ভাসমান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র কি সমুদ্রে টিকে থাকতে পারবে?
১০ হাজারের বেশি দ্বীপের দেশ ইন্দোনেশিয়া। তাই গোটা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা বিরাট চ্যালেঞ্জ।
১০ লাখের বেশি ইন্দোনেশিয়ান বিদ্যুৎ গ্রিড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বিশেষ করে প্রত্যন্ত দ্বীপে বসবাসরত মানুষের কাছে ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত দুরূহ। এমনকি উইন্ড টারবাইন বসানোও প্রায় অসম্ভব এসব অঞ্চলে।
প্রত্যন্ত এই দ্বীপগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি সমাধান হতে পারে সৌরবিদ্যুৎ। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে সৌরবিদ্যুতের খরচ অনেকটাই কমে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) বলছে, সামনের দিনে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে সস্তা বিদ্যুতের উৎস।
কিন্তু সোলার ফার্ম বা সৌর খামার করতে প্রচুর জায়গার প্রয়োজন। ওই জায়গায় হয়তো বাড়ি, কৃষিকাজ কিংবা ব্যবসা করা যেত।
এজন্য বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এখন সমুদ্রপৃষ্ঠে সোলার প্যানেল স্থাপনের উপায় খুঁজছেন। এতে সফল হওয়া গেলে সমুদ্রের তীরবর্তী মানুষজনের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।
এ পরিস্থিতিতে সমুদ্রে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
ব্রিটেনের ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক লুফেং হুয়াং বিবিসিকে বলেন, 'ভাসমান সোলার খুব সুবিধাজনক, কারণ এটি পানির ওপর ভাসিয়ে রাখা যায়। যদি বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত সোলার প্যানেলও যোগ করা যায়।'
বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু জায়গায় ইতিমধ্যে ভাসমান সোলার ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সেগুলো সাগরে নয়, লেকে ব্যবহৃত হচ্ছে।
লেকে ব্যবহার কারণটা স্পষ্ট: সমুদ্রের ঢেউয়ে ভিজে গিয়ে সোলার প্যানেল অনায়াসেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে অশান্ত পানিতেও সোলার প্যানলকে কীভাবে অক্ষত ও কার্যক্ষম রাখা যায়, তা নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
যেমন ডাচ-নরওয়েজিয়ান কোম্পানি সোলারডাক জার্মান এনার্জি কোম্পানি আরডব্লিউই-র সঙ্গে যৌথভাবে উত্তর সাগরের একটি উইন্ড ফার্মে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাজ করছে।
কোম্পানিটি বলছে, এটি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অফশোর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কয়েকশো বাড়িতে সরবরাহ করা যাবে।
সোলার প্যানেলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে একটি মঞ্চের ওপর থাকবে। ২০২৬ সালে কেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। উইন্ড ফার্মে থাকা বিদ্যমান ক্যাবল ব্যবহার করেই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে স্থলভাগে বিদ্যুৎ পাঠানো হবে।
এদিকে আরেক কোম্পানি ওশেন সান একটি ভাসমান রিগ তৈরি করেছে। সেখানে সোলার প্যানেলগুলো এমন ভিতের ওপর বসানো হয়েছে যা ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলাতে পারে। এটি ঢেউয়ের শক্তি কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ঢেউ যেন সোলার প্যানেলে আছড়ে পড়তে না পারে, সে ব্যবস্থাও করে।
ওশেন সানের প্রধান নির্বাহী বোর্হে বিয়র্নেকলেট বলেন, প্যানেলগুলো যেহেতু একেবারে সোজাভাবে স্থাপিত, তাই এগুলোর ওপর প্রয়োগ করা শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। এছাড়া সাগরের পানির খুব কাছাকাছি স্থাপিত হয় সেলগুলো দ্রুত ঠান্ডা হয়। এতে এদের পারফরম্যান্সও ভালো হয়।
