পরজীবীরা বিপন্ন, তারা হারিয়ে গেলেই তবে গুরুত্ব বুঝব আমরা!
পৃথিবী যত উষ্ণ হবে, ততই বাড়বাড়ন্ত হবে পতঙ্গদের, বাড়বে পরজীবীর সংখ্যা, ফলে বসুধা হয়ে উঠবে রোগব্যাধি ভরা এক গ্রহ। এই আশঙ্কাকে সমর্থন করার মতো যথেষ্ট উদাহরণ আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যেই বাড়ছে লাইম ডিজিজ ছড়ানো উকুনের সংখ্যা। ম্যালেরিয়া ও জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া মশাদেরও বাড়বাড়ন্ত। চাগাস ডিজিজ বিস্তারের জন্য দায়ী কিসিং বাগের উৎপাতও কমার লক্ষণ নেই। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এভাবে কিছু পরজীবী পতঙ্গের সংখ্যা বাড়লেও, এটা তাদের সবার ক্ষেত্রে এক নয়। এমনটাই জানাচ্ছে গত সোমবার প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত এক যুগান্তকারী গবেষণার নিবন্ধ।
বৈজ্ঞানিক এ অনুসন্ধানে ৮৫টি পরজীবী প্রজাতির বংশবিস্তার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গত ১৪০ বছরে এদের অধিকাংশের জনসংখ্যা কমেছে। এই সময়ে কিছু বন্যপ্রাণীর জনসংখ্যায় যে পতন দেখা গেছে, কিছু পরজীবী প্রজাতি একই হারে পতনের শিকার হয়েছে। আর কিছু পরজীবীর বংশবিস্তার এর চেয়েও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
গবেষণা নিবন্ধের একজন সহ-লেখক এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরজীবী প্রকৃতিবিজ্ঞানী চেলসিয়া উড বলেন, 'পাখি বা স্তন্যপায়ীদের মধ্যে এই ধরনের জনসংখ্যা পতন হলে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, তাদের সংরক্ষণের বিভিন্ন উদ্যোগও দেখা যায়।'
সে তুলনায় পরজীবীদের নিয়ে বিজ্ঞানী মহলের বাইরে খুব কম মানুষই চিন্তিত। অথচ এটি বেশ শঙ্কার ঘটনা। আর কোনোমতেই তাদের বিলুপ্তি মানুষের জন্য শুভ হবে না। যেমন পৃথিবীতে যত ধরনের জীবের প্রজাতি রয়েছে তার ৫০ শতাংশই হলো বিভিন্ন প্রকার পরজীবী। এরা নানান আকারের। তবে অধিকাংশই খালি চোখেও দেখা যায় না, এতটাই ক্ষুদ্র। এই প্রাণগুলো নিজ জীবনধারণে অন্য প্রাণীদেহে আশ্রয়ের ওপর নির্ভর করে। এমনকী নির্দিষ্ট কিছু ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস ও প্রোটোজোনাস-কেও পরজীবী শ্রেণিভুক্ত ধরা হয়।
চারপাশের এই বিচিত্র ধরনের পরজীবীর জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শুধু ক্ষতিকর পরজীবীদের নিয়েই আলোচনা হয়। যদিও পরজীবী প্রজাতিগুলোর মধ্যে এরাই সবচেয়ে সংখ্যালঘু।
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই জেনেছেন, আমাদের চারপাশে এমন লাখ লাখ প্রজাতির পরজীবী রয়েছে যারা আমাদের বা আমাদের পশুসম্পদের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই, বরং ভীষণ উপকারী। এই জীবেরা দলবদ্ধভাবে একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন কিছু পরজীবী বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, যে কাজটা শিকারি প্রাণীদেরও করতে দেখা যায়।
পরজীবীরা প্রাণীদের আচরণকেও প্রভাবিত করে। এভাবে তারা খাদ্যচক্রে শক্তির যোগান দেয়। যেমন বিভিন্ন প্রাণীর দেহে বাসকারী পরজীবীরা আশ্রয়দানকারী প্রাণীকে বেপরোয়া বা অসাবধান আচরণ করতে বাধ্য করে। এতে করে তাদের সহজেই ধরতে পারে শিকারি প্রাণীরা।
যেমন ক্যালিফোর্নিয়া কিলফিশ নামক একটি মাছের প্রজাতি ট্রেমাটোড ফ্লাটওয়ার্ম নামক পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলে, তাদের শিকারি প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ১০-৩০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
জাপানের নেমাটোমর্ফ ওয়ার্ম নামক পরজীবী বাসা বাঁধে ফড়িঙের দেহে। তারা প্রাণীগুলোকে বহমান স্রোতে ঝাঁপ দিতে প্ররোচিত করে। এভাবে বিপন্ন চার মাছের প্রজাতির ৬০ শতাংশ ক্যালোরির যোগান দেয় তারা। ড. উডের মতে, 'এভাবেই শিকারি প্রাণীরা পরজীবীদের সাহায্য পায়।' অর্থাৎ, তাদের অস্তিত্ব আর পরজীবীদের অস্তিত্ব একসূত্রে গাঁথা অনেকটাই।
