চ্যাটজিপিটি যেভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রতিনিয়ত আসছে বৈপ্লবিক সব আবিষ্কার। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে চ্যাটজিপিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এই কন্টেট ক্রিয়েটরের পুরো নাম- 'চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার'। মাস দুই আগে বিশ্বের প্রথম সারির একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা ল্যাবরেটরি- ওপেন এআই চ্যাটবট'টি বাজারে আনে।
চ্যাজজিপিটি কিন্তু নিজেই বলেছে, সে আপনার ও আমার চাকরি কেড়ে নিতে আসছে'।
চ্যাটবটটির সক্ষমতা এক কথায় অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদক একে কমান্ড দেন, 'আগামী পাঁচ বছরে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিতদের চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত করবে কিনা– তা নিয়ে আটলান্টিকের মতো করে পাঁচ বাক্যের একটি অনুচ্ছেদ লেখ'। চোখের পলকেই সেভাবে প্যারাগ্রাফ লিখে তাক লাগিয়ে দেয় এটি।
চ্যাজজিপিটি লিখেছে, 'আগামী পাঁচ বছরে এআই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকরির সুযোগ কমানো শুরু করবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে, এটি এমন সব কাজ করতে পারবে, যার জন্য উচ্চ শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় (মানুষের)। এর ফলে বিভিন্ন কোম্পানি খরচ কমাতে লোকবল ছাঁটাই করতে থাকবে, কিছু কিছু শিল্পে এর ফলে কর্মীর সংখ্যা কমবে। এই ধারা কতোটা ব্যাপক হবে তা অনুমান করা মুশকিল। তবে এআই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতদের চাকরির বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবেই– সেদিকটা নিশ্চিত। তাই প্রযুক্তির নিত্যনতুন অগ্রগতির দিকে নজর রেখে- মানুষকে তাদের দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়াতে হবে, যাতে প্রায় সব ধরনের কাজে সক্ষম হয়ে উঠতে থাকা এআই প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চাকরি টিকিয়ে রাখতে পারে'।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু অসাধারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত টুলস/ সফটওয়্যার এসেছে বাজারে। এদের মধ্যে চ্যাটজিপিটির পাশাপাশি নাম করা যায় ইমেজ জেনারেটর- মিডজার্নি ও ডাল-ই'র। ভিডিও জেনারেটরদের মধ্যে সিন্থেসিয়া উল্লেখযোগ্য।
অতি দ্রুত ও বিপুল পরিমাণে ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করতে পারায়- এই টুলসগুলোর ইতিবাচক দিকটা সহজেই উপলদ্ধি করা যায়। ইতোমধ্যেই রচনা লেখার কাজে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করেছে ছাত্ররা। নিজস্ব ওয়েবসাইটের কপি তৈরিতে, বিজ্ঞাপনের ভাষা লিখতে বা গ্রাহকদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব দিতেও এটি ব্যবহার করছে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আইনি বিবৃতি লিখতে ব্যবহার করছেন আইনজীবীরা এবং ফুটনোট তৈরির কাজে লাগছে শিক্ষাবিদ, গবেষকদের।
নেতিবাচক দিকটাও সহজে চোখে পড়ার মতোই। প্রথম প্রশ্ন যেটা উঁকি দেয় তা হলো– এআই এর উত্থান যখন নিদারুণ বাস্তবতা, সেই প্রেক্ষাপটে চ্যাটজিপিটি কী কপিরাইটার, সাংবাদিক, গ্রাহক সেবা এজেন্ট, দলিল লেখক, কোডার, ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের কর্মসংস্থানকে বিপন্ন করবে? এর উত্তরটা প্রযুক্তি চিন্তকরা অনেক আগেই দিয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, সাবলীল ও সৃজনীশক্তি সম্পন্ন এআই অবধারিতভাবেই 'হোয়াইট কলার' বা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার বিকল্প হয়ে উঠবে। রোবট প্রতিস্থাপন করবে এ ধরনের সুদক্ষ কর্মীদের। অথচ এক সময় মনে করা হতো, অন্তত বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন ধারার প্রভাবমুক্ত থাকবে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ের এআইগুলো তাদের আভাসকে আরো বাস্তব করেই তুলছে।
এআই সর্বক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠার চরম বাস্তবতা কল্পনা করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, সেক্ষেত্রে 'হোয়াইট কলার' চাকরির দৃশ্যপটকে আমূল বদলে দেবে এআই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ৪৭ শতাংশ চাকরি হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বায়নের এই যুগে ডিজিটাল বিপ্লবের এই প্রভাব অন্যান্য উন্নত দেশের পাশাপাশি যে উন্নয়নশীল বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়বে তাতো বলাই বাহুল্য।
