ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রংপুরে হাতির নিলাম, বাংলায় ব্রিটিশ অফিসারদের হাতি বাণিজ্য
ব্রিটিশদের আগমনের আগে সিলেট ও ঢাকার দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদারদের থেকে খাজনা ও বকেয়া পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে হাতি সংগ্রহ করত মোগলরা। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে এসে দেখতে পায় বিশালাকৃতির এই প্রাণী ভারতবর্ষে শুধু যুদ্ধে ব্যবহারের অন্যতম হাতিয়ারই নয়, অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। রাজকোষের একটি বড় অংশ আসতো হাতির বাণিজ্য থেকে। চীনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার্থেও ব্যবহৃত হতো হাতি। ধর্মীয় দিক থেকেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাণীটির অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশরা চাইলেই নিজেদের অনভিজ্ঞতার দরুণ পুরো ব্যবস্থাটি রাতারাতি বদলে দিতে পারত। তবে এর পরিবর্তে উপমহাদেশে হাতির সংস্কৃতিকে তারা শুধু গ্রহণই করলো না, সঙ্গে নিয়ে আসল নতুনত্ব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ হাতির বিচরণ ও শিকারের কেন্দ্রগুলোতে গড়ে উঠেছিল সরকারের খেদা বিভাগ। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইন প্রণয়নের আগেই সর্বপ্রথম ঔপনিবেশিক ভারতে প্রণীত হয় 'এলিফ্যান্ট প্রিজারভেশন অ্যাক্ট, ১৮৩৯'। এমনকি লর্ড মাউন্টব্যাটেন যিনি পরবর্তীতে শেষ ভাইসরয়ের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোতায়েন করা হয় তিন হাজারের বেশি হাতি।
একদিক থেকে দেখলে উপনিবেশবাদ শুধু মানুষ নয়, হাতির মতো বন্যপ্রাণীর ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। অনেক ব্রিটিশ অফিসার ব্যক্তিগতভাবে হাতি বিক্রির বাণিজ্য থেকে ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন। তবে হাতিকে ব্যবহারের ভিত্তিটা ছিল ভারতবর্ষের নিজস্ব। মোগল আমলে ভারতে হাতিদের একটি চিত্র পাওয়া যাবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শাহজাদা দারাশুকো' থেকে। সেখানে হাতির বর্ণনা অনেকটা এরকম, 'আসামের জঙ্গলে মোগল তোপখানার ভারি ভারি কামান বয়ে নিয়ে যেতে হাতির খুব দরকার। খুন্তাঘাটের কাছাকাছি বকির খান পাইকদের নিয়ে হাতি ধরছিলেন। কয়েকটা হাতি বন্দীও হয়। পাইকদের গাফিলতিতে কিছু হাতি পালিয়ে যায়। কিছু হাতিখেদা সর্দারকে বকির খান ফাঁসি দেন। তিনি হুকুম দিলেন, হয় পালিয়ে যাওয়া হাতিদের ধরে নিয়ে আসো, নয়তো হাতি পিছু হাজার রুপেয় দাও।'
বকির খান হাতিপিছু ক্ষতিপূরণ বেশিই ধরেছেন। এই অঞ্চলে একেকটা হাতির দাম তখন এত বেশি ছিল না। কোম্পানির আগে মোগলরা প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছর সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলের রাজা ও জমিদারদের থেকে রাজস্ব হিসেবে হাতি গ্রহণ করত। কোম্পানি আমলেও ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর কোম্পানির খাজনা হিসেবে রংপুরে হাতি পাঠাত সীমান্তবর্তী জমিদাররা। রংপুরের কালেক্টর নিলামে হাতি বিক্রি করে টাকাগুলো রাজকোষে জমা দিতেন। একেকটি হাতি খুব বেশি হলে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। ১৭৮৫ সালে হাতির বদলে টাকার মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হলেও, জমিদারদের সুবিধার্থে নিয়মে ফের শিথিলতা আনে বাংলার স্থানীয় সরকার। ১৭৯০ সালে নির্দেশ দেওয়া হয়, টাকা কিংবা হাতি দু'ভাবেই খাজনা দেওয়া যাবে।
খাজনার হাতি, রংপুরে নিলাম