জলবায়ু পরিবর্তন, আর সেকারণে বাস্তুসংস্থানের অন্যান্য পরিবর্তন কীভাবে পরজীবীদের প্রভাবিত করছে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন কেবল অনুমানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতেই চেলসিয়া উড এবং তার সহকর্মীরা ৬৯৯ প্রজাতির মাছকে নমুনা হিসেবে বেছে নেন। এসব মাছকে বার্কে মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টোরির বেজমেন্টে রাখা হয়েছিল। মাছগুলো ১৮৮০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন রাজ্যের পুগেট সাউন্ড নামক সামুদ্রিক খাঁড়ি থেকে ধরা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত এসব মাছ ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে পরজীবীর 'টাইম ক্যাপসুল'।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে ড. উড জানান, মাছগুলো ধরার পর ফরমালিন ও ইথানল দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এতে তাদের পাখনা, ত্বক, কানকো, আঁশে বাসকারী বিভিন্ন পোকা ও কীটও ঐ অবস্থাতে সংরক্ষিত হয়ে যায়। এমনকী তাদের মাংসপেশির ভেতরে বাসকারী পরজীবীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
সংরক্ষিত মাছের নমুনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ৮৫ প্রজাতির ১৭ হাজার ৭০২টি পরজীবী পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে ধরা মাছের দেহে পরজীবীদের সংখ্যা কেমন ছিল- এর মাধ্যমে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণায় জড়িত একজন বিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরজীবী প্রকৃতিবিদ স্কাইলার হপকিন্স বলেন, 'পৃথিবীতে এ ধরনের তথ্যভান্ডার আর দ্বিতীয়টি নেই। শুধু একবার কল্পনা করুন, প্রাচীন পিচ্ছিল এই মাছগুলোর দেহ ব্যবচ্ছেদে আমাদের কতটা সময় ও শ্রম দিতে হয়েছে।'
এই ১৪০ বছরের বেশি সময়ে মাছের প্রজাতিগুলোর বংশবৃদ্ধির ওঠানামা ও দূষণের মতো অন্যান্য প্রভাবক বিচার করে বিজ্ঞানীরা দেখেন, পানির প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ৩৮ শতাংশ করে পরজীবীর সংখ্যা পতন হয়েছে। কিছু প্রজাতি এক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতির শিকার হয়। যেমন জটিল জীবনচক্রের পরজীবীরা– যাদের ডিম পাড়া থেকে পূর্ণবয়স্ক পর্যন্ত হতে অন্তত চার থেকে পাঁচটি জলজ প্রাণীর দেহে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। এ ধরনের ৫২ শতাংশ পরজীবীর সংখ্যা প্রতি এক দশকে গড়ে ১১ শতাংশ হারে কমেছে। আর এই পরিবর্তন সাগরজলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
ড. উডের মতে, 'উষ্ণতা যত বেড়েছে, সেই সময়ে ধরা মাছের দেহে পরজীবীর সংখ্যাও ততোটাই কম লক্ষ করা গেছে।'
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরজীবী প্রকৃতিবিদ আর্মান্ড কুরিস বলেন, 'ড. উড ও তার সহকর্মীরা অসাধারণ এক ডেটাসেট নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের গবেষণা– পরজীবীদের সংখ্যা বৈচিত্র্য এবং তার পতন কীভাবে নির্ণয় করা যায়– তার এক অনবদ্য উদাহরণ স্থাপন করল। তবে একইসঙ্গে এটা বড় দুঃসংবাদও জানিয়েছে।'
গবেষণায় জড়িত ছিলেন না এমন আরেকজন রোগ বিশেষজ্ঞ কেভিন লাফার্তি বলেন, 'জটিল জীবনচক্রের পরজীবীরাই সবার আগে হারিয়ে যাবে- এমন ফলাফলটা প্রত্যাশিত, কারণ তাদের বাস্তুতন্ত্রও জটিল। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, অতিরিক্ত মৎস সম্পদ আহরণ ও অন্যান্য মানব সৃষ্ট চাপে প্রকৃতির সূক্ষ্ম ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এমন সাধারণ বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠছে যা তাদের জীবনচক্রকে সমর্থন করে না।'
ড. উড বলেছেন, আমাদের গবেষণার ফলাফল এটাই তুলে ধরেছে যে, পরজীবীদেরও সংরক্ষণের সময় এসেছে। 'গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুচক্রে তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে, কোনোদিন যদি তারা সবাই হারিয়ে যায়, হয়তো সেদিন আমরা তাদের গুরুত্বটা বুঝব।'