বাংলায় রোজার ৮০০ বছর
বাংলায় মোগলরা আসার আগেও প্রায় ৩০০ বছর টিকে ছিল সুলতানী আমল। তবে সেকালের রোজা-রমজানের চিত্র সেভাবে পাওয়া যায় না। যদিও ১৩ শতকেই খ্যাতনামা ইসলামী আইনবিদ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন । সেখানে গণিত, ভূগোল আর রসায়নশাস্ত্র পড়ানো হতো। তারও আগে আমরা উত্তরবঙ্গে শাহ সুলতান মাহিসওয়ারের কথা জানতে পারি। বিক্রমপুরে বাবা আদম শহীদের খবর পাই ১১২৯ সালের দিকে। তবে সুফিরা ধর্মপ্রচার করতেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে। তাঁরা গড়ে তুলতেন লঙ্গরখানা, মুসাফিরখান, চিকিৎসালয়। অনেক খানকায় বড় বড় গ্রন্থাগারও ছিল। তবে বলে রাখা ভালো, বাংলার গণমানুষের মধ্যে তখনো পর্যন্ত ইসলামী আচার-প্রথার ব্যাপক প্রসার ঘটেনি।
বাংলায় প্রথম মোগল সুবা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬১০ সালে। সুবাদার হন ইসলাম খাঁ। তাঁর ঢাকায় আগমনের পর মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র বদলে যেতে থাকে। সেসময় মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠে। রমজানের দিনে পাড়া-মহল্লাগুলো বিশেষ বিশেষ আয়োজনে মেতে উঠত। ধর্মীয় গোত্র-উপগোত্র ছিল কম, তবে পাড়াওয়াড়ি উৎসব আয়োজনকারী দল ছিল, যারা পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেরা হয়ে উঠতে চাইত।
গোড়ার দিকের ইফতারের বিবরণ আমরা পাই মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের বাহারিস্থান-ই-গায়বীতে। সময়টা ১৬১০ এর আশপাশেই হবে। নাথান ভেবেছিলেন, আহা! রমজানটা যদি রাজধানী দিল্লীতেই কাটানো যেত পরিবারের সঙ্গে তাহলে কতই না আমোদ হতো। কিন্তু সেনাপতি তিনি, যুদ্ধের ময়দানই তার ক্রীড়াক্ষেত্র। তাই পড়ে থাকতে হচ্ছে বাংলায়। এসব মনে করতে করতেই এগোলেন বন্ধু মির্জা আলম বেগের তাঁবুর দিকে। আজ তিনি তারই মেহমান। মন আনমনা ছিল বলেই কি-না একটু দেরি হয়ে গেল। তবে তাঁবুর পর্দা সরিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। দেখলেন আয়োজন মন্দ নয়।
মোগলরা রসনাবিলাসী ছিলেন। যুদ্ধজয়ের পর তাঁরা যে ভোজ দিতেন তার বর্ণনা দিতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ফুরায়। তাঁরা যাত্রাকালে- তা সে যুদ্ধযাত্রা হোক বা মৃগয়া- বাবুর্চি সঙ্গে নিতেন ডজন ডজন। ঢাকার মোগল রসুইখানায়ও অনেক মোগল বাবুর্চি ছিল। নান-তাফতান (বাদামযুক্ত রুটি), শিরমাল (সুজির তৈরি রুটি) আর বাহারি সব কাবাব তৈরিতে তাদের জুড়ি ছিল না। পারসান্দের শিক কাবাব, সুতলি কাবাব, মোসাল্লাম কাবাব, শামি কাবাব, হান্ডি কাবাবের সুবাস ছাড়া মোগল রসুইঘরের কথা কি ভাবা যায়? মাছের কাবাবও মোগল বাবুর্চিরা তৈরি করতে জানতেন। বিরিয়ানী, কিমা, পোলাও আর বাকরখানিও থাকত তাদের ইফতারে।
নাথান তাঁর বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে উল্লেখ করছেন, কামান থেকে তোপ ছুঁড়ে ও বন্দুকের গুলিবর্ষণ করে রমজানের আগমনী ঘোষণা করা হতো সেসময়, আর এ রীতি বহাল ছিল উনিশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত। তারপর শাহ সুজা সুবাদার হলেন, ১৬৩৯ সালের কথা, ঢাকায় আসে ৩০০ শিয়া পরিবার। তাঁরা খোরাসানি পোলাও দিয়ে ঢাকার বাতাস সুবাসিত করে ফেলে। মোগল বাবুর্চিরা জিলাপি তৈরিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তবে গরমের দেশ হওয়ায় ইফতার শুরু হতো শরবত দিয়ে।