ওশেন সান ও সোলারডাক উভয়েই উইন্ড টারবাইনের সঙ্গে সোলার ফার্ম গড়ে তুলতে চাইছে। এর ফলে যখন বাতাস থাকবে না, তখনও বিদ্যুতের সরবরাহ মসৃণ থাকবে।
তবে হুয়াংয়ের মতে, উভয়ের পদ্ধতিতেই কিছু দুর্বলতা আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি উচ্চতায় প্যানেল স্থাপন করার সোলারডাকের এই পদ্ধতিতে খরচ আরও বেড়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, 'প্যানেল যদি উঁচুতে স্থাপন করতে চান, তাহলে এগুলোকে খুব শক্তিশালী ভিতের ওপর বসাতে হবে। কাজেই এতে খরচ অনেক বেশি বেড়ে যাবে।'
অন্যদিকে ওশেন সানের পদ্ধতিতেও যে সোলার প্যানেলগুলো ঢেউয়ের হাত থেকে পুরোপুরি বাঁচতে পারবে, এ ব্যাপারেও একমত নন হুয়াং।
বিয়র্নেকলেটও স্বীকার করেছেন যে উত্তর সাগরে—যেখানে ঢেউয়ের উচ্চতা হয় ৩০ ফুট—তার কোম্পানির পদ্ধতি ঠিকমতো না-ও কাজ করতে পারে। তবে তিনি বলছেন, একটি জলাধারে পরীক্ষানিরীক্ষার সময় তাদের পদ্ধতিটি চার ধরনের টাইফুনের মধ্যে কাজ করেছে।
তিনি বলেন, যেসব এলাকা তীরের কাছাকাছি অবস্থিত এবং যেখানে সমুদ্র তুলনামূলক শান্ত থাকে, ওই এলাকাগুলো বেশি আকর্ষণীয়।
হুয়াং ও তার দল বিকল্প অফশোর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কাজ করছেন। যা তুলনামূলক শক্তিশালী ও সাশ্রয়ী হবে।
ইন্দোনেশিয়ায় একাডেমিক ও বাণিজ্যিক অংশীদার রয়েছে হুয়াং ও তার দলের। তারা আশা করছেন, আগামী ১২ মাসের মধ্যে ভারত মহাসাগরে একটি পরীক্ষামূলক প্রদর্শনী করা যাবে।
হুয়াং জানান, সোলারটুওয়েভ (Solar2Wave) নামের এই ভাসমান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে এমন সোলার প্যানেল থাকবে যেগুলো ঢেউয়ের উচ্চতা প্রায় ৯০ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারবে। উচ্চতা কমে যাওয়া ঢেউ তখন একটা 'বাফার জোনের'—ছোট্ট বেষ্টিত জলা—মধ্য দিয়ে পার হবে। এতে সোলার প্যানেলে আঘাত হানার আগে ঢেউয়ের শক্তি আরও কমে যাবে।
হুয়াং বলেন, ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার তা ওই বাফার জোনেই হবে। আর এর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিস্থাপন খুব সহজ এবং সস্তা।
সমুদ্রে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ ফার্ম স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ অনেক ব্যয়বহুল হলেও পৃথিবীর কিছু জনবহুল এলাকায় নবায়নযোগ্য শক্তি সরবরাহের একমাত্র উপায় হবে এসব ফার্ম।
যেমন সিঙ্গাপুরে জমির দাম খুব বেশি। এছাড়া দেশটিতে ভবনগুলোর অধিকাংশ ছাদই কাজে লাগিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো যদি সমুদ্রপৃষ্ঠকে কাজে লাগায়, তাহলে সেটি তাদের জন্য দারুণ উপকারী হবে। বিয়র্নেকলেটের মতে, বস্তুত এটাই হবে এসব দেশে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের একমাত্র উপায়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় একটা অংশের জন্য ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ দারুণ কাজে আসতে পারে।
এছাড়া তীর থেকে অনেক দূরেও ভাসমান সোলার ফার্ম স্থাপন করা যায়। ওসব সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র বৈদ্যুতিক জাহাজের জন্য রিফুয়েলিং পয়েন্ট হতে পারবে।
লুফেং হুয়াং বলেন, ভাসমান সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাবনা তো অবশ্যই আছে। তারা সবাই-ই সফলভাবে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
- সূত্র: বিবিসি