আধুনিক যুগে স্মরণকালের মধ্যে কোনো একক প্রযুক্তি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক বেকারত্ব সৃষ্টি করেনি। জেনারেটিভ এআই কি হবে তার ব্যতিক্রম? এই উত্তরটা কেউই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে দিতে পারেন না। অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে তো নয়ই। উত্তরটা নির্ভর করবে প্রযুক্তি কতোটা নতুন এবং এর সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কতোটা ধীর গতিতে তাল মেলাতে পারবে- তার ওপর।
কিন্তু, এআই আসলেই ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করছেন প্রযুক্তি বিশারদরা। কারণ, কিছুদিন আগেও যেসব কাজ স্বয়ংক্রিয় করা অসম্ভব মনে করা হতো– সেগুলো আজ এআই করছে চোখের পলকে। কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের বিষয়ে একজন বিশ্বখ্যাত বিশেষজ্ঞ হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ডেভিড অটোর। তার মতে, 'আগে (কম্পিউটার) প্রযুক্তির বিকাশ ছিল সরল ও সহজে অনুমানযোগ্য। আপনি কাজের ধাপ ঠিক করে কমান্ড দিতেন, আর কম্পিউটার তা অনুসরণ করতো। এটা শুধু পুরো প্রক্রিয়াটা অনুসরণ করতো, সে নিজে কিছু শিখতো না বা উদ্ভাবনও করতো না। কিন্তু, চ্যাজজিপিটির মতো এআই নিজস্ব প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে পারে। এটা 'হোয়াইট কলার'ধারীদের চাকরির বাজারকে অস্থিতিশীল করবেই'।
উদীয়মান এআই প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়– তা এখনও বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে উদ্যোক্তা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে এই মুহূর্তে এগুলোর ব্যবহার বেশ সীমিত- নতুন পণ্য তৈরি, ব্যবসা কার্যক্রমকে সরল করা বা কর্মীদের অধিক দক্ষ করে তোলার কাজে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রযুক্তির প্রভাব তৈরি হতে আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। যেমন ধরুন বিদ্যুৎ। ১৮ শতকেই উদ্ভাবিত হয়েছিল বৈদ্যুতিক সার্কিট, লাইট ও মোটরের মতো যন্ত্রপাতি। কিন্তু, বিদ্যুৎ শক্তির সার্বিক ব্যবহার শুরু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধিতে লেগে যায় আরো এক শতক। কম্পিউটারও নয় তার ব্যতিক্রম। ১৯৫০ এর দশকেই বাজারে আসে প্রথম দিককার কম্পিউটার। কিন্তু, ১৯৯০ দশকের আগপর্যন্ত উৎপাদনশীলতায় তার প্রভাবটা সেভাবে দেখা যায়নি।
কিছু প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, সঙ্গে কমায় শ্রম চাহিদা। যেমন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি কর্মসংস্থান কমিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। এই প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই। তবে কিছু প্রযুক্তি অসাধারণ হওয়ার পরও চাকরি প্রতিস্থাপনে তাদের প্রভাব বেশ নীরবই বলা যায়। উদাহরণস্বরূপ; বলা যায় ইন্টারনেটের কথা। এই প্রযুক্তি কি গত চার দশকে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি? আমরা যেভাবে বন্ধুত্ব পাতাই, বিনোদন মাধ্যমে যুক্ত হই বা এমনকী নিজের জীবনের গল্পগুলোকে রেকর্ড করি বা ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করি– তা নিঃসন্দেহে বদলেছে। ইন্টারনেট তৈরি করেছে অযুত কোটি ব্যবসা, আর তাতে ধনকুবেরও বনেছেন অনেকেই।
তবু ২০০০ এর দশকে অর্থনীতিবিদ রবার্ট গর্ডন বলেন, 'ইন্টারনেট মহান আবিষ্কারগুলোর প্রতিবন্ধকতা উৎরানোর পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এটা আমাদের সস্তায় তথ্য ও বিনোদন লাভের সুযোগ করে দিলেও– এর অধিকাংশ সেবাই বিদ্যমান কর্মকাণ্ডের বিকল্প মাত্র'। তাই প্রায় চার যুগ পরেও উৎপাদনশীলতায় বিপ্লব সূচনা করতে পারেনি ইন্টারনেট। যেকারণে স্মার্টফোনও পারেনি।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি তাহলে স্মার্টফোনের সাথে তুলনা করা উচিত, নাকি করতে হবে স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন যন্ত্রের সাথে? সার্বিকভাবে এটা কী চাকরি নষ্ট না করে শুধু কাজের ধরন বদলে দেবে? নাকি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার কেন্দ্রগুলোকে শূন্য মরুর রূপ দেবে?