তবে, তখনকার যতসব বর্ণনা তার প্রায় কোনোটাতেই গরীব মানুষের ইফতার ও রমজান আয়োজনের কোনো খবর আমরা পাই না। অথচ মোগল আমীর-ওমরাওদের সেবাদানকারী যেমন বাবুর্চি, ভিস্তিওয়ালা, মালি, সাফাইকারী, বস্ত্রবয়নকারী, সেনাসদস্য, ঘোড়া পরিচর্যাচারী, ওস্তাগারদের অনেকেরই মুসলমান হওয়ার কথা আর তাদের সংখ্যা আমীরদের কয়েকগুণ হলে তবেই তা মানানসই হয়। কিন্তু তাদের খবর পাওয়ার সুযোগ নেই কারণ তারা নিজেরা লেখাপড়া জানত না। তাই 'তারিখ-ই শেরশাহী' বা 'তারিখ-ই ফিরুজশাহীর' মতো 'তারিখ-ই-জমির বাবুর্চি' লেখা হয়নি, আমাদেরও জানার সুযোগ হয়নি কী খেত, কোথায় ঘুমাত, কী পরত তারা!
বরিশালের আমিনউদ্দিন
চারশ বছর পরের কথা। ঢাকা জজ কোর্টের উল্টোদিকে সেন্ট টমাস চার্চের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা কলতাবাজারের দিকে গেছে তার কোনাতেই চাঙারিতে কলা নিয়ে বসেছিলেন আমিনউদ্দিন তালুকদার। বয়স তার সত্তর। বাড়ি বরিশালের টরকীতে। ঢাকায় এসেছেন ২৫ বছর হলো। বাড়িতে থাকতে ভেজাল বা ডুপ্লিকেটের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। তখন হাতালে (গোলাঘর অর্থে) মুরগী ছিল, চাউল ছিল, গোয়ালে গরু ছিল। পুকুরে মাছও পাওয়া যেত অনেক। এছাড়া বাড়ির লাগোয়া ক্ষেতে পাওয়া যেত কলমী শাক আর পাট শাক। ইফতারে কলমী শাক দিয়ে ফ্যানা ভাত খাওয়ার স্বাদ আজো তার মুখে লেগে আছে।
জিনিসপত্র তখন এমনই খাঁটি ছিল যে অল্পেই কাজ চলে যেত। এই যেমন সরিষার তেলের কথাই ধরা যাক, এক ছটাক কিনলে গায়ে-পায়ে মেখে আর রান্না-বান্না করে দু দিন চলে যেত। তার ছোটবেলায় পুরা এলাকায় তিনি দুটি মসজিদ দেখেছেন- একটা তাদের নিজেদের বাড়িতে আরেকটা বাজারে। তারাবিহের নামাজও হতো বাড়িতেই । তখন বাজারে সিঙ্গারা-বেগুনী বলে কিছু পাওয়া যেত না। ইফতারে মুড়ি, আটা নইলে চালের রুটি খেতেন আর পান্তা ভাত খেতেন দুই তিন পদের মাছ দিয়ে। ইফতারের পরে বয়স্ক লোকেরা তামাক খেত। দিনের বেলায় বাড়ির মহিলারা দুপুরের আগে চহি (একরকমের সেমাই) বানাতে বসত।
আমিনউদ্দিন ঢাকায় আসার পর ভেজালের মধ্যে পড়লেন, পুরোনো দিনগুলো তার মনে পড়ে আর কেবল আফসোস করেন। ঢাকায় তিনি ইফতার করেন রাস্তাতেই। তার মতো আর যারা রোড বিজনেস করে মানে রাস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করেন তারা একসঙ্গে কোথাও গোল হয়ে মুড়ি ভর্তা, শরবত আর ফল দিয়ে ইফতার করেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই আগের স্বাদ তিনি পান না।
স্টার হোটেলে আড়াইটায়
আগে থেকেই সূফী ভাইয়ের (ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী) সময় নেওয়া ছিল। স্টার হোটেলে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। সবসময় টিপটপ থাকেন সূফী ভাই। বয়স ৭৫ পেরিয়েছেন গত বছর। এখনো চোখে ভালো দেখেন, কানে ভালো শোনেন, হাঁটাচলায় তেমন অসুবিধা বোধ করেন না। সবচেয়ে ভালো তাঁর স্মরণশক্তি। শবে বরাত দিয়ে আলাপ শুরু করলেন।
