প্লাবনভূমির চিরচেনা হিজল গাছও বিপন্ন!
জলমগ্নতায় অভ্যস্ত হিজল গাছ, নিয়মিত বন্যার সাথে মানিয়ে গঙ্গা- ব্রহ্মপুত্র - মেঘনা নদীর অববাহিকায় কত শত যুগ ধরে অনায়াসে বিস্তার হিজল বনের। ঐতিহ্যগতভাবে এই বনগুলোর ব্যবস্থাপনা করেছে স্থানীয় সম্প্রদায়। বন তাদের জীবনে রেখেছে অনেক অবদান, রেখেছে বন্যার প্রভাব প্রশমনে ভূমিকা। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে করা নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা পরিবর্তনে বৃক্ষের এই প্রজাতির বিস্তার এলাকা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হবে।
হিজল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম 'ব্যারিংতোনিয়া অ্যাকুতাংলা' – এই প্রজাতির জন্য অনুকুল প্রাকৃতিক নিবাস বাংলাদেশ ও ভারত। কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই এলাকা ৫০.৫৭ শতাংশ কমে আসবে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। ভবিষ্যতে জলবায়ু বদলের বিভিন্ন দৃশ্যকল্প বা মডেল বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা এ পূর্বাভাস দেন। এর ভিত্তিতে হিজলকে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)- এর বিপন্ন প্রজাতির তালিকা পর্যালোচনায়- যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষণা নিবন্ধের লেখকরা।
'প্লাবনভূমির চাষিদের প্রধান জীবিকা মাছ চাষ। তাদের জন্য আর্থ-সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিজল বন। যেমন ভারতের আসামে হিজল বনের সাথে মাছ চাষের খুবই নিবিড় এক সম্পর্ক রয়েছে। একারণেই এ গাছের প্রজাতিটির সংরক্ষণ প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষ উভয়ের জন্যই অতি-জরুরি'। গবেষণা নিবন্ধের লেখক অরুন জয়থী নাথ এমনটাই জানান প্রকৃতি বিষয়ক গণমাধ্যম মঙ্গাবে'কে। অরুন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
হিজলের ডালপালা ঝুঁকে থাকে পানির দিকে। মাছ চাষিরাও হিজলের ডাল পুঁতে রাখে। এতে করে পোণা মাছ- শিকারী মাছ বা পাখির থেকে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে ডালপালার ফাঁকে। ঘেরে এই ডালপালার ব্যবহার মাছ চুরিও প্রতিহত করে। হিজলের রুক্ষ বাকলে সহজেই জন্মায় শ্যাওলা, যা মাছের পছন্দের খাদ্য।
প্রাকৃতিকভাবে হিজল জন্মায় নদীতীরে, মিঠাপানির জলাভূমি বা হৃদের কিনারে। এসব নিম্নভূমি বর্ষাকালে বন্যা প্লাবিত হয় প্রতিবছর। তবে সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জমিতে জন্মায় হিজল গাছ।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকাতেও রয়েছে হিজল। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকা এ প্রজাতির জন্য আদর্শ।
কিন্তু, এসব নিম্ন প্লাবনভূমির এলাকা অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে। একারণে এ অঞ্চলসহ বৈশ্বিকভাবেই হিজল বনের বিস্তার হুমকির মুখে পড়তে চলেছে বলে জানান গবেষকরা।
অনিয়মিত বৃষ্টিপাত তীব্র খরা ও আকস্মিক বন্যা- দুই ধরনের চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। হিজল গাছের বংশবিস্তার এতে বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ, বন্যার মৌসুমেই হিজল গাছ তার বীজ ছড়িয়ে দেয়। বীজের উর্বরতা ও পরিমাণ নির্ভর করে বাতাসে যথেষ্ট পরিমাণ আদ্রতা থাকার ওপর।
অরুন জয়থী নাথ বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন বাস্তুসংস্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে প্লাবনভূমির বাস্তুসংস্থান। অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সাথে সাথে তাপমাত্রার চরম ওঠানামা এবং জলীয় বাষ্প তৈরির তারতম্য এই পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলছে। জলনায়ু পরিবর্তন বনাঞ্চলের আচ্ছাদন কমিয়েও প্লাবনভূমির বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এতে জীববৈচিত্র্য হারায় এবং (গাছ/ জীব) প্রজাতির সুষম বন্টন ব্যাহত হয়'।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতিবিদ অভিক গুপ্ত বলেন, প্লাবনভূমির প্রতীকী প্রতিনিধি হিজল গাছ। তাই 'ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান এ প্রজাতির প্রাকৃতিক নিবাস। তাই হিজলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণের এই গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম'।
