায় সরবরাহ চক্রকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল যাতে শুধু ইউরোপীয় বণিকরাই লাভবান হয়। চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার সাথে তারা এই উপনিবেশবাদী প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছে। আজকের ইউরোপীয় বণিক ও তাদের সরবরাহকারীরাও এই কাজ করছে। স্থানীয় পুঁজিবাদিরা করছে মসলা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, আর সরাসরি বিক্রি করছে ইউরোপে। এই দৌরাত্ম্যে ছোট চাষিদের বঞ্চণা আজো অব্যাহত। সহজ অর্থে, পুঁজিবাদের ইতিহাসে মসলা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, গোলমরিচ যেখানে যুদ্ধ, রক্তপাত আর শোষণের কেন্দ্র পরিণত হয়, আজো যার ছাপ মুছে যায়নি মোটেও।