তাঁদের ছোটবেলায় এ দিনটা আসত রমজানের আগমন বার্তা নিয়ে। ঢাকায় তখনো মসজিদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। মোগল আমলে তৈরি হওয়া মসজিদগুলোয় (পাকা গম্বুজ মসজিদ) চৌবাচ্চা থাকত। ভিস্তিওয়ালারা (যারা চামড়ার মশকে পানি বহন করত) দফায় দফায় পানি এনে চৌবাচ্চা ভরে দিয়ে যেত। পাড়ার লোক সে পানি দিয়ে মসজিদ ধোয়া মোছা করত। আরেকদল দিলি (মাটির প্রদীপ) বানাতে বসত। দিলির জ্বালানী হতো সরিষার তেল, পুরনো সলতে দিয়ে জ্বালাতে হতো। মসজিদের বারান্দার দেয়ালে সেগুলো বসানো হতো। শুনে আমার মনে হলো দীপাবলির কথা। ব্যাপারটি খোলাসা করতে বললে সূফী ভাই হেসে ফেললেন। বললেন, এর উৎস তো ইরান, সংস্কৃতিটা জরাথুস্ত্রীয়। ভারতবর্ষ এটা নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে বেশ অনেক দিন পরে, যদিও এই সময়টার বয়সও কম হলো না।
শবে বরাতের খাবারের মধ্যে রুটি আর হালুয়া ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আটা আর চালের রুটি হতো। হালুয়া হতো কয়েক পদের – বুটের, গাজরের, ডালের ইত্যাদি । মাগরিবের আগে আগে বাড়ি বাড়ি হালুয়া পাঠানোর ধুম পড়ে যেত। মাগরিবের পরে ছেলেরা দল বেঁধে এ মসজিদ থেকে সে মসজিদ ঘুরে ঘুরে বেড়াত আর পটকা ফোটাত।
একটা নাম মনে পড়ছে শবে বরাত প্রসঙ্গে, তাঁর নাম ছিল মীর আবু সায়ীদ। নায়েবে নাজিমদের আমলে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ১৮৫৭ সালের আগে পর্যন্ত তিনি ঢাকার মসজিদগুলোয় তেহারী পাঠাতেন। শাল পাতার ঠোঙায় করে সে তেহারী বিলি করা হতো। তখনকার ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা গুনেই বলা যেত। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ রেওয়াজ বহাল রেখেছিলেন মীর্জা কাদের সরদারও। তিনি ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বশেষ সর্দার প্রধান ছিলেন।
তখনকার ঢাকায় আজকের মতো এতো ভিক্ষুক ছিল না। শবে বরাতে গৃহস্থ বাড়িতে ভিক্ষুক এলে তাকে বলা যায় সমাদর করা হতো। তখন ঢাকায় ইলেকট্রিক বাতি এসেছে, গ্যাসের বাতিও শেষ হয়ে যায়নি, তবে একটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেকটা পোস্ট ছিল বেশ দূরে দূরে। তাই এখানে সেখানে অন্ধকার জমে থাকত। দুষ্ট ছেলের দল মাথা চাদরে ঢেকে নিজেদের বাড়ি গিয়েই বলত আম্মা কিছু দিবেন নি গো। আসল উদ্দেশ্য ছিল হালুয়া খাওয়া। এসব নিয়ে মজাতেই কাটত শবে বরাত। শবে বরাতে সূফী ভাইয়ের নিজের শিরবেরেঞ্জ নামের একটা খাবারের ওপর খুব আগ্রহ ছিল। এটা ছিল শরবতের মতো তরল। দুধ, চিনি আর পোলাওয়ের চাল দিয়ে তৈরি হতো, বন রুটির মতো একটা রুটি ভিজিয়ে খেতে হতো। খুব সুস্বাদু ছিল।
সূফী ভাই একটু বিরতি নিলে আমি জানতে চাইলাম, শুনেছি হাজী শরীয়তউল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের আগে বাংলার মানুষ ইসলামের রীতি রেওয়াজ (কিভাবে নামাজ পড়তে হয়, রোজা কিভাবে রাখতে হয় ইত্যাদি ফরজসমূহ) ভালোভাবে জানত না, এটা কতটা সঠিক?
