রাজশাহীর পদ্মার চরে পেয়ারা চাষে সফল তরুণ উদ্যোক্তা শাহাদাত
রাজশাহীর পদ্মার চরে এককভাবে প্রথম পেয়ারা চাষ করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা শাহাদাত হোসাঈন। তার দেখানো পথে এখন অনেক কৃষকই বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষে এগিয়ে আসছেন। ফলে পদ্মার চরে জমি ইজারা নেওয়ার দামও বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে লাভবান হচ্ছেন চরাঞ্চলের মানুষরা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চর নওশারা এলাকায় ২৮.৫ বিঘা জমিতে পেয়ারা বাগান গড়ে তুলেছেন শাহাদাত হোসাঈন। ২০১৮ সালে পেয়ারা গাছ লাগানোর হিসেবে তিন বছর ধরে তিনি সেখান থেকে পেয়ারা উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন। এর মধ্যে একবছর গেছে খরচের টাকা তুলতে আর এক বছর করোনার কারণে পেয়ারার দাম না পাওয়ায় তেমন লাভবান হতে পারেন নি। তবে দ্বিতীয় বছরে বিঘাপ্রতি খরচ বাদ দিয়ে তার ১ লাখ টাকা আয় করেছেন। সে হিসেবে তার ২৮ বিঘা জমিতে ২৮ লাখ টাকা আয় হয়েছে। এবছর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় তার তিন গুণ লাভ হবে বলে আশা করছেন শাহাদাত হোসাঈন। এছাড়া চরাঞ্চলের মাটি বেলে-দোঁআশ মাটি হওয়ায় গাছের স্থায়িত্বও বেড়ে গেছে। শুকনো অঞ্চলে যেখানে একবার গাছ লাগালে তিন বছরের বেশি টিকতো না সেখানে চরাঞ্চলে পাঁচ ধরেও বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ তিন বছর পার হয়ে গেলেও গাছ মরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
সাধারণত চাষীরা পেয়ারা গাছ একটু বড় হওয়ার পর তাতে ফুল ধরতে দেন। এর আগে ফুল এলে গাছকে বাড়তে দেওয়ার জন্য ফুল ভেঙে দেওয়া হয়। তবে সাতমাস পর থেকেই গাছে ফুল আসে। ফুল আসার ছয় মাস পর থেকেই পেয়ারা বিক্রি করা যায়। অর্থাৎ গাছ লাগানোর ১৩ মাস পর বাগান থেকে পেয়ারা বিক্রি করা যায়।
শাহাদাত হোসাঈন জানান, চরে পেয়ারা গাছ লাগানোর দুই মাস পর গাছে ফুল এসেছে। কিন্তু তখন গাছকে বাড়তে দেওয়ার জন্য সেই ফুলগুলো ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর গাছ একটু বড় হওয়ার পর সাত মাস পর ফুল আসে। ছয় মাস পর থেকেই পেয়ারা বিক্রি করা যায়।
তিনি জানান, আমরা যখন চরাঞ্চলের এইসব জমি লিজ নিয়েছি তখন প্রতি বিঘা ইজারা খরচ ছিলো ৮-১০ হাজার টাকা। আমরা এসে বিঘাপ্রতি প্রতিবছরের জন্য ইজারা নিলাম ১৫ হাজার টাকা।
২৮ বিঘা জমি পাঁচবছরের জন্য লিজ নেওয়া হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবছরের জন্য ইজারা বাবদ ১৫ হাজার টাকা হিসেবে একবছরে ইজারা খরচ দিতে হবে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। ব্যাগিং,কীটনাশক, সেচ ও লেবার খরচ দিয়ে সবমিলিয়ে প্রথম বছর খরচ হয় ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা। প্রথম বছরই বাগান থেকে পেয়ারা বিক্রি করে খরচ উঠে গেছে। দ্বিতীয় বছর সব খরচ বাদে প্রতি বিঘা থেকে ১ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি হয়েছে। সে হিসেবে ২৮ বিঘা জমিতে পেয়ারা বিক্রি করে তার ২৮ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। গত বছর করোনার কারণে পেয়ারা বিক্রি করে লাভ করতে পারেননি। যেখানে কেজি প্রতি পেয়ারা উৎপাদনে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। সেখানে করোনার কারণে কেজিপ্রতি পেয়ারা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা করে। তবে এ বছর গাছে হরমোন পদ্ধতি ব্যবহার করায় তিনগুণ পেয়ারা উৎপাদন বেড়ে গেছে। আশা করছি সব খরচ বাদ দিয়ে এ বছর ৫০ লাখ টাকা লাভ থাকবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, হরমোন সরকার অনুমোদিত এক ধরনের মেডিসিন যা গাছের গোড়ায় খুঁড়ে দিতে হয়। আবার কলমের কারণে সারাবছরই পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে। একই গাছ থেকে ফুল যেমন আসছে, গুটি পেয়ারা যেমন আসছে আবার বড় পেয়ারা ব্যাগিংও করা হচ্ছে। ব্যাগিং করেই সব পেয়ারা বিক্রি করা হয়। এখন এজন্য সারাবছরই পেয়ারা পাওয়া যায়।
