পাহাড়িদের গয়নার বাক্স!
পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে পাহাড়কে সমতলে পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন যখন মেয়েটি দেখেছিলো, তখন তার বয়স ছিলো ২৩ কিংবা ২৪। লক্ষ্য ছিলো, সমতলে পাহাড়ের গৎবাঁধা পরিচয়ের বাইরে নতুন পরিচয় উন্মোচন করবেন। সেই উদ্দেশ্যেই শুরু হয়েছিলো তার কর্মযজ্ঞ। কিন্তু পাহাড়ের ছোঁয়া সমতলে এনে দেওয়া- সহজ তো কোনো কথা নয়। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন গয়নাকে। পাহাড়ের বাইরে পাহাড়ি গয়না পৌঁছে দেয়ার অদম্য শপথ নিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর যাত্রা।
বলছিলাম রাঙামাটির মেয়ে ঋতিষা চাকমার কথা। যার প্রচেষ্টায় পাহাড়ি ঝর্ণার মতো অবিরাম ছুটে চলেছে 'বক্স অব অর্নামেন্টস'। আলছড়া, হুজি হারু, বাজু, চন্দ্রহার, নকশার হাঁসুলি কিংবা রেয়ন সিল্কের গয়না- সব মিলিয়ে ভরপুর 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর ভাণ্ডার।
পাহাড়ের ঐতিহ্যকে সমতলে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা
২০১৭ সালে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিলো 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর পথ চলা। ঋতিষা সেসময় স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। সরকারি চাকরিজীবী বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিলো, মেয়ে পড়াশোনা শেষে সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু ঋতিষার নতুন কিছু করার উদ্দীপনা ও মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার প্রেরণার কাছে সরকারি চাকরির মোহ ধোপে টেকেনি। তাই শুরুটা একা হাতেই করতে হয়েছিলো তাকে।
প্রথমদিকে সমতল অঞ্চলের গয়না দিয়ে শুরু করেছিলেন ব্যবসা। ধীরে ধীরে কাজ করতে গিয়ে অনুধাবন করলেন, আদিবাসীদের গয়নার নিজস্ব কিছু মোটিফ কিংবা প্যাটার্ন আছে। যেগুলো আলাদা স্বকীয়তা প্রকাশ করে। বিস্তর গবেষণা ও ভাবনা থেকে ঋতিষা ঠিক করলেন- পাহাড়ি গয়নার ঐতিহ্যকে সমতলে নিয়ে আসবেন।
ঋতিষা চাকমা বলেন, 'আমাদের হুজি হারু নামে একটি গয়না আছে, যেটি আসলে প্যাঁচানো চুড়ি। আদিকাল থেকেই আমাদের চাকমা মেয়েরা পরতো। এটা রূপাতে হতো সেসময়। আমি এই গয়নাটি প্রথম তুলে আনি; এখন সমতল ও পাহাড়ের সবাই গয়নাটিকে চেনে।'
নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে পুরো দেশকে পরিচয় করানোর জন্য নব উদ্যমে কাজ করতে শুরু করলেন ঋতিষা। শুরুতে চাকমা গয়না দিয়ে শুরু করলেও এখন মনিপুরী, ত্রিপুরা, বান্দরবান অঞ্চলের আদিবাসীদের অপ্রচলিত গয়না নিয়েও কাজ করে ঋতিষার 'বক্স অব অর্নামেন্টস'।
ঋতিষার হাত ধরেই শুরু গয়নায় রেয়ন সিল্কের ব্যবহার
'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, গয়নায় রেয়ন সিল্কের ব্যবহার। রেয়ন সিল্কের মাধ্যমে পাহাড়ি পোশাকের ডিজাইনকে গয়নায় নিয়ে এসেছেন তারা। ঋতিষা জানান, 'রেয়ন সিল্ক ফেব্রিক আমাদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে বোনা হয়। পাহাড়ি নারীরাই এটি বুনে থাকে। এটি আমরা পোশাকেও ব্যবহার করে থাকি। এই ফেব্রিকটি খুব দামি এবং ঐতিহ্যবাহী হওয়ার কারণে কোনোভাবে গয়নাতেও আনা যায় নাকি তা নিয়ে প্রথমে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করি। পরে দেখলাম, এটি গয়নায় বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠে।'