সূফী ভাই বললেন, 'বাংলায় ইসলাম এসেছে তিনভাবে- বণিকদের মাধ্যমে, মিশনারি বা সূফি দরবেশদের মাধ্যমে আর রাজনৈতিকভাবে। ঢাকায় ৭৫০ থেকে ১২২৯ পর্যন্ত ছিল পাল ও সেন আমল। তারপর খিলজিদের মাধ্যমে শুরু হয় তুর্ক, আফগান, পাঠান আমল। তখন কিন্তু দলে দলে মুসলমান এসেছে বাংলায়। তারা উত্তরাধিকারসূত্রে ধর্ম পেয়েছে। তাই ধর্মের ফরজিয়াত অনেকটাই তাদের জানা থাকবার কথা। সূফী বা গাইডদের মাধ্যমে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে তাদের কাছে ধর্ম পৌঁছেছে কিছুটা অদল বদল হয়েই। সূফীরা তরবারি হাতে নেননি, জবরদস্তি করেননি ধর্মের নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে।'
'ধর্মান্তরিতরা যেহেতু বংশপরম্পরায় সনাতনী রেওয়াজ মেনে চলত তাই ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও তারা পূর্বতন রীতি থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। একধরণের মিশ্র ধর্ম পালন করত তারা। মসজিদ-মাদ্রাসাও ছিল না অনেক। তাই হাজী শরীয়তউল্লাহ মক্কা ঘুরে আসার পর থেকে একটা সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল যা মূল ইসলামের অনুগামী বলা যেতে পারে। তবে এ সময়টা কিন্তু উনিশ শতকের শেষভাগ। বিশ শতকেও আমরা তাই মিশ্র সংস্কৃতির নজীর পাই,' বলেন তিনি।
আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) আত্মজীবনী আত্মকথায় যেমন পাওয়া যাচ্ছে, 'সে সময় বয়স্করাও সকলে রোজা রাখত না। দিনের বেলা তারা তামাক ও পানি খেতো। শুধু ভাত খাওয়া থেকে বিরত থাকতো। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোজা নষ্ট হতো না—এই বিশ্বাস ছিল তখন তাদের মনে।' তবে এটা ছিল গ্রামের কথা। শহরের লোকজন, বিশেষত ঢাকার লোকজন ছিল ব্যতিক্রম।
গ্রামের তুলনায় শহুরে মানুষের মধ্যে রোজাদারের সংখ্যা বেশি ছিল, এ তথ্য পাওয়া যায় মোহাম্মদ আবদুল কাইউমের চকবাজারের কেতাবপট্টি বইয়ে। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, তখনকার ঢাকাইয়া মুসলমানরা শরিয়তের অন্যান্য বিষয় মানুক আর না মানুক, কিন্তু রমজান মাসে তারা ছিল খুবই তৎপর ও আবেগপ্রবণ। তখন এ মাসকে স্বাগত জানাতে তারাবিহর আয়োজন, সাহরিতে লোকজনকে জাগিয়ে তোলার জন্য যুবদল গঠন, কাসিদার আয়োজনসহ অনেককিছুর ব্যবস্থা হতো।
ইফতারকে তখন রোজাখোলাই বলা হতো। আর রোজাখোলাইয়ের বড় অনুষঙ্গ ছিল শরবত। শবেবরাতের পর থেকেই মাটি বা কাসা-পিতলের কলসিগুলোকে উত্তমরুপে ধোলাই করা হতো আর গোলাপ জল মাখিয়ে সুবাসিত করা হতো। তখন বরফকল ছিল না বলে কলসিগুলো নানান পদের শরবত দিয়ে পূর্ণ করার পর মুখ বন্ধ করে কুয়োর ভিতর ডুবিয়ে রাখা হতো। ইফতারের আগে আগে সেগুলো কুয়া থেকে তুলে আনা হতো কারণ ততক্ষণে সেগুলো হিমশিতল হয়ে যেত। শরবতের প্রধান উপকরণ হতো দুধ, সঙ্গে মেশানো হতো বাদাম, কিশমিশ, পেস্তা, জাফরান ইত্যাদি। খাবারের পদ কী হবে না হবে সেটি সভা করে ঠিক করতে হয়নি তা বলাই বাহুল্য। তবে শরীয়তের ব্যাপারে মাহফিল করতে হয়েছে, ওয়াজ করতে হয়েছে। সম্ভবত শরীয়তউল্লাহ'র আন্দোলনের পরেই খতমে তারাবিহ বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মিশ্র সংস্কৃতির কারণেই আশরাফ-আতরাফ ভেদ আমরা মুসলমান সমাজেও দেখতে পেয়েছি, তাই নয় সূফী ভাই? প্রশ্নটি সূফী ভাই খুব সরলভাবে নিলেন না। তিনি বললেন, 'এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণও কম নেই। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা আপন ভাই-বোনদের মধ্যেও ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এর প্রকাশ বিভিন্ন রকম হয় অবশ্য। যেমন ধরুন অভিজাত কোনো মুসলমান পন করেছেন চাষা ইমামের পেছনে নামাজ পড়বেন না, অথচ এটা ইসলামের মূলনীতির মারাত্মক খেলাফ। ইসলাম সাম্যের বাণী নিয়েই পৃথিবী জয় করেছে। কাজেই শ্রেণীভেদের যে গতানুগতিক রূপ আমরা এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিতে দেখি সেটা ইসলামে প্রযোজ্য নয়।'
মজার ব্যাপার দেখুন, অভিজাত ঢাকাইয়ারা কিন্তু বাজার থেকে ইফতার কিনত না। এটা তাদের আভিজাত্যেরই অংশ ছিল। ব্যাপারটি এমন- তাদের রুচি-পছন্দ তাদের ঘরেই মওজুদ, বাজার তা বুঝে ফেললে আভিজাত্য থাকে কী করে!
এবার সূফী ভাই প্রথম রোজার চাঁদ দেখা নিয়ে কিছু বলতে বললাম। কোনো কোনো বইতে লেখা দেখেছি, লোকে নৌকা নিয়ে বুড়িঙ্গার মাঝখানে চলে যেত, আপনি জানেন?
সূফী ভাই বললেন, 'আমিও শুনেছি ওসব কথা। তবে এটা মজার ব্যাপারই বটে, বুড়িগঙ্গা সেসময় বিনোদন কেন্দ্র ছিল, অন্তত আজকের বুড়িগঙ্গার সঙ্গে তার তুলনা চলে কই! যেহেতু পশ্চিমে সূর্য ডোবা বুড়িগঙ্গা থেকে ভালো দেখা যেত তাই চাঁদের উদয়ও সেদিক দিয়েই ভালো দেখা যেত। কিছু লোক যে ডিঙ্গি নিয়ে মাঝ নদীতে চলে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য। শুনেছি কিছু লোক উঁচু গাছের মগডালে চড়ে বসত, মসজিদের মিনার থেকেও চাঁদ দেখার চল থেকে থাকবে। আর চাঁদ দেখা যাওয়ার পর তো পটকাবাজিতে কান ঝালপালা হয়েই যাবে। তোপও দাগানো হতো নবাববাড়ি থেকে।
জানতে চাইলাম, ঢাকায় ভাজা-পোড়ার চল শুরু হলো কখন থেকে? সূফী ভাই বললেন, 'চকবাজার শামী বা সূতি কাবারের জন্য বিখ্যাত ছিল সেই মোগল আমল থেকেই। হালুয়া আর শরবতও ভালো পাওয়া যেত। কিন্তু পাকিস্তান আমলেও পাড়ায় পাড়ায় ভাজা-পোড়ার দোকান গড়ে ওঠেনি। এটা আশির দশক থেকে বেশি দেখছি। মানুষ আগে বরং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেত ইফতার সাহরিতে। এখন খায় মুখরোচক সব খাবার।'
ইফতারের সময় সাইরেন বাজানোর ব্যাপারটি কি অনেক পুরোনো? বললেন, 'এই কার্যক্রম জেলায় জেলায় ডিসি সাহেবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। স্বাধীনতাপূর্ব ঢাকায় যে পাঁচটি থানা ছিল তার প্রতিটির ছাদে সাইরেন ছিল। তারা ইফতার শুরু ও সেহরি শেষ হওয়ার সময় সাইরেন বাজাত। প্রশাসনের আহ্বানে এই কাজটি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানও করত। যেহেতু সময় জানানোর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাইরেন থাকেই, তাই রমজানে তারা বিশেষ সেবা হিসেবে ইফতার ও সাহরির সময়জ্ঞাপনে সাইরেন বাজাত। নির্দিষ্ট সময় জানিয়ে ডিসি অফিস থেকে তাদের কাছে চিঠি প্রেরণ করা হতো। ঢাকার হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির কথা যেমন এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে।'