ব্রিটিশ ভারতে হাতিদের নিয়ন্ত্রণে খেদা ডিপার্টমেন্ট চালু হওয়ার আগে বাংলা ও আশেপাশের অঞ্চলের হাতিদের পোষ মানানোর দায়িত্ব ছিল জমিদারদের অধীনে। সিলেট, আসাম, গোয়ালপাড়া ও ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকে ধরা হতো এসব হাতি। বার্ষিক খাজনা হিসেবে সীমান্তবর্তী জমিদাররা বেশি বেশি হাতি ধরে রাখতেন। সেখান থেকে এগুলো পাঠানো হতো কালেক্টরের কাছে। কিন্তু, এই হাতিদের মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০টি হাতি ধরা পড়লেও, রংপুর এসে পৌঁছাত মাত্র ৭ থেকে ৮টি হাতি। রংপুরে নিলামে হাতিগুলো বিক্রির পর সেই টাকা কোম্পানির কোষাগারে জমা দেওয়া হতো। নিলামে একেকটি হাতি বিক্রি করে গড়ে ৭০ টাকা পাওয়া যেত। এজন্যই হাতির পরিবর্তে পরবর্তীতে টাকার মাধ্যমে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করা হয়।
ব্রিটিশ ভারতে গোটা রংপুর জেলার আয়তন ছিল ৩,৭৮৮ বর্গ মাইল। রংপুরের উত্তরে জলপাইগুরি, উত্তর-পূর্বে কোচ বিহার, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদী, গোয়ালপাড়া (বর্তমানে আসামের অংশ) ও ময়মনসিংহ জেলা এবং পশ্চিমে ছিল দিনাজপুর জেলা।
এদিকে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে বিরাজমান বিজনি (বর্তমানে ভারতের আসামের অন্তর্ভুক্ত) ছিল এক স্বাধীন অঞ্চল। গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিজনি। ভূটানের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হতো এই অঞ্চলেই। ব্রিটিশ শাসনভুক্ত কিছু অঞ্চলও বিজনি রাজার আওতাধীন ছিল। আরেকটি স্বাধীন অঞ্চল ছিল বিদ্যাগঙ। বিজনী ও বিদ্যাগঙ আলাদা অঞ্চল হলেও আঠারো শতকের শুরুর দিকে অঞ্চল দুটোকে একত্রে ডাকা হতো ভূটান বিজনী। কোচ বিহারের সীমান্ত থেকে শুরু হতো এই অঞ্চল।
দূরবর্তী ও বনাঞ্চল হওয়ায় বিজনি ও বিদ্যাগঙ নিয়ে ব্রিটিশরা খুব বেশি ঘাটাতে যায়নি। বিজনির রাজাকে মোগল নিয়মমাফিক নিয়মিত কোম্পানির কাছে খাজনা জমা দিতে বলা হয়। রংপুর জেলার কালেক্টরকে দেওয়া হয় এই খাজনা সংগ্রহের দায়িত্ব।
বিজনি ও বিদ্যাগঙ থেকে একসময় রাঙামাটিতে খাজনা হিসেবে হাতি পাঠাতে হতো। তবে এই রাঙামাটি আমাদের চট্টগ্রামের রাঙামাটি নয়। রংপুরের কাছেই কোচবিহারের পূর্বে গোয়ালপাড়া জেলার একটি অঞ্চল ছিল রাঙামাটি। একসময় রাঙামাটি আলাদা জেলা থাকলেও, পরে তা গোয়ালপাড়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে হাতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আসে রংপুরে। তবে হাতিগুলো রাঙামাটি হয়েই পাঠানো হতো। রাঙামাটির কানুনগো এসব হাতি রংপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি তদারকি করতেন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ধরা হাতির হিসাব, মৃত্যুর হার, নিলামে বিক্রির দামের একটি খতিয়ান উঠে এসেছে ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার ফার্মিঙ্গার সংকলিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক রেকর্ডস রংপুরে (১৭৭০- ১৭৭৯)।
১৭৮৫ সালে হাতির বদলে টাকার মাধ্যমে বিজনী ও বিদ্যাগঙ থেকে খাজনা সংগ্রহের নির্দেশ দেয় কোম্পানি। হাতির মৃত্যুর হার বেশি হওয়ায় খাজনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে ব্রিটিশরা। হাতির পরিবর্তে দুই হাজার রুপি খাজনা নির্ধারণ করা হয়। ১৭৯০ সালে নতুন কালেক্টর এসে খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে ৩,০০০ রুপি নির্ধারণ করে। তবে সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা রাজাদের ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া রাজারা চাইলে হাতির মাধ্যমেও খাজনা প্রদান পুনরায় চালু করতে পারে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।