শাহাদাত হোসাঈনের চরাঞ্চলের এই ২৮ বিঘা জমিতে পেয়ারা ছাড়াও গোডাগাড়ীতে বরেন্দ্রের উঁচু জমিতে আরো ৪০ বিঘার পেয়ারা বাগান আছে। অর্থাৎ তার মোট ৭০ বিঘার পেয়ারা বাগান। এর আগে তার গোদাগাড়ীর বরেন্দ্রের উঁচু জমিতে ১০৫ বিঘার পেয়ারা বাগান ছিলো। কিন্তু সেই বাগানে সাড়ে তিনবছরের পর সব গাছ মরে যায়। চরাঞ্চলের পেয়ারা বাগানে ব্যাগিংয়ের কারণে ১৫টি গাছ এখন পর্যন্ত মারা গেছে। সে হিসেবে তার সব গাছই এখনো তাজা রয়েছে। এজন্য শাহাদাত হোসাঈন মনে করেন, পাকা জমির চেয়ে চরাঞ্চলের জমিতে পেয়ারা গাছের স্বায়িত্ব বেশি।
তিনি বলেন, 'যেহেতু এখন পর্যন্ত সব পেয়ারা গাছই তাজা রয়েছে। সেখান থেকে ধারণা করছি এই পেয়ারা গাছ আরও কয়েকবছর জীবন্ত থাকবে। ফল দিবে।'
তিনি বলেন, বাগান থেকে পেয়ারা ভাঙার পর বাগানেই সর্টিং ও প্যাকেজিং করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে পেয়ারা পাঠানো হয় বিক্রির জন্য। তবে ঢাকাতেই বেশি পেয়ারা যায়। এছাড়া রাজশাহীর খড়খড়ি পাইকারি বাজারেও প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মণ পেয়ারা বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
শাহাদাত হোসোঈনের বাড়ি রাজশাহীর তানোরের তেলুপাড়া গ্রামে। এখন থাকেন রাজশাহী শহরে। তবে তার কর্মক্ষেত্র গোদাগাড়ীতে। শাহাদাত হোসোঈন রাজশাহী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। এরপর ঢাকার একটি আইটি ফার্মে তিনি দুইবছর চাকরি করেন। তখন থেকেই তার মাথায় কাজ করতো, নিজের মেধা নিজের জন্য খরচ করবেন। অন্য কোনো কোম্পানির পিছনে ব্যয় করবেন না। সেই ভাবনা থেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে তিনি গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন। তারপর তাদের পরামর্শে ১০ বছর আগে পেয়ারা চাষ শুরু করেন। পেয়ারা চাষ ছাড়াও তার ১০ বিঘা জমিতে বরই-কুল ও ২২ বিঘা জমিতে চায়না থ্রি জাতের লেবু চাষ করেন। ফল চাষ করে দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছেন বলে মনে করেন শাহাদাত হোসাঈন।
শাহাদাত হোসেন জানান, কুল-বরইয়ে প্রতিবছর জমির খাজনাসহ বিঘাপ্রতি ৫০ হাজার টাকার বিক্রি হয়। ১০ বছরের জন্য জমিগুলো ইজারা নেওয়া আছে। সেহিসেবে বছরে কুল-বরই বিক্রি হয় বছরে ৫ লাখ টাকার। কুল-বরই মৌসুমভিত্তিক উৎপাদন করা হয়। এছাড়া চায়না থ্রি জাতের লেবুর চাষ থেকে প্রতি বিঘায় বছরে ২ লাখ টাকা করে আয় হয়। অর্থাৎ ২২ বিঘা জমিতে বছরে ৪৪ লাখ টাকা আয় হয়। প্রতিবছরে বিঘা প্রতি জমির ইজারা মূল্য ১০ হাজার টাকা। চায়না থ্রি জাতের লেবু সারাবছরই বাজারে বিক্রি করা যায়।
তিনি বলেন, 'দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণের সাথে সাথে ভালো উপার্জনও করছি। সবমিলিয়ে ভালো আছি'। সব শিক্ষিত যুবকদের তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানান। নিজের মেধা খাটিয়ে নিজের উন্নয়ন করার পরামর্শ দেন। তিনি মনে করেন, সবাই যদি নিজের মেধা দিয়ে নিজের উন্নয়নে এগিয়ে আসেন তাহলে দেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, রাজশাহীতে সারাবছর পেয়ারা চাষ হয়। রাজশাহীতে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। মৌসুমে প্রতি হেক্টর জমিতে পেয়ারা উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৫৫ মেট্রিক টন। আর অমৌসুমে পেয়ারা উৎপাদন হয় হেক্টর প্রতি ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিক টন। যেহেতু অমৌসুমেই চাষীরা পেয়ারা চাষ করেন সেহিসেবে বছরে চাষীরা ১ লাখ ২০ মেট্রিক টন পেয়াারা উৎপাদন করে। তবে চাষীরা সাধারণত অমৌসুমেই পেয়ারা উৎপাদন করেন। কারণ তখন উৎপাদন কম হলেও পেয়ারার দাম বেশি পাওয়া যায়।