তিনি বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন আগামী দিনে যেসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হবে– এটি তারই নির্দেশক। আগামী বছরগুলোয় আরো মারাত্মক হবে এসব পরিবর্তন। এতে মানব আবাস, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর উর্বর, উৎপাদনশীল অববাহিকাও বিপন্ন হবে'।
গবেষণায় বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ২৪ লাখ ৫০ হাজার ৫৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরমধ্যে এক লাখ ৯৯ হাজার ৬৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা হিজল গাছের বংশবিস্তারের জন্য অতি-আদর্শ বলে দেখা গেছে। কিন্তু, এই এলাকা ২০৫০ সাল নাগাদ ৫০.৫৭ শতাংশ কমে এক লাখ ৬৬৯ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
আর দেশভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ হাজার ৫৪১ বর্গকিলোমিটার এলাকা হিজল গাছের জন্য আদর্শ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ এই এলাকা হ্রাস পেয়ে হবে ৩৪ হাজার ৮০১ বর্গকিলোমিটার। একইভাবে ভারতে আদর্শ এলাকা বর্তমানে এক লাখ তিন হাজার ৫২২ বর্গকিলোমিটার হলেও, ২০২৫ সাল নাগাদ তা মাত্র ৬৫ হাজার ৮৬৮ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসবে।
ভারতের বন্যপ্রাণী ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণা নিবন্ধের সহ-লেখক জ্যোতিষ রঞ্জন ডেকা বলেন, এই প্রজাতি তার একাধিক ব্যবহার উপযোগিতা ও বাস্তুসংস্থানে অসামান্য অবদানের জন্য পরিচিত। আইউসিএন এর বিপন্ন প্রজাতির পর্যালোচনায় এটি না থাকায়, এর সংরক্ষণের উদ্যোগও কম। ফলে খুব দ্রুতই হ্রাস পাচ্ছে এর আবাস অঞ্চল। তাই গাছটির বিপন্নতা মূল্যায়ন করে, এটিকে বিপন্ন তালিকাভুক্ত করতে আমরা আইউসিএন'কে অনুরোধ করেছি'।
গবেষণার একজন সহ-লেখক অনিমেখ হাজারিকা বলেন, 'হিজল গাছের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মোট ৮৯টি স্থান আমরা চিহ্নিত করেছি। ভবিষ্যতে এসব স্থানে হিজল গাছ বিপন্ন কিনা সেটা আইইউসিএন তাদের লাল তালিকার প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করে জানাতে পারবে। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারব প্রজাতিটির আবাস এলাকা কতোটা সংকুচিত হচ্ছে, এতে সংরক্ষণের জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া যাবে'।
বাংলাদেশ ও ভারতে প্লাবনভূমি এলাকায় দূষণ, দখল চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সেখানে ফেলা হচ্ছে পৌরসভার ময়লা, কখনোবা গড়ে তোলা হচ্ছে কলকারখানা। আবার কৃষিরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। এসব খুবই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে জানানো হয় গবেষণায়।
এতে বলা হয়, 'মানুষের হস্তক্ষেপ প্লাবনভূমির প্রাকৃতিক সেবাগুলোকে ব্যাহত করে এবং এতে বসবাসকারী প্রজাতিগুলোকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রেক্ষাপটে প্লাবনভূমির হিজল বনরক্ষা এখানকার মাছ চাষিদের অস্তিত্ব রক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত'।
কানাডার সাসকাচেয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও সম্পদ অর্থনীতির গবেষক এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এইচ এম তৌহিদূর রহমান, বাংলাদেশের জলাভূমির বনাঞ্চলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব জানার চেষ্টা করে চলেছেন। তার গবেষণায় হিজল গাছও আছে। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতে এই প্রজাতি রক্ষায় যৌথ প্রচেষ্টা নেওয়ার আহ্বান জানান।
বলেন, 'উজানে (আসাম ও মেঘালয়ে) বন উজারের ফলে ভূমি ক্ষয় হয়, এতে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি ও বালি নদীর মাধ্যমে প্লাবনভূমিতে নেমে আসে, এটা একটা সমস্যা, কারণ প্লাবনভূমি নিচু, এগুলো ভরাট হয়ে গেলে সারা বছর পানি ধরে রাখতে পারে না। ফলে হিজলের মতো যেসব গাছের জলামগ্নতা দরকার, সেটা তারা পায় না'।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটা । ভূমিক্ষয় রোধে যৌথ উদ্যোগ নিলে যা ঠেকানো যাবে। এছাড়া, দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত রাজনৈতিক বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনাও রয়েছে। এর সমাধান হলে, তথ্য ও পরিকল্পনা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশ সংরক্ষণ উদ্যোগে যুক্ত হতে পারবে'।