হাতির জন্য চীনা সম্রাটের উপহার রংপুরে
১৭৮৩ সালে কোম্পানির গভর্নর জেনারেল চীনা সম্রাটের তরফ থেকে বত্তিশহাজারির তালুকদারকে বেশ কিছু উপহার (বৈকুণ্ঠপুরের জমিদারকে) পৌঁছে দিতে রংপুরের কালেক্টরের কাছে একটি চিঠি পাঠান। চীনের সম্রাটকে উপহার হিসেবে হাতি পাঠিয়েছিলেন নেপালের রাজা। বৈকুণ্ঠপু্রের ওপর দিয়ে হাতিগুলো সম্রাটের কাছে পাঠাতে সাহায্য করেছিলেন স্থানীয় জমিদার। আর তাই উপহার হিসেবে চীনের সম্রাট তাকে ছয়টি চীনা পার্স, তিনখানা সাটিন কাপড় ও একটি মোজেজাহ পাঠান।
চীনে হাতি একরকম দুর্লভ। বহু আগেই তা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। আর তাই হাতির জন্য চীনা সম্রাটকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজ্যগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো। ১৭ শতকের শেষ অবধি মিং সাম্রাজ্যের সময় দক্ষিণ এশিয়ার রাজারা চীনের সম্রাটের কাছে নিয়মিত উপহারস্বরূপ হাতি পাঠাতেন।
বেঙ্গল ডিস্ট্রিক রেকর্ড অনুযায়ী, ১৮৭১ সালে সিয়াম রাজা (বর্তমান থাইল্যান্ড) চীনা সম্রাটকে পেকিনে উপহারস্বরূপ হাতি পাঠান। রাজার আগের হাতিগুলো মারা যাওয়ার নতুন হাতির আগমনে রাজ্যজুড়ে শুরু হয় উৎসব। রাস্তায় হাতির আগমনের বার্তা ঘোষণা করা হয়। গরীব ছেলেরা সিঁদুরে আঁকা হাতির অবয়ব কয়েক পয়সার বিনিময়ে হ্যান্ডবিল আকারে বিক্রি করেছিল।
তবে শুধু হাতি পাঠালেই তো হতো না। সঙ্গে সেসব হাতি দেখভাল ও পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ মাহুত, প্রশিক্ষক ও চালকও পাঠানো হতো। হাতি ব্যবস্থাপনার এই জ্ঞানগুলো ছিল অলিখিত। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের শুরু অবধি একচ্ছত্রভাবে ভারতীয়রা এই জ্ঞানের অধিকারী ছিল। বহিরাগত হিসেবে মোগল ও ব্রিটিশরাও এই জ্ঞানগুলো রপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল।
প্রাচ্যের অংশ হয়েও চীন তাদের হাতিকে প্রায় বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। চীনারা হাতিদের ভারতীয়দের মতো পবিত্র গণ্য করতো না। তাছাড়া তাদের প্রাচীন পুঁথিতে হাতির শুঁড় রান্নার কৌশলও মিলে। অর্থাৎ, স্রেফ খাওয়ার জন্যও হাতিশিকারের চল ছিল, যা ভারতের কোথাও দেখা যায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে সেক্ষেত্রে চীনাদের প্রায়ই বিপাকে পড়তে হতো। আর একারণেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল হাতি। এসব অঞ্চল থেকে উপহার পাওয়া হাতিদের ওপরই চীনা সম্রাটকে নির্ভর করতে হতো।
কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ঢাকার খেদা বিভাগ
উনিশ শতকের শুরুর দিকেই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ঢাকায় খেদা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারদের থেকে হাতি শিকার ও প্রশিক্ষণের পুরো ব্যবস্থাই কবজা করে ব্রিটিশ সরকার। আসামের মতো কিছু অঞ্চলে হাতি শিকারে সরকারের একচেটিয়া অধিকার ছিল। এর বাইরে কেউ হাতি শিকার করতে চাইলে, তাদের শিকারের জন্য জঙ্গলের বিভিন্ন মহল ইজারা হিসাবে দেওয়া হতো। শুরুর দিকে বাংলার কমিশনারেটের পরিষেবায় খেদা বিভাগ ইজারাদারদের মাধ্যমেই পরিচালিত হতো।
মোগল আমলের হাতি ধরার কৌশলকেই আরও উন্নত করে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। হাতি ধরার দুটি প্রধান কৌশল ছিল। এর একটি হলো খাবার ও শব্দ করে হাতিদের খেদা নামের ঘেরাওয়ের ভেতর নিয়ে আসা। আরেকটি কৌশল ছিল মাদী হাতিদের ব্যবহার করে জঙ্গলের পুরুষ হাতিদের প্রলুব্ধ করা।