বলে রাখা ভালো, রেয়ন সিল্ক হচ্ছে সেমি সিন্থেটিক ফাইবার; যা মূলত কৃত্রিম সিল্ক। রেয়ন তৈরি হয় গাছ, বাঁশ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ দিয়ে। প্রাকৃতিক সিল্কের তুলনায় দাম কিছুটা কম হওয়ায় এবং বিভিন্ন রং ব্যবহারের সুবিধা থাকায় এটির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
সমতল ও পাহাড়ের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টির লক্ষ্যেই 'বক্স অব অর্নামেন্টস' শুরু করে গয়নায় রেয়ন সিল্কের ব্যবহার। দুটি ভিন্ন অঞ্চলের সমন্বয়ে গয়নার নতুন ধারা তৈরির জন্য এই সিল্ক ব্যবহারের সূচনা করেন ঋতিষা চাকমা। পাহাড়ি পোশাকের নকশার ধারাকে গয়নার মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়টিও ঋতিষার আগে কেউ করেনি। যার জন্য গ্রাহক অঙ্গনেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে গয়নার এই ধারাটি।
তবে গয়নায় রেয়ন সিল্কের ব্যবহার নিয়ে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি ঋতিষাকে। এই সিল্কটি অত্যধিক সূক্ষ্ম হওয়ায় কেটে গয়নাতে ব্যবহার করা বেশ কষ্টসাধ্য। এমনকি ফেব্রিকটি কোনোভাবে নষ্ট হলে তা পুনরায় গয়নার জন্য ব্যবহারও করা যায় না।
সূক্ষ্ম ও জটিল 'রেয়ন সিল্ক' ফেব্রিক
আদিবাসীদের নিজস্ব মোটিফে তৈরী হওয়া এসব গয়নার মধ্যে প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন আনার চেষ্টা করে ঋতিষার 'বক্স অব অর্নামেন্টস'। ঋতিষা নিজেই ডিজাইন করেন সমস্ত গয়না, পাশাপাশি তাকে সহায়তা করার জন্য আরো একজন রয়েছেন। তবে ডিজাইন তৈরি করার পরপরই তারা গয়না তৈরি করতে পারেন না। প্রথমে যেতে হয় 'এক্সপেরিমেন্ট' পর্যায়ে। এর মূল কারণ অবশ্য রেয়ন সিল্কের ফেব্রিক। ঋতিষা বলেন, 'রেয়ন সিল্ক ফেব্রিক এতটাই সূক্ষ্ম এবং জটিল, একটু যদি টান খায় তাহলে সুতা অনেকসময় উঠে আসে। তাই গয়নাতেও গুছিয়ে প্যাটার্ন বসাতে হয় যাতে সুন্দরভাবে থাকে। পরে কোনোভাবে যাতে নষ্ট না হয়।'
সাধারণত সিলভার প্লেট ব্রাস ম্যাটারিয়ালের উপর গয়নার ডিজাইন করা হয়। রেয়নের সুতা থেকে প্যাটার্ন বুনে তারপর সেটি গয়নার উপর বসানো হয়। বড় প্যাটার্নে নিয়ে এসে তা গয়নার মাপে কাটা হয় প্রথমে। পাহাড়ি নারীদের থেকেই তাঁতে বোনা রেয়ন সিল্ক প্যাটার্ন সংগ্রহ করেন ঋতিষা। প্যাটার্ন বসানোর জন্য এক্ষেত্রে বেছে নেয়া হয় গ্লু। তবে সব ধরণের গ্লু এক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য নয়। কারণ অনেক গ্লু রেয়ন সিল্কের রং নষ্ট করে দেয়। রেয়ন সিল্কের উপযোগী গ্লু ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয় এই কাজ।
গয়না তৈরির আনুষঙ্গিক উপাদান পাহাড় ও সমতল উভয় জায়গা থেকেই সংগ্রহ করেন ঋতিষা চাকমা। 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর কারখানা আগে রাঙামাটিতে হলেও বর্তমানে এর অবস্থান ঢাকাতে। কারণ গয়নার জন্য প্রয়োজনীয় মেটাল, রং, পুঁতি বর্তমানে ঢাকা থেকে বেশি সংগ্রহ করতে হয় তাদের।
বানিয়ে নিতে পারবেন নিজের পছন্দসই ডিজাইনে
