পেয়ারা মানেই এখন কাজী পেয়ারা! কে এই কাজী!
বেলা দেড়টার মতো বাজে, রাজধানীর সাতরাস্তা থেকে কারওয়ান বাজার যাওয়ার যে রাস্তা, সেখানে এক ভ্যানবোঝাই পেয়ারা নিয়ে বসে আছেন মো. মনির। বেশ বড়, ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারার পসরা তার ভ্যানে। কাজী পেয়ারা। সেখান থেকেই পেয়ারা কিনতে এসেছেন কাউসার। পাইকারি রেটে একবারে বেশ কয়েকটি কিনবেন, তাই কারওয়ান বাজারে হাজিরা। জানালেন, মায়ের ডায়াবেটিস, প্রেসার, ক্রিয়েটিনিন সবই বেশি। ফলমূল সবই খাওয়া মানা। আর আপেল খাওয়ার কথা শুনলেই তেলে-বেগুনে ক্ষেপে যান মা, তাই ভরসা কাজী পেয়ারাতেই। স্বাদেও বেশ ভালো। ফ্রিজে রেখে খেলে নষ্ট হওয়ার ভয় কম, অনেকদিন খাওয়া যায়। নিরাপত্তাকর্মীর ডিউটি শেষে, বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই তাই এ পথ থেকে কিনে নিয়ে যান পেয়ারা।
কিছুদূর যেতেই ঝাঁকা বোঝাই পেয়ারা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল ৪ পেয়ারা বিক্রেতাকে। তবে এরা দিনের বেলায় থাকেন না, রাত ১২টার পর থেকে শুরু হয় তাদের পেয়ারা বিক্রি। খুব জোর সকাল ৮টা। এরমধ্যেই তাদের পেয়ারা বিকিকিনির পর্ব সাড়া। চুয়াডাঙ্গা আর রাজশাহী থেকে ট্রাক ভরে ভরে আসে পেয়ারাগুলো। আর তারা ঝাঁকা ভরে কিনে নেন। 'ভাগ্য ভালো না থাকলে সেদিনগুলোয় সকাল পর্যন্ত থাকা লাগে,' পাইকারি বিক্রেতা রিপন জানালেন এ কথা। সেদিনের ব্যবসার ভাগ্যটা বেশ খারাপ। তবে একদিনের ব্যবসা মন্দা নিয়ে কারও চোখেমুখে ভাবনা নেই তেমন একটা। কেননা প্রতিদিনই ৮ থেকে ১০ মণ পেয়ারা বিক্রি করেন তারা। রিপনের মুখ থেকে জানলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বা যেকোনো স্কুল-কলেজের পাশে যেসব 'মামা'রা বসেন, তারাই একেকজন দিনে প্রায় মণখানেক পেয়ারা কিনে নেন। লবণ, মরিচের গুঁড়া আর একটু কাসুন্দি..দারুণ স্বাদের মাখানো এ পেয়ারাগুলোও কিন্তু কাজী পেয়ারাই।
কাজী পেয়ারার এই কাজী আসলে কে!
এই যে কাজী পেয়ারার এতো চাহিদা, এই পেয়ারার নাম কেন কাজীই হল, কিছুটা কৌতূহল থেকে এ নিয়ে এক ভিডিও সাক্ষাৎকার দেখছিলাম ইউটিউবে। কাজী পেয়ারার নামকরণ হয়েছে যার নামে, সেই বিজ্ঞানী কাজী এম বদরুদ্দোজার সাক্ষাৎকার! ৯৫ বছর বয়সী বিজ্ঞানী নিজেই জানাচ্ছিলেন, কাজী পেয়ারা উদ্ভাবন বা নামকরণ, কোনোকিছুর সঙ্গেই সম্পর্ক নেই তার।
তিনি বলছিলেন, 'কাজী পেয়ারার নামকরণ আমার নামে করা হয়েছে, কিন্তু আমি এটা করিওনি এবং আমি ওইসময় চাকরিও করতাম না, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে অবসর নিয়েছি। পেয়ারাটা যখন নতুন বের হলো, আমার যারা অনুসারী ছিলেন, আমার প্রতি ভালোবাসা থেকে নামটা দেয়। ওরা আমাকে খুব সম্মান করতো। এজন্য প্রথমদিকে ওদের সঙ্গে একটু রাগারাগিও করেছি। কিন্তু তাদের যুক্তি ছিল এরকম যে, ওরা আমার চাকরিতে থাকাকালে পড়াশোনা করেছে, বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছে, তাই আমার নামে নাম রাখার অধিকার আছে ওদের!'