খেদার আরেকটু বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া যাক। খেদাগুলো ছিল বিশাল এক ঘেরাও যার চারপাশে পরিখার মতো খাদ থাকত। ফলে হাতিগুলো একবার ঢুকে গেলে এগুলো পার করে বের হতে পারত না। এর বাইরে গাছের বড় বড় গুড়ির বেষ্টন থাকত। তবে পুরো বিষয়টি এত সহজ ছিল না। বন্য হাতির একেকটি পালকে নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ছয় থেকে আট হাজার লোক আগ্নেয়াস্ত্র, ড্রাম, ঢাক, পটকা নিয়ে তৈরি থাকত। হাতির পালকে ভয় দেখিয়ে খেদায় ঢুকানোই ছিল তাদের কাজ। টমাস উইলিয়ামসনের বই 'ওরিয়েন্টাল ফিল্ড স্পোর্টসে' মেলে এই বর্ণনা।
খেদার দায়িত্ব শুধু হাতি ধরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের প্রশিক্ষণ ও বিক্রির ক্ষেত্রেও একচেটিয়া অধিকার ছিল খেদার। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বার্মা থেকে কখনো পালতোলা জাহাজে আবার কখনো সড়কপথে হাতিগুলো ঢাকায় নিয়ে আসা হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। আর ব্রিটিশ সরকারের জন্য খেদা বিভাগ আর তেমন কোনো লাভও করতে পারছিল না। আর তাই ১৮৬২ সালের দিকে এক সময় এই বিভাগ বিলুপ্ত করা হয়।
তবে ১৮৬৬ সালের দিকে আবারও চালু হয় ঢাকার খেদা বিভাগের কার্যক্রম। এবার শিকারের অঞ্চল নির্ধারিত হয় গারো পাহাড় ও আসামে। ইউরোপীয়রা দেখে এখানে লাভ হচ্ছে বেশি। মৃত্যুহার কমাতে তারা নতুন সব উদ্যোগও গ্রহণ করে।
সাধারণত শীতকাল ছিল হাতি ধরার মৌসুম। স্থানীয় শিকারী ও কুকিদের (প্রশিক্ষিত মাদী হাতি) সাহায্যে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত হাতি ধরা হতো। এরপর মে মাসে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তাদের নিয়ে আসা হতো ঢাকায়। নভেম্বর পর্যন্ত পিলখানায় চলত হাতিদের প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষিত হাতিদের এরপর পাঠানো হতো ব্যারাকপুরে। সেখান থেকেই চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন জায়গায় হাতিদের বিলি-বন্টন করা হতো।
আসাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলগুলো ছাড়াও দক্ষিণ ভারত থেকে হাতি ধরা হতো। কর্ণাটকের মহিশুরে ছিল এই অঞ্চলের খেদা বিভাগ। মহিশুরের খেদা বিভাগ যথেষ্ট লাভজনক হলেও ঢাকার খেদা বিভাগ পরিচালনায় সরকারকে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাছাড়া খেদার কার্যক্রমে আসামের জঙ্গলে হাতির সংখ্যাও কমতে শুরু করেছিল। সিলেটের জঙ্গল থেকে একসঙ্গে ৪০টি, ৬০টি এমনকি ৮০টি হাতি একসঙ্গে ধরার ঘটনাও নথিভুক্ত আছে।
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসার পরেও হাতির বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছিল। ১৭৫০ সালে বর্তমান ফিলিপাইনের অন্তর্ভুক্ত মুসলিম সাম্রাজ্য সুলু'র রাজার কাছে হাতি সরবরাহ করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। জাহাজের মাধ্যমে হাতিগুলো পরিবহন করা হতো। কোম্পানির সমুদ্রপথে হাতি পরিবহন ও বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহারের আরেকটি দিক হলো এর ফলে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জঙ্গলেও হাতিরা বংশবিস্তারের সুযোগ পেয়েছিল। বিভিন্ন কাজে এখানে নিয়ে আসা হাতিদের থেকেই এরা বংশবিস্তার করে।
এছাড়া, সামরিক কাজে বিভিন্ন প্রান্তিক জনপদের আনুগত্য বজায় রাখতেও হাতিকে ব্যবহার করতো ব্রিটিশ অফিসাররা। যুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার হাতির ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভারতবর্ষ ও বার্মার তিন হাজারের বেশি হাতি যুদ্ধে মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। এছাড়া বনে গাছের গুঁড়ি উত্তোলন ও বহনেও হাতিদের ব্যবহার করা হতো।
বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যান্ডে প্রাণী সংরক্ষণ বা বিলুপ্তির হাত থেকে বিশেষ সব প্রজাতিকে রক্ষার আইনগুলো প্রণীত হতে থাকে। কিন্তু মজার বিষয় হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই হাতি শিকার ও গুলি করা একরকম বন্ধ হয়ে আসে। খাজনা হিসেবে হাতি গ্রহণের মোগল রীতি তো আগেই উঠে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে ১৮৭৩ সালে প্রথম মাদ্রাজে 'এলিফ্যান্ট প্রিজারভেশন অ্যাক্ট' পাস করে। ছয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পুরো ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় হাতি সংরক্ষণ আইন কার্যকর হয়। এই আইন অনুযায়ী, কেবলমাত্র আত্মরক্ষার্থে হাতিকে গুলি করার এখতিয়ার দেওয়া হয়। আসামের জঙ্গলগুলোতেও এই আইন কার্যকর করা হয়।
আসলে ভারতে হাতি সংরক্ষণের ধারণাটি আরও পুরনো। অর্থশাস্ত্রে হাতি শিকারির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বলে উল্লেখ আছে। আর একথাও সত্যি যে ব্রিটিশরা সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থেই হাতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল।
বাংলার হাতি বিক্রি করে ব্রিটিশ অফিসারদের সমৃদ্ধি
হাতি ধরা কোম্পানির জন্য ব্যয়বহুল ছিল বলে ইজারার ব্যবস্থা করা হতো। ঢাকার খেদা বিভাগ লাভ করতে না পারলেও ইজারা নিয়ে ব্রিটিশ অফিসাররা ব্যক্তিগত ব্যবসার সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল। ১৭৭২ সালে সিলেটের প্রথম কালেক্টর হন উইলিয়াম মেকপিস থেকারি। উইলিয়ামের পর আসেন রবার্ট লিন্ডসে। দুজনেই হাতি বিক্রি করে মোটা অর্থ লাভ করেছিলেন।
লিন্ডসের আত্মজীবনী থেকে তার এই হাতি ধরার বর্ণনাও মিলে। তিনি লিখেছেন, 'মোগল আমলে সিলেট ছিল হাতি ধরার প্রধান কেন্দ্র'। মোগল সরকারের কৌশল অবলম্বন করে লিন্ডসে মাদী কুকি হাতিদের কাজে লাগিয়ে হাতি ধরার পুরোনো কৌশলকেই পরিশীলিত করেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন স্থানীয় বয়স্ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা।
রবার্ট লিন্ডসে আরও লিখেছেন, 'এক দাঁতওয়ালা হাতিদের পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অন্যদিকে, হাতির মুখে কালো দাগ থাকার অর্থ ছিল এরা অশুভ, বিক্রি হবে না।' লিন্ডসে 'গুণ্ডা হাতি'-র কথাও উল্লেখ করেন, যাদের দলচ্যুত করা হতো।
১৮১০ বা ১৮১১ সালের খেদা মৌসুমের পর চট্টগ্রামের কমিশনার জেনারেল কোম্পানিকে এমনই একটি 'গুন্ডা হাতি'-র বর্ণনা দেন। তিনি লিখেন, 'রাজি মঙ্গল নামের এই হাতিটি উপহার হিসেবে দারুণ হবে। সবদিক থেকেই রাজি মঙ্গল নিখুঁত সৌন্দর্য্যের অধিকারী।'
বাংলার হাতিদের দক্ষিণ ভারতের মহিশুরের হাতিদের মতো ঘি বা গুড়ের প্রয়োজন পড়ে না বলেও উল্লেখ করা হতো। মহিশুরের একেকটি হাতির জন্য দুজন মাহুতের প্রয়োজন পড়লেও বাঙালি হাতিদের এক মাহুতই যথেষ্ট ছিল।
১৭৯৯ সালে রয়্যাল সোসাইটিতে উপস্থাপিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, বাংলার অধিবাসীরা হাতিকে দুটি জাতে ভাগ করে। এর মধ্যে সেরাজাতের হাতিটির নাম হলো 'কুমার'। এই হাতিদের শুঁড় থাকে লম্বা। দেহ বিশালাকার মোটা, তবে সেই তুলনায় পা খাটো। এই হাতিগুলো সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতো। দ্বিতীয় জাতের নাম ছিল 'মার্গী'। এদের দাম কুমারের থেকে কম হতো।