ক্রমে উষ্ণ হতে থাকা পৃথিবীতে খাদ্যের জোগান দিতে পারে গমের এমন যুগান্তকারী জিন আবিষ্কার
গম উদ্ভিদই বদলে দিয়েছে মানব সভ্যতাকে। এটি চাষাবাদের সুবাদে আমাদের হোমোসেপিয়ান প্রজাতি নিজেদের বর্ধিত সংখ্যার জন্য খাদ্যের জোগান দিতে পেরেছি। আর প্রাথমিক কৃষির হাত ধরেই শিকারী ও খাদ্য সংগ্রাহক গোত্র থেকে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা সভ্যতার দিকে আসতে থাকে। তাই বলা যায়, গম আমাদের অসহায় অবস্থা থেকে পৃথিবীকে শাসন করার মতো উন্নত হওয়ার শক্তিও দিয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের
আদিতে মধ্যপ্রাচ্যে তৃণজাতীয় উদ্ভিদ ছিল গম গাছ, যা পাওয়া যেত নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়। কালক্রমে সেই উদ্ভিদ আজ বিশ্বের বিপুল অংশের কৃষিজমির প্রধান ফসল হয়ে উঠেছে। যেমনটা উঠে এসেছে ঐতিহাসিক ইয়োভাল নোয়াহ হারিরির পর্যবেক্ষণে। তিনি লিখেছেন, '১০ হাজার বছর আগেও উত্তর আমেরিকার সুবিস্তৃত সমভূমিতে একটিও গম উদ্ভিদের গোছা দেখা যেত না। আজ সেখানকার চাষবাসের এলাকায় আপনি শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিলেও গম ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদই চোখে পড়বে না'।
বর্তমানে মানবজাতি দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করে, তার ২০ শতাংশের যোগান দেয় গম। অথচ মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবেই গুরুতর হুমকির মধ্যে রয়েছে এর উৎপাদন। পৃথিবী উষ্ণতর হতে থাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে তীব্র তাপদাহের সংখ্যা। ঘন ঘন খরা ও দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবাদ। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করছে।
খাদ্য উৎপাদনের এই মহাসংকটকালে আশার আলো দেখাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের নরউইচ-ভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় একটি শস্য গবেষণা সংস্থা- জন ইনস সেন্টারের গবেষকরা। তারা এমন এক গবেষণা প্রকল্পে জড়িত, যার সফলতা উষ্ণ পৃথিবীতে গমের আবাদকে সম্ভব করে তুলবে। আর সে লক্ষ্যেই গম উদ্ভিদকে আরও তাপ ও খরা সহনীয় করে তুলতে চান তারা।
খুব একটা সহজ নয় এ ধরনের প্রচেষ্টাগুলো। তবুও তারা হাল ছাড়ার পাত্র নন। এজন্য তারা উদ্ভিদের জিন-সম্পাদনা (জিন- এডিটিং) প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে বেশকিছু নতুন জাতও তারা উদ্ভাবন করেছেন। পরীক্ষামূলকভাবে অচিরেই যেগুলো স্পেনে রোপণ করা হবে।
এসব জাত আইবেরিয়া অঞ্চলের খরতাপ সহ্যে কতখানি সক্ষম হয়- তার ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাব থেকে কৃষিজমিতে গমের ফলনকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে পারবেন। একইসঙ্গে, পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করাও যাবে বলে জানিয়েছে জন ইনস সেন্টার।
গম মানব সভ্যতার কৃষি বিপ্লবকে বেগমান করার একমাত্র উদ্ভিজ্জ এজেন্ট নয়, এক্ষেত্রে আলু ও ধানের মতো প্রধান শস্যেরও আছে বিশাল অবদান। তবে 'জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অভিজাত সম্প্রদায়' তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কৃতিত্ব সাধারণত গমকেই দেওয়া হয় বলে তার বেস্টসেলার বই সেপিয়েন্সে লিখেছেন হারিরি।
গমের জিন বিশেষজ্ঞ ও জন ইনস সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক গ্রাহাম মুর বলেন, কৃষিজমিতে প্রধানত দুই ধরনের গম উৎপাদিত হয়, পাস্তার গম এবং রুটির গম। উভয়ে মিলে বিশ্বের প্রায় ৪৫০ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে কেন্দ্রীয় অবদান রাখে। "প্রায় ৮৯টি দেশের ২৫০ কোটি মানুষ তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের জন্য গমের ওপর নির্ভরশীল, ফলে এটি বিশ্বের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ফসল- সেটা বুঝতেই পারছেন'।
