আমরা কেন সুপারশপে দুইবার ট্যাক্স দেই?
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার নওশাদ হোসেন থাকেন পশ্চিম রামপুরায়, কেনাকাটা করছেন সেখানকার এক সুপারশপে। একই ছাদের নিচে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্য পেয়ে যাওয়া তার জন্য বেশ সুবিধাজনক। কিন্তু যখনই তিনি তার রিসিটটি হাতে পান, তখনই চমকে যান। "কেন আমাকে দুইবার ট্যাক্স দিতে হয়?" বলে বিড়বিড় করতে থাকেন তিনি।
সুপারস্টোর থেকে পণ্য কেনা ক্রেতারা প্যাকেটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) প্রদান করেন। যদিও বেশিরভাগ প্যাকেটজাত পণ্যের মোড়কে লেখা দামে ইতিমধ্যেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত রয়েছে।
নওশাদ জানান, "আমদানিকৃত পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতাকেই অতিরিক্ত শুল্কের খরচ বহন করতে হয়। তার ওপর আমরা ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাট দিয়ে পণ্যটি কিনছি।"
তবে নওশাদের মতো অন্যান্য সাধারণ ক্রেতারা সাধারণত তাদের ক্যাশ রিসিটটি পড়ে দেখেন না। তারা প্রতিটা পণ্যের দাম দেখে সে পণ্যটি কার্টে রাখেন না। যার ফলে তারা না জেনেই একই পণ্য কেনার জন্য দুইবার ট্যাক্স দিয়ে থাকেন।
মাঝেমধ্যে সুপারস্টোরের ম্যানেজারদেরকে উৎসাহী ক্রেতাদের 'আপনারা কেন সাধারণ মুদি দোকানের চেয়ে বেশি দাম রাখছেন? ' প্রশ্নের শিকার হতে হয়। ক্রেতাদের প্রতি উত্তরও ভিন্ন ভিন্ন হয়, সার্ভিস ভালোভাবে দেওয়ার জন্য অথবা ভালো মেইন্টিনেন্স বজায় রাখার জন্য।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চেইন শপ স্বপ্নের একজন সিনিয়র আউটলেট অপারেশন ম্যানেজার নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, "যখন আপনি দেখেন মোট দুই হাজার টাকার পণ্য কিনেছেন [উদাহরণস্বরূপ], এবং আপনাকে ২,১০০ টাকা দিতে হয়, কেবল তখনই হয়তো আপনার মনে এই প্রশ্ন আসবে।"
তিনি জানান যে, দেশের উন্নয়নের জন্য সরকার এই অতিরিক্ত ভ্যাট তাদের কাছ থেকে আদায় করছে।
দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের খরচ ভারসাম্য রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার সুপারস্টোরের ক্রেতাদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সাতবার ভ্যাটের হার পরিবর্তন করা হয়, যেটি ১.৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সুপারমার্কেট ঔনার্স অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে এই 'বৈষম্যমূলক' ট্যাক্স তুলে দেওয়ার দাবি জানান। কয়েক দফা সাক্ষাৎকারের পর অ্যাসোসিয়েশনটির নেতারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেন।
সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সুপারস্টোরের ক্রেতারা মুদি দোকানের ক্রেতাদের তুলনায় বেশি স্বচ্ছল, যে কারণে সুপারমার্কেটগুলো থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় বড় কোনো সমস্যা হতে পারে না।
এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ আব্দুল মজিদ ব্যাখ্যা করেন যে, ক্রেতারা মুদি দোকান থেকে তাদের পণ্যের গুণমানের কোনো নিশ্চয়তা পান না, যেটি সুপারশপে পাওয়া যায়। তাছাড়া পণ্যের দাম নিয়েও কথা বলার জায়গা থাকে সেখানে।
অন্যদিক, সুপারস্টোরগুলো তাদের মান নিশ্চিত করার জন্য দায়ী। এখানে দামগুলো আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা। "৫% ভ্যাট নিয়ে একেক ধরনের মতামত পাওয়া গেলেও ক্রেতারা এসব অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত চার্জ দিতেই পারেন," বলে মতামত দেন তিনি।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কঞ্জ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) সরকারকে এই ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানোর দাবি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বলেন, "৫ শতাংশ ভ্যাটের এই নীতি বেশ বিভ্রান্তিকর। কেন একজন ভোক্তা একই পণ্যের জন্য দুইবার ভ্যাট দিবেন? এটা কি অন্যায্য নয়?"
পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিউট অফ বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আহসান এইচ মনসুরও ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাটের সাথে একমত নন। তিনি বলেন, "সুপারশপে ৫ শতাংশ ভ্যাট বেশ খানিকটা বেশি। একে ২.৫ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে রাখা উচিৎ। পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকার পরও এই অতিরিক্ত কর এত বেশি হওয়া উচিৎ নয়।"
পৃথিবীব্যাপী চলা অন্যান্য দেশের ফুল ভ্যাট সিস্টেমের উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যদি আমাদের ফুল ভ্যাট সিস্টেম থাকতো, তবে রিটেইল পর্যায়ে ভ্যাট ১.৫-২.৫ শতাংশের বেশি হতো না। কারণ এর ফলে সেখানে পুরো ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট থাকতো এবং ভ্যাট ১.৫-২ শতাংশের বেশি বাড়তো না।"
সুপারমার্কেট মালিকরা জানান বাংলাদেশের এই সেক্টরটি বছরে ৫ হাজার কোটি রেভিনিউ উৎপাদন করার মতো সম্ভাবনা রয়েছে। স্বপ্নের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সাব্বির হাসান নাসির জানান, "আমরা চাই সুপারস্টোর এবং সাধারণ মুদি দোকান একই করনীতির আওতায় আসুক। এই বৈষম্যমূলক ট্যাক্সের কারণে আমরা সেভাবে লাভ করতে পারছি না, যেভাবে আমরা করতে পারতাম।"
২০২০ সালে বাংলাদেশের রিটেইল মার্কেটের অর্থমূল্য ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে সুপারমার্কেটের অংশ ছিল মাত্র ১.৬ শতাংশ বা ২৫৬ মিলিয়ন ডলার। সাব্বির জানান, শ্রীলঙ্কার রিটেইল মার্কেটের ৪৩ শতাংশ সুপারমার্কেটের দখলে, যেখানে ভারতে এর পরিমাণ ৮-৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে দেশের সুপার শপগুলো ১৯৩৭.৪ কোটি রেভিনিউ উৎপাদন করে।
২০১৫ সালে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে রেভিনিউ বাড়ার হার ১৫.৪% থেকে ২.০৪%- এ নেমে যায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করলে রেভিনিউ বৃদ্ধির হার পুনরায় ৫.৫৭৫% থেকে ৩%-এ নেমে আসে। স্বপ্ন থেকে পাওয়া ডেটা থেকে ২০১৯ সালে এই বিশ্লেষণ করা হয়।
এই বৈষম্য কমানোর জন্য সরকার তাদেরকে আশ্বাস দেন যে মুদি দোকানগুলতে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিন বসানো হবে। সাব্বির জানান, "গত ছয় থেকে সাত বছর ধরে আমরা এই একই ইসিআর স্থাপনের কথা শুনে আসছি, কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।"
তিনি মনে করেন যে, বিশ লক্ষেরও বেশি দোকানে ইসিআর মেশিন বসানো সম্ভব নয়, "কারণ এই বিষয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই।"
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা মো. ফরিদ উদ্দীন জানান যে, ৫ শতাংশ ভ্যাট বৈষম্যমূলক। তবে একইসাথে তিনি বলেন যে, ভ্যাট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নিরীক্ষা করা উচিৎ সুপারশপগুলো আসলেই 'ভ্যালু-অ্যাডেড' সেবাগুলো দিচ্ছে কিনা সেটি।
ফরিদ জানান, "যদি কোনো ভোক্তা ১০০ টাকার পণ্য কেনেন, তবে তিনি ১৩৩ টাকার সেবা পাবেন এবং ৫ টাকা ভ্যাট হিসেবে পরিশোধ করবেন। তাহলেই এই ভ্যাট যৌক্তিক হবে।" তার মতে ভ্যাট ৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিৎ নয়।