বিশ্বের প্রাচীনতম বিলাসবহুল সুগন্ধীর ফিরে আসা
দুই বছর আগে, সুগন্ধী প্রস্তুতকারক সেসিল জারোকিয়ান এক অদ্ভুত ধরনের অনুরোধ পান। অনুরোধটি এসেছে ওমানের এক বিলাসবহুল সুগন্ধী প্রস্তুতকারক কোম্পানি আমুয়েজের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর রেনোঁ স্যামনের কাছ থেকে। তিনি যে অনুরোধ করেছেন তা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতোই। তেলভিত্তিক সুগন্ধী আতরের এমন এক ধরন পুনরায় তৈরি করা, যা এর আগে কেবল ওমানের লোকেরাই আইন অনুযায়ী কিনতে পারতো।
চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন জারোকিয়ান। সেটি করার জন্য তাকে এমনভাবে মার্কেট রিসার্চ করতে হয়, যেটি অনলাইনে করা সম্ভব নয়। তিনি জানান: "সম্পূর্ণভাবে তেল ব্যবহার করেই সুগন্ধী প্রস্তুত করা আমার জন্য একেবারেই নতুন ছিল এবং বড় চ্যালেঞ্জও বটে। আমি ওমানের অনেক বাজার ঘুরে দেখি, স্থানীয় সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলি। প্রত্যেকটি গন্ধের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আলাদা আলাদা রাফনেস, টেক্সচার, ডেপথ রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করেই আমার ফর্মুলা তৈরির কাজ শুরু করতে হয়েছে । এগুলো ছাড়া আমি একেবারে আসল আতরের মধ্যে নিজের আত্মাকে হারিয়ে ফেলতাম।"
বিভিন্ন দ্রব্য মিশিয়ে আতর তৈরি করা কোনো খেয়ালমাফিক বিষয় নয়। সুগন্ধী প্রস্তুত করার জ্ঞান বিগত ৬০ হাজার বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে আসছে এবং এই প্রক্রিয়ার বিবর্তনও ঘটেছে।
আতর প্রস্তুতকারী কে তার ওপর আতরের মান নির্ভর করে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গোলাপের নির্যাস থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের বিলাসী সুগন্ধ দ্রব্য, প্রত্যেকটি সুগন্ধী মিশ্রণের আলাদা আলাদা নিজস্ব মিশ্রণপদ্ধতি রয়েছে। প্রাচীনকালের ধর্মীয় আচার এবং রোগ সারানোর থেরাপিতেও আতর ব্যবহৃত হতো। হিন্দু সাধু এবং আত্মা খুঁজে বেড়ানো ঋষিরা ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য আতরের গন্ধের সাহায্য নিতেন। সুফি দরবেশদের সম্মোহনকারী নাচের সময়েও তারা আতর ব্যবহার করতেন।
আতর ব্যবহার সম্ভবত প্রথম শুরু হয় ডাক্তারদের মাধ্যমে। দ্রব্যগুলোর বৈশিষ্ট্য ও তাদের নিরাময়কারী গুণ অনুযায়ী আতরগুলো তৈরি করা হতো: জেসমিন এবং গোলাপের নির্যাস থেকে তৈরি ঠাণ্ডা আতর ব্যবহার করা হয় রোগীর জ্বর কমানোর জন্য অথবা গরম আবহাওয়ায় শরীর ঠান্ডা করার জন্য। অন্যদিকে জাফরান এবং উদ থেকে বানান গরম আতর তৈরি করা হতো শরীরের তাপমাত্রা গরম রাখার জন্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম আতর তৈরির উদ্দেশ্য ছিল রোগ নিরাময় করা, একইসাথে সেগুলো দেবতাদের উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করা হতো।
প্রাচীন উদ্ভিদ থেকে তেলীয় নির্যাস বের করে সেটিকে কিছুদিনের জন্য ফেলে রাখা হতো, বেশিরভাগ সময়েই এক্ষেত্রে চন্দনকাঠ ব্যবহৃত হতো। তবে আধুনিক সময়ের তুলনায় পুরো প্রক্রিয়া বেশ খানিকটা আলাদা। বর্তমানে আধুনিক পারফিউমগুলো তৈরি করা হয় অ্যালকোহল বা অন্য কোন দ্রবণের ওপর ভিত্তি করে, যেটি আতরের তুলনায় বেশ সস্তা এবং সহজলভ্য। আতরের প্রক্রিয়াকরণ করতেই এক থেকে দশ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