পেয়ারা ইচ্ছা ফসল। অর্থাৎ ইচ্ছামতোন বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে যেকোনো সময় পেয়ারা উৎপাদন করা যায়। দাম সাধারণ ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে। পেয়ারা মার্কেটিং করার সময় চাষীরা লক্ষ্য করেন কখন এর বাজারে চাহিদা বেশি আছে। বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে পেয়ারা উৎপাদন করে চাষীরা। পেয়ারা শ্রমঘন ফসল হওয়ায় কৃষি শ্রমিকরাও সারাবছর কাজ করতে পারে। সারাবছর পেয়ারা বাগানে কাজ করে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবেই চাষীরা পেয়ারা চাষ করেন। তা না হলে কেউ লাভবান হতে পারবে না। শখের বশে পেয়ারা চাষ করে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পেয়ারা চাষ করতে হলে এর আদ্যপান্ত জানতে হয়। কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিতে হয় ও সফল চাষীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল জানান, 'পেয়ারা আম বা লিচুর মতো মৌসুমী ফসল না। সেচ, সার, কীটনাশক ও গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করে বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে ইচ্ছামতোন পেয়ারা উৎপাদন করে মার্কেটিং করা যায়। বাজারে যখন কুল-বরই বা অন্য ফল থাকে চাষীরা কিন্তু তখন পেয়ারা মার্কেটিং করে না। অন্য ফল যখন থাকে সেই সময়কে লক্ষ্য করে তারা বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে পেয়ারার চাষ করে। এজন্য মৌসুমি পেয়ারা লাটিম আকৃতি হওয়ার পর তারা তা ভেঙে দেয়। যাতে যখন অন্য ফল বাজারে থাকে না তখন পেয়ারা বিক্রি করা যায়। সাধারণ ফুল আসার পাঁচ মাস পর পেয়ারা হার্ভেস্ট করা যায়'।
আব্দুল আউয়াল জানান, 'আম মধুর ফল হওয়া সত্ত্বেও আমের চেয়ে পেয়ারার দাম বেশি হয়। এ বছর ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরেও আম বিক্রি হয়েছে। অথচ পেয়ারা ৪০ টাকা দামের নিচে কখনো বিক্রি হয় না। কখনো কখনো তা ১০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হয়। এছাড়া পেয়ারা একটা নিখাদ স্বাস্থ্যকর ফল। পেয়ারা হার্ভেস্ট করার দুই মাস আগে ব্যাগিং করে দেওয়া হয় বলে পেয়ারাতে পোকামাকড় বা পাখি বসতে পারে না। এমনকি কীটনাশক ব্যবহার করলেও পেয়ারার কোনো ক্ষতি হয় না। ব্যাগিং করার কারণে পোকামাকড় বা পাখি আঁচড় কাটতে পাারে না বলে হার্ভেস্ট করার পরেই পেয়ারা কামড় দিয়ে খাওয়া যায়। আবার নিপাহ ভাইরাস বা ব্লাড ফ্লুরও কোনো আশঙ্কা থাকে না।'
চরাঞ্চলের পেয়ারা চাষের বিষয়ে আব্দুল আউয়াল বলেন, সাব-ট্রপিক্যাল অঞ্চল হওয়াতে রাজশাহীর পেয়ারা এমনিতেই সুস্বাদু। চরের পেয়ারা আরো সুস্বাদু। কারণ চরের মাটি ভার্জিন, অব্যবহৃত। চরের মাটিতে পুষ্টিগুণও বেশি। আবার পদ্মার পানি সেচ দেওয়াতে আরো সুস্বাদু হয়। তবে চর থেকে পেয়ারা হার্ভেস্ট করে তা বাজারজাত করা একটু কঠিন। কারণ চরে পেয়ারা হার্ভেস্ট করার প্যাকেটিং করার নৌকা পারাপার করতে হয়। তারপর নৌকা থেকে গাড়িতে উঠাতে হয়। কয়েক দফা উঠানামা করতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। তারপরও শাহাদাতের মতো স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তারা পেয়ারা চাষ করছেন। এটা ভালো উদ্যোগ।'