আক্কেল দাঁত কেন দেরিতে ওঠে?
আমাদের অনেকের জীবনেই এক বিশেষ ঘটনা হলো তরুণ বয়সে আক্কেল দাঁত তোলা। আক্কেল দাঁত ওঠার ব্যথায় অস্থির হয়ে থাকা অসহায় চেহারাও আমাদের খুব পরিচিত। কখনো কি ভেবে দেখেছেন অন্য সব স্থায়ী দাঁতের মতো এই আক্কেল দাঁতগুলোও কেন বাচ্চাকালে ওঠে না?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফিরে দেখতে হবে শিশুর বেড়ে ওঠায়। 'সাইন্স এডভান্সেস'-এর ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের চোয়ালে আক্কেল দাঁত ওঠার মতো জায়গা থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের পাশাপাশি চোয়ালও বড় হতে থাকে, তখন আক্কেল দাঁত ওঠার মতো পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি হয় সেখানে।
তবে ইদানিং অনেক মানুষের চোয়ালই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বিঘ্নে আক্কেল দাঁত ওঠার মতো বড় হয়না। যে কারণে আক্কেল দাঁত তোলার ঘটনা এখন অহরহই দেখা যায়। প্রাচীন যুগের মানুষের খাবার তালিকায় শক্ত মাংস, বিভিন্ন প্রকারের শক্ত বাদাম, কাঁচা সবজি ইত্যাদি থাকতো। তাই শুরু থেকেই তাদের চোয়াল এসব খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হতে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে বড় হত বলে মনে করেন কানাডার সিসকেচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন কলেজের নৃবিজ্ঞানী জুলিয়া বফনার। শিল্পায়নের সাথে মানবজাতির খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। নরম খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আমাদের চোয়াল এখন আর যথেষ্ট বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না।
তরুণ বয়সে আক্কেল দাঁত ওঠার আরেকটি কারণ হলো এর আগ পর্যন্ত মানুষের এই দাঁতের প্রয়োজনই পড়ে না। শক্ত খাবার চিবুতে গিয়ে প্রাচীন মানুষেরা প্রায়ই তাদের মাড়ির শেষপ্রান্তের মোলার দাঁতগুলো (পেষণ দন্ত) হারাতো, তখন আক্কেল দাঁত সেখানেই নিজের জায়গা করে নিত।
লস এঞ্জেলের সিডারস সিনাই-এর ওরাল সার্জন স্টিভেন কাপফারম্যান বলেন, "মোলার দাঁত হারানোর পর সে জায়গায় সহযোগী হিসেবে কাজ করে আক্কেল দাঁত।" যেহেতু বেশীরভাগ মানুষ শৈশব বা কৈশরে তাদের মোলার দাঁত হারায় না, তাই আক্কেল দাঁতও তরুণ বয়সের আগপর্যন্ত ওঠে না।
ছয় বছর বয়সে শিশুর দুধদাঁতগুলো যখন পড়তে শুরু করে, তখন চোয়ালের ভেতরের অংশে প্রথম ধাপের মোলার দাঁতগুলো ওঠে। এগুলো খাবার ভাঙ্গার জন্যই পরিকল্পিত। আবার ১২ বছর বয়সে যখন এই দাঁতগুলোতে ক্ষয় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন দ্বিতীয় ধাপের মোলার দাঁত ওঠা শুরু হয় বলে জানান কাপফারম্যান। তৃতীয় ধাপের মোলার দাঁত বা আক্কেল দাঁতগুলো ওঠে ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সের দিকে।
ইদানিং দাঁতে ঠাঁসাঠাসি মুখের ভেতরে নতুন আক্কেল দাঁতের আবির্ভাবে প্রায়সই তীব্র ব্যথা হয় অনেকের। তাই ডেন্টিস্টরা এখন আক্কেল দাঁত ফেলে দেয়াই সমীচীন মনে করেন। আবার ব্যথা না থাকলেও আক্কেল দাঁত ফেলে দেয়ার কারণে মাড়ির সংক্রমণসহ নানাধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো যায়। তবে ডেন্টিস্ট আর ওরাল সার্জনেরা সাধারণত ২৭ বছর বয়সের আগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আক্কেল দাঁত ফেলাকে সমর্থন করেন না। কারণ এর আগে আক্কেল দাঁত ফেলতে গেলে পাশের দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ নানাধরনের ঝুঁকি থাকে। তবে ব্যথা বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে এই বয়সের আগেই আক্কেল দাঁত তুলে ফেলতে পারেন।
অধিকাংশ মানুষের আক্কেল দাঁতসহ ৩২টি দাঁত থাকে। কাপফারম্যান জানান, ব্যতিক্রম কারো কারো দাঁত কম-বেশীও থাকতে পারে; আবার অনেকেরই সবগুলো আক্কেল দাঁত ফেলে দেয়ার দরকার পড়ে। এছাড়াও কারো কারো চোয়ালে প্রতিটি আক্কেল দাঁতের পেছনে চতুর্থ ধাপের মোলার দাঁতও থাকতে পারে, যাকে বলা হয় প্যারামোলার। তবে এখনকার মানুষের মুখের ভেতরে এই প্যারামোলার দাঁতের জন্য জায়গা প্রায় কখনোই থাকেনা। তাই আক্কেল দাঁতের সঙ্গেই তাদের তুলে ফেলা হয়।
সবাই কিন্তু তাদের আক্কেল দাঁত তুলে ফেলেন না। কাপফারম্যান বলেন, "আজকের দিনে যখন ব্রেস লাগানোর জন্যও মানুষ দাঁত তুলে ফেলে, তখনও অনেকেই চোয়ালে জায়গা থাকা সাপেক্ষে তাদের আক্কেল দাঁত রেখে দেন।"
যাহোক, আক্কেল দাঁত রেখে দেয়ার পর তা পরবর্তীতে সমস্যার কারণ হতে পারে। সবার আক্কেল দাঁত তরুণ বয়সে ওঠে না। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাড়ির সংকোচন হওয়ার পরও আক্কেল দাঁত উঁকি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আক্কেল দাঁতকে মাড়িতে জায়গা করে নিয়ে ওঠতে হয়, যা দাঁত ক্ষয়ের রাস্তা তৈরি করে। এমন হলে আক্কেল দাঁত ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
- সূত্র: লাইভ সায়েন্স