দিনে তিনবার দাঁত ব্রাশ করা কি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী!
ওরাল হেলথের সাথে মানবদেহের সুস্থ থাকার সংযোগ থাকলেও ডাক্তাররা প্রায়ই মুখের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তেমন গুরুত্ব দেন না। স্পেনের মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দন্তবিভাগের অধ্যাপক এলেনা ফিগুয়েরোর মতে এই ধারণার শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, যখন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো হয় যে পরিপাকতন্ত্রের কাজ মুখেই শেষ হয়।
তিনি এমন অনেক ডাক্তারদের একজন, যিনি এই ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। তার মতে, ৫০ ধরনেরও বেশি রোগের শুরু হয় অথবা খারাপের দিকে মোড় নেয় পেরিওডন্টাল রোগের কারণে।
পেরিওডন্টাল রোগ ক্যাভিটির মতো নয়। এর শুরু হয় দাঁতের মাড়িকে আক্রমণের মাধ্যমে, যেটি পরিচিত জিঞ্জিভাইটিস নামে। যদি জিঞ্জিভাইটিস হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তবে সেটি পেরিওডন্টিটিজে রূপ নেয়। এর ফলে দাঁতের নিচের হাড় ক্ষয় হয় এবং অনেক সময় দাঁতও পড়ে যায়।
ফিগুয়েরো জানান, "রোগীর মুখের ব্যাকটেরিয়া এবং তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে এই রোগটি হয়। এর ফলে প্রচুর পরিমাণ প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। যদি এগুলো রক্তে পৌঁছে গিয়ে ব্যাকটেরামিয়া তৈরি করে তাহলে জায়গাটি মারাত্মকভাবে ফুলে যেতে পারে।"
"নিয়মিতভাবে যদি দাঁতের মাড়ি ফুলতে থাকে, এবং সেটা যদি পেরিওডন্টাল রোগের মতো খুব বেশি মাত্রায়ও না হয়, তাতে রক্ত এবং মস্তিষ্কের মধ্যকার প্রতিবন্ধক আরও ভেদযোগ্য হয়ে ওঠে। এই প্রতিবন্ধকটি মস্তিষ্কের মধ্যে ক্ষতিকর জিনিস ঢুকতে বাধা দেয়," জানান স্পেনের দ্য বায়োমেডিক্যাল সেন্টারের হুয়ান কার্লোস লেজা। মানসিক অসুস্থতার পেছনে শারীরিক কারণ খুঁজে বের করতে গবেষণা করছে এ প্রতিষ্ঠান।
"মাড়ি ফুলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু যদি এটি বারবার হতে থাকে, তাহলে স্ট্রোকের মতো শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।" লেজা ফিগুয়েরোর সাথে পেরিওডন্টাল রোগ এবং ডিপ্রেশনের সম্পর্ক খুঁজে বের করার জন্য ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালাচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, "মুখের রোগের সাথে সিজোফ্রেনিয়া কিংবা স্ট্রোক হওয়ার সম্পর্ক এখনো প্রমাণিত নয়। তবে যাদের এসব সমস্যা রয়েছে তাদের নিয়মিত মাড়ি ফুলে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে।"
গত সপ্তাহে অ্যামেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রোক কনফারেন্স ২০২৩-এ ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের একদল গবেষক ওরাল হেলথ এবং মস্তিষ্কের সুস্থতার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন। গবেষণার জন্য ইউকে বায়োব্যাংকে ভর্তি হওয়া স্ট্রোক হয়নি এমন ৪০ হাজার রোগীর অবস্থা বিশ্লেষণ করেন। তাদেরকে বেশ কিছু জেনেটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর গবেষকরা এই জেনেটিক রিস্ক ফ্যাক্টরের সাথে এমআরআই থেকে পাওয়া ব্রেন ইমেজ বিশ্লেষণ করেন।
গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, 'যে সকল ব্যক্তির ক্যাভিটি, দাঁত পড়ে যাওয়া কিংবা মাড়িতে সমস্যা আছে, তাদের সেরেব্রোভাস্কুলার রোগ (মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহজনিত সমস্যা) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি'।
বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে , পেরিওডন্টাল রোগ ডিপ্রেশন ও আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তবে এখনো ওরাল হেলথের সাথে মস্তিষ্কের সমস্যা যে সম্পর্কিত তা পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়নি। তবে ডায়াবেটিসের সাথে ওরাল হেলথের পরিষ্কার সম্পর্ক রয়েছে।
ফিগুয়েরো ব্যাখ্যা করে বলেন, "ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পেরিওডন্টিস সারানো দ্বিতীয়বার ওরাল অ্যান্টিডায়াবেটিক দেওয়ার মতোই কার্যকরী। এটি এতটাই কার্যকরী যে রোগীদেওরকে দ্বিতীয়বার ঔষধটি খেতে হয় না। আমরা এখনো ডিপ্রেশনের সাথে পেরিওডন্টিটিসের সম্পর্ক খুঁজে পাইনি। তবে আমরা পেরিওডন্টাল রোগ সারাবার সাথে সাথে মানসিক অসুস্থতার প্যারামিটারগুলোর সম্পর্ক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।"
ওরাল হেলথের সাথে পুরো মানব-শরীরের সম্পর্ক আছে কিনা সেটি মানুষের শরীরের অংশগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে না দেখে পুরোটিকেই একটি অংশ হিসেবে দেখার প্রক্রিয়ার একটি পদক্ষেপ। এর ফলে ঔষধ ও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আরও সচেতন হওয়া যাবে। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং এর সাথে ব্যাকটেরিয়ার সম্পর্ক বের করার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অসুস্থতা সারানোর দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে মানসিক অসুস্থতা।
ফিগুয়েরো জানান, "মূল আইডিয়া হচ্ছে রোগীর সবধরনের অসুখ পরীক্ষা করা। রোগ হয়ে যাওয়ার পর সারানোর তুলনায় প্রতিবছর একবার দাঁত পরীক্ষা করে দেখা আরও সাশ্রয়ী।"
ওরাল হেলথ ঠিক রাখাসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়মিত চেক-আপের পাশাপাশি আরও কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। তারমধ্যে প্রধানটি হলো দাঁতের ক্যাভিটি প্রতিরোধ করতে প্রতিবার খাওয়ার পর টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। একইসাথে নিয়মিত ফ্লস ব্যবহার করা। ফিগুয়েরো জানান, "দাঁতের যত্ন নেওয়া কেবল আপনার আয়ুকেই বাড়াবে না, আপনার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সময়কেও বাড়াবে।"
সূত্র: এলপাইস