এ প্রযুক্তি কোথায় চাকরিশূন্যতা সৃষ্টি করবে, তা এখনই অনুমান করা কঠিন বলে উল্লেখ করেন ডেভিড অটোর। এনিয়ে মানুষের উদ্বেগ যে বেশি, সেটা তুলে ধরে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে স্বচালিত গাড়ি নিয়েও এমন মাতামাতি হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এবার ট্রাকচালকেরা বেকার হবে। কিন্তু, শেষপর্যন্ত তা হয়নি। তবে এটাও ঠিক, এআই এক্সেল বা গুগল ডকের মতো সাধারণ প্রযুক্তির চেয়ে অনেকগুণ উন্নত ও সৃজনশীল। তার চেয়ে বড় কথা, ব্যবহার যত বেশি করা হয়, এআই ততোই তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে এবং নিজেকে উন্নত করতে থাকে। সে তুলনায়, সাধারণ সফটওয়্যারকে যথেষ্ট শ্রম ও সময় দিয়ে আপডেট করতে হয়ে টেক ইঞ্জিনিয়ারদের।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যন্ত্রের মাধ্যমে কর্মী প্রতিস্থাপনের সুযোগ পায়, তাহলে তারা সেটাই করবে, এমন ধারাই চলে আসছে। বর্তমানে দলিল লেখক, কপি রাইটার, ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, নির্বাহীদের অফিস সহকারী ও প্রাথমিক পর্যায়ের কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের কাজ অনায়সে করতে পারে এআই। এমনকী কিছু সাংবাদিকের মতো লিখতেও পারে তারা। সময়ের সাথে সাথে এআই যত সাবলীল ও দক্ষ হবে, শিক্ষিত মানুষের এসব চাকরির ধরনও তার সাথে বদলাতে থাকবে। কিন্তু, এআই অনবদ্য প্যারাগ্রাফ লিখে দিলেও, এই নিবন্ধ রচনায় যেভাবে প্রযুক্তি বিশারদ বা শ্রম বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে সেটা করতে পারবে না। মানবিক বোধ না থাকলে, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নথি খুঁজে বের করাও তার পক্ষে অসম্ভব। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সময় শ্রম বাজারের পরিবর্তনগুলো নিয়ে করা গবেষণার মান যাচাইটাও একই কারণে করতে অপারগ সে। বর্তমানে ইন্টারনেটে থাকা বিভিন্ন নিবন্ধকে সূত্র ধরেই সে নিজস্ব নিবন্ধ লিখছে। এতে তার জ্ঞান বা প্রজ্ঞা নেই কোনো। নেই নিজেকে সংশোধন করে সম্পূর্ণ নতুন ও চমকপ্রদ আইডিয়া তৈরির সক্ষমতা।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এআই অন্তত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অমূল্য এক সহায়ক সম্পদ হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এতে আরো উৎপাদনশীল হতে পারবেন। সাধারণ বিষয়ের ওপর লেখা একটি নিবন্ধে, এআই এর সাহায্য নিয়ে অনেক তথ্যপ্রমাণ যুক্ত করে সেটিকে সমৃদ্ধ করে তোলা যাবে। শুধু তাই নয়, সরকারি বৈঠকের সারসংক্ষেপ জানাতেও অবদান রাখবে এআই। আর তা নিয়ে সাংবাদিকরা লিখতে পারবেন আরো বিস্তৃত প্রতিবেদন। ডেভিড অটোরের মতে, 'অনেক দিক দিয়েই, এআই মানুষকে তাদের বিশেষ দক্ষতাকে আরো ভালোভাবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। যার অর্থ, আমরা আরো বিশেষায়িত হয়ে উঠব'।