হাতে তৈরি গয়নাই 'বক্স অব অর্নামেন্টস' এর মূল। ঋতিষা জানান, 'কেউ যদি কাস্টমাইজ করে নিতে চায়, তাহলে আমরা করে দেই। সেটা ব্রাইডালও হতে পারে আবার নরমালও হতে পারে। রেয়ন সিল্কের গয়নার ক্ষেত্রে কেউ যদি আমাদের রংটা জানিয়ে দেয়, তাহলে আমরা সেভাবেই ম্যাচিং করে দেই। রেয়ন সিল্ক জামদানি শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরতে অনেকে পছন্দ করে। আমরা মূলত সিলভার প্লেট ব্রাস ম্যাটারিয়াল নিয়ে কাজ করি। যদি কেউ গোল্ড প্লেটেড গয়না চায়, তাহলে আমরা সেভাবে প্রস্তুত করে দেই। আবার কেউ যদি রূপার চায়, তাও আমরা করে দেই।'
'সবটাই আমরা আমাদের গ্রাহকের পছন্দের উপর ছেড়ে দেই। আমাদের নিজস্ব কিছু গয়নাও রয়েছে। অনেকে সেগুলোও নেয় আর কাস্টমাইজের সুযোগ তো রয়েছেই', জানান বক্স অব অর্নামেন্টসের কর্ণধার।
তিন, চার কিংবা পাঁচ ছড়ার আলছড়া, হুজি হারু, হাঁসুলি, রেয়ন সিল্কের গয়না বক্স অব অর্নামেন্টসের 'সিগনেচার আইটেম'। ঋতিষা বলেন, "রেয়ন সিল্কের গয়না আমাদের এখানে 'বেস্টসেলিং' পণ্য। এটি আমরা কাটাইয়ের উপর করেছি, আবার হাতে তৈরি প্যাটার্নের উপরেও করেছি। বিভিন্ন প্যাটার্নে রেয়ন সিল্ককে আমরা তুলে আনার চেষ্টা করছি। এটি নিয়ে অন্য কেউ কাজ করে না। আমরাই।"
রেয়ন সিল্কের গয়নার খ্যাতি দেশের পাশাপাশি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার অনেক গ্রাহক 'বক্স অব অর্নামেন্টস' থেকে গয়না সংগ্রহ করেছেন। যদিও এখান থেকে সরাসরি রপ্তানির সুযোগ এখনো সম্ভব হয়নি। অন্য গ্রাহকের মাধ্যমেই দেশের বাইরে গয়না পাঠাচ্ছেন ঋতিষা। দেশের ভিতরে ডেলিভারির কাজ ডেলিভারি দেয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকেন। তবে জরুরি ভিত্তিতে কোনো গ্রাহকের চাহিদা থাকলে তা নিজস্ব ডেলিভারিম্যানের মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকেন তারা।
গ্রাহকের চাহিদা সবসময় পূর্ণ করার চেষ্টা করেন 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর কর্ণধার। ঋতিষা জানান, 'অনেকে বিয়ের জন্য আমাদের কাছে গয়নার আবদার করেন। যেটা হয়তো তার বাজেটে থাকে না। তখন আমরা আমাদের প্রফিট মার্জিন একদম কম রেখে গ্রাহকের মনের আশা পূরণ করার চেষ্টা করি। এমন অনেক আপু আছেন, যারা তাদের স্পেশাল দিনে আমাদের গয়না পরে অনেক খুশি থাকেন। আমি যখন তাদের ছবিগুলো দেখি এবং তারা যখন আমাদের বাজেট অনুযায়ী গয়না তৈরির জন্য ধন্যবাদ জানায় তখন অনেক ভালো লাগে।'
১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হওয়া ঋতিষার 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর বর্তমান মাসিক আয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। উৎসব অনুযায়ী আয়ের তারতম্য দেখা যায়। বিজু উৎসব, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা সব ধরণের উৎসবেই গ্রাহকদের পছন্দের শীর্ষে থাকে 'বক্স অব অর্নামেন্টস'।
সেট হিসেবে ২ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার গয়না পাওয়া যায় এখানে। মূলত ডিজাইন, মোটিফ, প্যাটার্ন এগুলোর উপর নির্ভর করে দামের তারতম্য দেখা যায়। রেয়ন সিল্কের কানের দুলের দাম ৯৫০ টাকা থেকে শুরু হয়। আবার রেয়ন সিল্কের আংটির দাম শুরু হয় ৪০০ টাকা থেকে।
ঋতিষা নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা!