তিনিই বলেন, আগে সবজি বা ফলের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হতো। দেশি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে তারা সবজি ও ফলের বিভিন্ন ধরনের জাত তৈরি করত। এভাবেই জাপান থেকে দুইজন বিজ্ঞানীকে আনা হয়। তারা এসে এখানকার স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন কাজী পেয়ারা। বরিশাল অঞ্চলের পেয়ারা যেহেতু ভালো জাতের, তাই জাপান থেকে আসা ওই বিজ্ঞানীরা বরিশালের পেয়ারা আর থাইল্যান্ডের থাই পেয়ারার মধ্যে এক করে তৈরি করেন হাইব্রিড ধরনের এ পেয়ারা। এর নাম দেওয়া হল কাজী পেয়ারা। আসলে বদরুদ্দোজার প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই তার নামে নাম রাখা।
তবে ড. বদরুদ্দোজার নাকি দারুণ পছন্দ এ পেয়ারা। একটু হেসে জানালেন, 'লোকে যে এ পেয়ারা খাওয়া ছাড়ে না, এটা আমার ভালোই লাগে। আমি বলি, আরও অনেক ভালো জাতের পেয়ারা আছে, বিচি কম, মিষ্টি বেশি। কিন্তু সবাই এ পেয়ারাটি বেশ পছন্দ করে। আমি নিজেও খাই এ পেয়ারা। তবে কাজী পেয়ারার স্বাদ আসলেই খুব ভালো, গুণে-মানে সবদিক থেকেই আপেলের তুলনায় ভালো। কত ধরনের জাত আসে আবার চলে যায়, কিন্তু পেয়ারাটি আসলে ভালো বলেই এতো বছর ধরে এখনও মানুষের পছন্দ।'
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), সাভারে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বাকৃবি ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ), ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা), বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এ বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠনেও কাজ করেন তিনি। ভিয়েতনামের ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক্স, পাকিস্তানের এরিড জোন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরিতেও ভূমিকা ছিল তার।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.সি করে ১৯৫৬ সালে আমেরিকার লুইজিয়ানা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অনুমোদনে এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে একজন রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ লাভ করেন তিনি।
দেশে আধুনিক জাতের গম উদ্ভাবন ও চাষ শুরু করেন কাজী এম বদরুদ্দোজা, এমনকি ভুট্টার বাণিজ্যিক আবাদও তার মাধ্যমে শুরু হয়। ভুট্টা থেকে তেল উদ্ভাবন এবং তা পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার শুরুর ধারণাটিও তারই ছিল। ২০১২ সালে এসব অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান 'স্বাধীনতা পুরস্কার' পান এই বিজ্ঞানী।
এতো অবদান যার, তার নামে নতুন উদ্ভাবিত পেয়ারার নাম রাখাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়!
কিন্তু দেশি পেয়ারা গেল কই!
নজরুলের খুকি ও কাঠবেড়ালি কবিতার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? একটুখানি পাকা পেয়ারার জন্য কাঠবেড়ালির কাছে ছোট্ট খুকির কতই না কাকুতি মিনতি।
কিন্তু খুকির যে পেয়ারা পছন্দ তা কাজী পেয়ারা নয়। ফলের দোকান, রাস্তাঘাট কি ভ্যান সবজায়গাতেই এখন বড়সড় আকৃতির টসটসে কাজী পেয়ারার আধিপত্য চোখে পড়ার মতো!
তাহলে দেশি পেয়ারাগুলো গেল কই! এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আবার ফিরে গেলাম কারওয়ান বাজারে। সত্তরোর্ধ্ব পেয়ারা বিক্রেতা আসাদুজ্জামানের কাছে জানা গেল, বর্ষাকাল ছাড়া পাওয়াই যায় না দেশি পেয়ারা, তাই তাদের ভরসাও সারাবছর সহজলভ্য কাজী পেয়ারাতেই।
তার কথার প্রমাণ মিলল আরেক পেয়ারা বিক্রেতা রিপনের কথাতেও। তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিন রাত ১২টার পর থেকেই কারওয়ান বাজারে আড়ৎ বেশ জমে যায়। সেখান থেকে পাইকারি রেটে পেয়ারা কিনে নেন। প্রতি ভ্যান শেষ হতে খুব বেশিদিনও লাগে না। চাহিদা বেশ ভালো।
জানা গেল, খুচরা এক কেজি, দুই কেজি কেনেন এমন ক্রেতাও আছে, আবার এমনিতেই ভ্যানে ফল মাখিয়ে বিক্রি করেন, এমন বিক্রেতার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। স্কুল-কলেজ কি বিশ্ববিদ্যালয়..যেখানেই বসুক প্রতিদিনই শেষ হয়ে যায় পেয়ারা। তিনটা পেয়ারাতেই প্রায় কেজিখানেক হয়ে যায়।