আতর প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে এটি একেকজনের চামড়ায় একেকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। আমাদের শরীরের উষ্ণতার সাথে বিক্রিয়া করে আতর তার সুগন্ধ বের করে। আতর একেবারেই সাধারণ হতে পারে। যেমন: চন্দনকাঠ আর গোলাপের নির্যাস থেকে পাওয়া গুলাব। আবার, শামামা আতরের মতো জটিলও হতে পারে, যেখানে ফুল, উদ্ভিজ্জ বস্তু, রেজিনসহ ৪০-এরও বেশি দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এরকমই একটি জনপ্রিয় আতর হলো মিট্টি আতর বা মাটির সুগন্ধী। উদ্ভিজ্জ দ্রব্য থেকে এই সুগন্ধী এমন এক ধরনের গন্ধ তৈরি করে যেরকমটি পাওয়া যায় বৃষ্টি মাটিতে পড়ার পর। পেট্রিকোর বা মাটির সুগন্ধ হিসেবে পরিচিতি পেলেও বর্তমানে এর অনেকগুলো সংস্করণ রয়েছে।
প্রথম আতর তৈরি করা শুরু হয়েছিল ভারতে, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে হলে উত্তর প্রদেশের কনৌজে, যেটিকে বলা হয় সুগন্ধীর সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর লেখায় এখানকার সুগন্ধী সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এরকম লোককথাও প্রচলিত রয়েছে যে, আউধ শহরের গভর্নর তার শোবার ঘরের চারপাশে আতর ছিটিয়ে রাখতেন। মুঘলদের সময়েও মুঘল রাজারা সবচেয়ে বিরল ও দামী আতরগুলো অতিথিদেরকে তাদের আতিথেয়তার প্রমাণ হিসেবে উপহার হিসেবে দিতেন। আতর তৈরির দ্রব্যগুলোর অসাধারণ গুণমান এবং যে প্রক্রিয়া পেরিয়ে এগুলোকে আতরে রূপান্তর করতে হতো, সে কারণে একে সহজেই তরল সোনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এর দামও হতো তার সুগন্ধ ও বিরলতার সাথে মানানসই। আতর এখন আরো বেশি দামী হয়ে উঠেছে, কারণ এটি যেগুলো থেকে প্রস্তুত করা হয়, সেই গাছগুলো আরো বিরল হয়ে উঠছে, বিশেষ করে চন্দন এবং বন্য উদগুলো।
প্রকৃতপক্ষে আমুয়েজ হয়ে উঠেছে হাতেগোনা সামান্য কিছু আন্তর্জাতিক মানের আতর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যারা আতর তৈরির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। ১৯৮০-এর দশকে ওমানের রাজপ্ররিবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিষ্ঠান গত বছর এক নতুন কালেকশন উন্মোচন করেছে। সেসিল জারোকিয়ানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমুয়েজের অন্যতম সেরা কিছু আতর উৎপাদন তৈরির জন্য। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন রুহ-গুলাবের আদলে তৈরি রোজ আকোর এবং পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মশলা কেসার থেকে তৈরি স্যাফ্রন হামরা।
আতরটি তৈরি করাও বেশ জটিল ছিল, যদি প্রস্তুত করার দিক থেকে দেখা হয়। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক মানের আতর তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কিছু কঠোর সুগন্ধী তৈরির নীতি মেনে চলতে হয়। জারোকিয়ান জানান, "আমি প্রাচীন সুগন্ধী তৈরির সংস্কৃতিকে সম্মান দেখিয়ে বর্তমান সময়ের সাথে মিলিয়ে একটি সুগন্ধী তৈরি করতে চেয়েছি। আমি জনগণকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি সুগন্ধীর আসল উৎসকে। স্যাফ্রন হামরা আতরটি তৈরি হয়েছে কেসার, জাফরান, গোলাপ আর কেড কাঠ দিয়ে। ওমানের সর্বোচ্চ চুড়ার গোড়ায় থাকা লালরঙা আল হামরা গ্রামের রঙ এবং নামের সাথে মিল রেখে এই আতর তৈরি করা হয়েছে। কেসার মশলার কারণে এর সুগন্ধ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।"
তো, এটি কি আতরের পুনর্জন্ম? তেলভিত্তিক সুগন্ধী তথা আতরের সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা নিশ্চিতভাবেই এর প্রাকৃতিক উপাদান এবং এর পেছনে থাকা শৈল্পিক শ্রমের কারণে হয়েছে। জারোকিয়ান জানান, "আতর বর্তমান সময়ের ট্রেন্ডের সাথে মিলে যায়। নিজের যত্ন নেওয়া এবং ভালো থাকার সাথে আতরের সামান্য কয়েক ফোঁটার মাধ্যমে পাওয়া গন্ধ মিলে যায়। তাছাড়া এর ঐতিহ্যগত ও ইতিহাসগত দিকও এর অকৃত্রিমতা এবং গোপন জ্ঞানের দিকে মানুষকে পরিচালিত করে। এর প্রাকৃতিক এবং অ্যালকহল মুক্ত বৈশিষ্ট্যও পরিষ্কার, পরিবেশের দিকে খেয়াল রেখে রূপচর্চা চালিয়ে যাওয়ার দিকে মনোযোগ বাড়ায়।"
সূত্র: এলপাইস