ভিন্ন ধরণের গয়না নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কী ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে জানতে চাইলে ঋতিষা বলেন, 'এই গয়না নিয়ে আমরা এখনো সবার কাছে সেভাবে পৌঁছাতে পারিনি। রেয়ন সিল্কের ডিজাইন দেখে এখানে কী ব্যবহার করা হয়- তা অনেকে জিজ্ঞাসা করে। রেয়ন সিল্ক নিয়ে গ্রাহককে বোঝাতে হলে এটার ইতিহাস ধরে শুরু করতে হয় আমাদের। অনেকে দ্রুত বুঝে যায় সবকিছু। আবার অনেকে না বুঝে দামটাও দিতে চায় না সেভাবে। অনেকেই ভাবে যে সামান্য একটা ফেব্রিকের এত দাম কেন। সুতার যে একটা দাম আছে- সেটা বোঝাতে শুরু থেকে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে।'
ঋতিষার অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই। কাজ করতে করতে কখনো হাঁপিয়ে গেলে নিজেই নিজেকে শক্তি জোগান। তিনি বলেন, 'মাঝেমধ্যে এমন প্রেশার যায় নিজের উপর- তখন মনে হয় যে এটা হয়তো অন্য কেউ সহ্য করতে পারবে না। নিজেকেই মোটিভেট করতে হয় তখন।'
ঋতিষার 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এ বর্তমানে ৮ জন কাজ করছে। মাঝখানে কিছুদিন কাজের গতি কম থাকলেও এখন তা আবার বেড়ে গেছে। ঋতিষা বলেন, 'সামনে নতুন ডিজাইনের গয়না তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকাতে একটা স্টোর দেয়ার ইচ্ছাও আমাদের আছে। ছোটবেলা থেকেই গয়না তৈরির প্রতি ভালোবাসা ছিলো। তাই এটা এখন নেশা থেকে পেশা হয়ে গিয়েছে। এখনো প্যাশন আছে বলেই ধৈর্য সহকারে কাজ করতে পারছি।'
কাজের অনন্যতা ও সৃজনশীলতার জন্য ২০২১ সালে ঋতিষা চাকমা 'জয়ী এওয়ার্ড' পেয়েছেন। একই বছর 'সফল উদ্যোক্তা'র পুরস্কারও পান রাঙামাটি জেলা পরিষদ থেকে।
ঋতিষার দাবি, নিজেকে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হিসেবে এখনও তৈরি করতে পারেননি তিনি। তবে তাকে দেখে পাহাড়ের অন্য মেয়েরা অনুপ্রাণিত হয়ে গয়না তৈরি করছে- সেটাতে ভীষণ খুশি ঋতিষা। একগাল হেসে বলেন, 'অন্যরা যখন আমাকে দেখে গয়না নিয়ে কাজ করে, সেটা আমাকেও অনুপ্রাণিত করে। আমি তো অন্তত কিছু মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।' তাই আর অন্য কিছু নয়, নিজের প্যাশনকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে চান 'বক্স অব অর্নামেন্টস'-এর ঋতিষা চাকমা।