ক্বাসিদা প্রসঙ্গে এবার কিছু কথা আমাদের জানাতে অনুরোধ করলাম সুফী ভাইকে। বললেন, 'গবেষক শায়লা পারভীন 'ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ক্বাসিদা' নামে সুন্দর একটি বই লিখেছেন। সেখান থেকেই উদ্ধৃত করা যায়: রমজানকে কেন্দ্র করে উর্দু-ফারসি ও বাংলায় লেখা হতো বিভিন্ন গজল ও কাসিদা। তবে অধিকাংশ কাসিদাই ছিল উর্দুতে। এর মধ্যে বিখ্যাত দুটি কাসিদা ছিল এরকম: আল্লাহ্ কা বান্দেকো হাম আয়ে জাগানে কো (আল্লাহর বান্দাদের আমরা জাগাতে আসছি) ও রোজদারও জাগো ওঠো, এ রাত সোহানি হ্যায় (রোজাদারেরা ঘুম থেকে ওঠো, এ রাত খুবই মনোরম)। এছাড়া আরো তিন ধরনের কাসিদার উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন গবেষক। যেমন চানরাতি আমাদ (রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে ৫ থেকে ১০ রোজা পর্যন্ত গাওয়া হতো), খোশ আমদেদ (রমজানের মধ্যভাগ পর্যন্ত গাওয়া হতো, রোজা ও রোজাদারদের গুরুত্ব বর্ণনা করে) আর শেষ ভাগে গাওয়া হতো আলবিদা (রমজান মাসকে বিদায় জানানো হতো বিরহমূলক এই কাসিদার মাধ্যমে)।
ঈদের বাজার কোথায় করা হতো জানতে চাইলাম। সূফী ভাই জানালেন, তেল, মশলা, পোলাওয়ের চাল ইত্যাদির জন্য মৌলভীবাজারের কোনো বিকল্প ছিল না। আর পোশাক-আশাক? বললেন পাটুয়াটুলি ও সদরঘাটের কথা। পাটুয়াটুলিতে একটা সুইংডোর এসি দর্জিঘর ছিল। আগাখানী কেউ একজন এর মালিক ছিলেন বলে মনে পড়ছে। সেলাই ফোড়াইয়ের কাজে, অর্থাৎ খলিফাগিরিতে মুসলমানদের সমকক্ষ কেউ ছিল না। আরেকটা পেশায় তারা খুব ভালো করতেন তা হলো বেকারি আইটেম তৈরিতে। জানতে চাইলাম সাহরিতে সাধারণত কী ধরণের খাবার খাওয়া হতো? সূফী ভাই বললেন, 'দুধ-ভাত সাহরির জনপ্রিয় খাবার। আরেকটা খাবার রাবড়ি বলে পরিচিত। এখনো মরনচাঁদ, কালাচাঁদ, আর সীতারামের দোকানে তৈরি হয়, সেটা খাওয়ার চল ছিল। তখন এর দাম অনেক। ধনী ব্যক্তিরা ছাড়া বেশি কেউ একটা খেতে পারত না।'
মসজিদ পাকা ইমান কাঁচা
বয়স বললেন ছেষট্টি। পুরো নাম মো. ফারুক। তার পিতা পাটুয়াটুলিতে ফ্রাঙ্কিং মেশিনে খাম বানানোর কাজ করতেন। ফারুকও পড়াশোনা বেশি করতে পারেননি। লেদ মেশিনের কাজ করেছেন। কিন্তু ছোটখাটো অসুখের শরীরে বেশি রোজগারের সুযোগ তিনি করে উঠতে পারেননি। এখন শরীর ভেঙে পড়েছে আরো বেশি করে। কিন্তু কথা বলেন খুব পরিস্কার।
তার আসল বক্তব্য হলো, 'এখন মসজিদ হয়েছে পাকা কিন্তু ইমান হয়েছে কাঁচা। অনেক লোক মসজিদে যায় কিন্তু নামাজ হয় কয়জনের? ইফতারের আগে দোকানগুলোতে এতো ভিড় হয় যে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না। অথচ উসুলমতো (সব নিয়মকানুন মেনে) রোজা রেখেছে এমন লোক বেশি পাবেনই না। এখন খাবারে যেমন ভেজাল মানুষের মধ্যেও ভেজাল। সামনে কপালে কী আছে আল্লাহই ভালো জানেন।'