কিন্তু, গমের বিভিন্ন জাতের প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্যের ক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চাওয়া শস্য বিজ্ঞানীদের প্রধান সমস্যা হলো– এর জিনগত জটিলতা। ব্যাখ্যা করে মুর বলেন, 'মানুষের আছে ডিএনএ নির্দেশনাবাহী একক জেনোম, সে তুলনায় বংশগত উৎপত্তির দিক থেকে পাস্তা গমের জেনোম দুইটি, আর রুটির গমের তিনটি'।
এই জটিলতার ফলে গুরুত্বপূর্ণ এক পরিণতি লাভ করেছে গম শস্য। নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের জিন ও ক্রোমোজোম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গম উদ্ভিদের দেহে এক ধরনের স্থিতিস্থাপক জিন তৈরি হয়েছে। এটি বিভিন্ন জেনোমের ক্রোমোজোমগুলোর মধ্যে ব্যবধান তৈরি করে। ফলে এ কাজে গমের যে জাতগুলো বেশি সফল, তাদের ফলনও ততোটাই বেশি। একইসঙ্গে, জিনগত এই বৈশিষ্ট্য গমের বন্য জাতের সাথেও ক্রোমোজোম বিনিময়ের সম্ভাবনাকে দমন করে। ঠিক একারণেই উপকারী গুণসমৃদ্ধ গমের নতুন জাত তৈরির জন্য জিন বিজ্ঞানীদের অনেক প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
মুর ব্যাখ্যা করে বলেন, 'গমের বন্য জ্ঞাতিগুলোর অনেক ধরনের উপকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন তাদের কেউ কেউ অধিক রোগবালাই সহনশীল, কেউবা লবণাক্ততা ও উচ্চ তাপ সহনশীল। এসব গুণ যোগ করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকবে এমন অদম্য জাত তৈরি করাটাই বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য। তবে গমের জিনগত প্রতিরোধ এসব গুণাবলী যোগ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়'।
পার্থক্য/প্রতিরোধকারী এই জিনটি গমের জিন বিশেষজ্ঞদের কাছে 'হোলি গ্রেইল' (কিংবদন্তীর কোনো আরাধ্য বস্তু) হিসেবেও পরিচিত। মুর বলেন, 'গম বিশ্বের খাদ্য সরবরাহে এক অপরিহার্য ফসল হয়ার পরও– জেনোমের আকার ও জটিলতার দিক থেকে এতে নতুন পরিবর্তন যোগ করার কাজটি প্রধান শস্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। একারণে আমরা এই পার্থক্যকারী জিনটি খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি।
আশার কথা হলো, একাজে কয়েক দশক লেগে গেলেও অবশেষে সফলতা পেয়েছেন জন ইনস সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। মৌলিক এই জিনটিকে তারা চিহ্নিত করেছেন। খুঁজে বের করেছেন গম জিনতত্ত্বের সেই 'হোলি গ্রেইল'।
তারা এর সাংকেতিক নাম দিয়েছেন জিপ৪.৫বি। শুধু তাই নয়, তৈরি করেছেন এর রুপান্তরিত সংস্করণ। এই মিউট্যান্ট সংস্করণ- গম উদ্ভিদের জিনকে মৌলিক কার্যাবলী চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, ভিন্ন ধরনের ক্রোমোজোমকে সঠিকভাবে জোড়বদ্ধ হতেও সহায়তা দেবে। এতে উচ্চ ফলনও বজায় থাকবে। একইসঙ্গে এটি বন্য ঘাস জাতীয় উদ্ভিদের গুণাবলীও যোগ করতে আর বাধা সৃষ্টি করবে না।
এই অসামান্য আবিষ্কার সম্পর্কে অধ্যাপক মুর বলেছেন, 'এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান কাজটি ছিল জিন-সম্পাদনা। এর মাধ্যমে আমরা গমের ডিএনএ-তে সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনতে সক্ষম হই। এই পদ্ধতি না থাকলে আমাদের আরো সংগ্রাম করতে হতো। জিন সম্পাদনার প্রযুক্তিই সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যে মূল পার্থক্যটি তৈরি করে'।
জন ইনসের বিজ্ঞানীরা এরপর থেকে জিপ৪.৫বি জিনের আরো অন্তত ৫০টি ধরন আবিষ্কার করেছেন। মুর জানান, তাদের উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলিতে এসব জিন প্রয়োগ করে পরীক্ষা চালাবেন তারা।
'স্পেনে কর্ডোভার কাছে জমিতে এগুলো রোপণ করা হবে। আমরা দেখব, জাতগুলো কতোটা সফল হয়। এর মাধ্যমে আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকবে, সবচেয়ে ভালোভাবে উচ্চ তাপ সহ্য করছে এমন জাতগুলোকে চিহ্নিত করা। কারণ, আগামী দশকগুলোতে আমাদের কৃষকদেরও এমন উচ্চ তাপ পরিস্থিতিতে চাষাবাদ করতে হবে'।
তিনি আশাপ্রকাশ করে বলেন, 'মানব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে গম। আশা করি, আমাদের এই প্রচেষ্টা আগামী দিনের খাদ্য উৎপাদনেও সেই গুরুত্বকে ধরে রাখবে'।