'খুচরা ১০-২০ টাকায় পাওয়া যায়, পেট ভরে সহজে', হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে থেকে পেয়ারা কিনে খাওয়ার সময় বলছিলেন রিকশাচালক মহিউদ্দিন। তার ভাষ্য, 'আপেল বা অন্য ফলের বাজারে আগুন। তাই এভাবেই ১০/২০ টাকায় পেয়ারা কিনে খান তিনি।'
তাই বলে, দেশি পেয়ারার স্বাদ যে আলাদা, একথা অস্বীকার করবে না কেউ। ছোট ছোট আকৃতির পেয়ারাগুলো কাঁচা অবস্থায় খেতে কিছুটা কষ কষ। তবে পরিপক্ব হলে খেতে খুবই সুস্বাদু। ইস্কাটন গার্ডেন রোডে নৌবাহিনী অফিসার্স কোয়ার্টারের সামনে ফল নিয়ে বসেন হাবিব মুন্সি। কথা হচ্ছিল ১০ বছর ধরে ফলের ব্যবসা করা মুন্সির সঙ্গে। জানালেন, বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় দেশি পেয়ারার দেখা মেলে না। কিন্তু কাজী পেয়ারার দেখা পাওয়া যায় সারাবছরই। তাই এই পেয়ারাই পছন্দ তার।
তবে নব্বইয়ের দশকের আগেও এতো দেখা যায়নি কাজী পেয়ারা। একে তো স্বাদে ভালো, আবার বেশ সহজলভ্য আর সারাবছর পাওয়া যায়, সবমিলে কাজী পেয়ারার দোর্দন্ড প্রতাপ। কৃষিসমৃদ্ধ সরকারি তথ্য ওয়েবসাইট 'কৃষি বাতায়নের' পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতি হেক্টরে ২৮ টন কাজী পেয়ারা উৎপাদন সম্ভব। সাধারণত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এ পেয়ারা খাওয়ার উপযোগী হলেও পাওয়া যায় প্রায় সারাবছরই।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সদরুল আমিনের মতে, ৩ বছর বয়সী একটি গাছে গড়ে ১২৫ কেজি পর্যন্ত কাজী পেয়ারা হয়!
পুষ্টিতে ভরা কাজী পেয়ারা
সবধরনের মানুষই পেয়ারা খেতে পারে। তাই প্রতিদিন একটা করে পেয়ারা খাওয়া ভালো। খাবারের সঙ্গে যদি কেউ সালাদের মতো করে পেয়ারা খায়, তবে ওই খাবারের আয়রন উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে যায়। কারো অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা থাকলে সেক্ষেত্রে তারা উপকৃত হবেন। এভাবেই পেয়ারা নিয়ে বলছিলেন বারডেমের ডায়েট এন্ড নিউট্রিশন বিভাগের প্রধান শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া। তার মতে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ভিটামিন সি। পেয়ারায় আপেলের তুলনায় তিনগুণ ভিটামিন সি থাকে। শুধু কাজী নয়, সব পেয়ারাতে একই পুষ্টিগুণ। অর্থাৎ ৩টি আপেলে যে পরিমাণ পুষ্টিগুণ থাকে, তার সমান পুষ্টিগুণ একটি পেয়ারাতেই পাওয়া সম্ভব। পেয়ারা কাঁচা, পাকা দুইভাবেই খাওয়া যায়। ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কাঁচা পেয়ারা খুবই উপকারী।
প্রতিদিন একটি করে কাঁচা পেয়ারা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখবে বলেও জানালেন এ পুষ্টিবিদ।
পেয়ারায় প্রোটিন, স্নেহ, কার্বোহাইড্রেট, আয়রন থেকে শুরু করে সবধরনের পুষ্টিই থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে ভিটামিন সি আর এ। একটি পেয়ারা থেকে ২১১ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়। পেয়ারায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরের কোথাও কেটে গেলে ক্ষতস্থান শুকাতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ভালো ভূমিকা রাখে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের জন্য পেয়ারা খুব ভালো কাজ করে। বিশেষ করে প্রোস্টেট ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে পেয়ারা খুবই উপকারী বলে জানালেন তিনি।
যদিও যাদের অ্যাসিডিটি বা আলসার রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যেহেতু পেয়ারায় অনেক বেশি ফাইবার, তাই কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের জন্যও পেয়ারা না খাওয়াই ভালো, এমনটি জানালেন ডা. মহুয়া।
দাম কেমন
ভরা পেয়ারার মৌসুমে দাম কিছুটা কম থাকে, তবে সারা বছরই পাওয়া যায় বলে দাম গড়পড়তা একই থাকে ফলটির। ৪০ থেকে ৮০ টাকার ভেতর সাধারণত কেজিপ্রতি দাম ওঠানামা করে। সাইজের ওপরও কিছুটা নির্ভর করে। বড় আকৃতির পেয়ারা হলে সাধারণত তিনটাতেই এক কেজি হয়ে যায়। পেয়ারাগুলোর আবাদ চুয়াডাঙ্গা আর রাজশাহী। তবে দেশি পেয়ারা সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর আর ঝালকাঠি জেলায় পাওয়া যায় এসব পেয়ারা। বর্ষাকালে জমে ওঠে পেয়ারার হাট।
তথ্যসূত্র:
- 'এগ্রিকালচার 360' এর youtube channel, 'যার সম্মানে হয়েছিলো কাজী পেয়ারার নাম!'