টার্ফ কোর্ট: খেলা শুরু!
সন্ধ্যা নামতেই কৃত্রিম মাঠের চারদিক থেকে বাতি জ্বলে উঠলো। পাঁচ জন করে দুই দলের মোট ১০ জন খেলোয়াড় — সবাই বেসরকারি কোম্পানির কর্মী, নামলেন মাঠে।
এবার শুরু হলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জম্পেশ ফুটবল ম্যাচ।
একঘণ্টা পর ম্যাচ শেষের হুইসেল বাজতেই সবাই গেলেন পাশের ফুডকোর্টে, হালকা পানাহার আর আড্ডা চললো সেখানেই।
নগরীর জীবন যখন খোলামেলা জায়গা, খেলার মাঠের অভাবে বিষিয়ে উঠেছে, তখন এরকম কৃত্রিম মাঠ – যা ঢাকার ১৪টি বাণিজ্যিক টার্ফকোর্টের মধ্যে একটি – যেন এক টুকরো মুক্তির সুবাতাস।
খাবারসহ কৃত্রিম এই মাঠগুলো ভাড়া নেওয়াটা বেশ ব্যয়বহুল; তারপরও সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি যারা এভাবে কাটাতে পারছেন, তাদের আনন্দ উদ্ভাসিত মুখ দেখলে এই মূল্যকে যথার্থই মনে হয়।
এভাবে কৃত্রিম মাঠ বা টার্ফকোর্টের ব্যবসার স্ফীতি শুধু ঢাকাতেই আর সীমাবদ্ধ নেই।
এই ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ধরনের সাতটি মাঠ রয়েছে চট্টগ্রামে, আরো সাতটি রয়েছে সিলেটে।
ইনডোর এই মাঠগুলোয় রাবারের তৈরি একপ্রকার কৃত্রিম ঘাস লাগানো থাকে, তাতে চোট লাগার ঝুঁকি অনেকটাই কম থাকে।
দেশে কৃত্রিম মাঠের ব্যবসা যেভাবে শুরু হয়
২০১৮ সালের মাঝামাঝি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি ফুটবল টিম সর্বপ্রথম 'এনডিসি স্পোর্টস ফ্যাসিলিটি' নামক একটি কৃত্রিম মাঠ তৈরি করে এবং শুধু তাদের নিজেদের খেলাধুলার জন্য ব্যবহার শুরু করে। ওই বছরের শেষের দিকে বসুন্ধরায় ১৬ কাঠা জমিতে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে 'জাফ এরিনা' নামের আরেকটি কৃত্রিম মাঠ চালু করা হয়। এরপর এনডিসি স্পোর্টস ফ্যাসিলিটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাঠ ভাড়া দেওয়া শুরু করে।
উদ্যোক্তাদের ভাষ্য – শহরের মাঠগুলো বিলীন হওয়ার কারণে কৃত্রিম এই মাঠগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে খুব দ্রুত। এছাড়া, বাণিজ্যিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও স্বল্প পরিসরের ফুটবলের জন্য এসব মাঠের ওপর নির্ভর করতে হয় ক্রীড়া অনুরাগীদের।
প্রথম বাণিজ্যিক টার্ফকোর্ট জাফ এরিনার উদ্যোক্তা ইকবাল হায়দার গালিব একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা; তিনি এই নতুন ধারা যুক্ত করার গল্পটি বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে। গালিব বলেন, "২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে মাঠ রক্ষার আন্দোলন নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছিল। তখন আমি চিন্তা করলাম— মাঠের সংকট কীভাবে পূরণ করা যায়।
"আমি দেশের বাইরে কৃত্রিম মাঠের ব্যবস্থাপনা দেখেছি। তাই কাছের একজন সিনিয়র ভাইকে নিয়ে শুরু করেছিলাম টার্ফকোর্ট। শুরুতে চিন্তায় ছিলাম বাণিজ্যিকভাবে সফল হবো কিনা, তবে আশঙ্কা দূর হয়ে যায় মানুষের আশাতীত সাড়া পেয়ে।"
ইকবাল জানালেন, তার ব্যবসা শুরুর প্রথম বছরে শুধু দুটি টার্ফ ছিল ঢাকা শহরে। "এরপর আরো অনেকেই এই ব্যবসা শুরু করেন।"
বর্তমানে রাজধানীতে যেসব কৃত্রিম টার্ফ বা মাঠ রয়েছে, সেগুলো হলো - মোহাম্মদপুরে আলফা স্পোর্টস; পিলখানা সড়কে ডিএসএফ; মাটিকাটার ক্লাব ভল্টা; পল্লবীতে ডিবক্স স্পোর্টস কমপ্লেক্স এবং অফসাইড হোম অব ফুটবল; বসুন্ধরায় জাফ এরিনা, চট্টোটার্ফ, দ্য স্টেডিয়াম এবং এনডিই; পূর্বাচলে মেট্রোপ্লেক্স স্পোর্টিং, কিক অফ ফুটবল গ্রাউন্ড; উত্তরায় টার্ফ গ্রাউন্ড; এবং ১০০ ফিটে শেফস টেবল, ফলস ৯।
চট্টগ্রামে সম্পন্ন তরুণদের হাতে টার্ফকোর্টের ব্যবসা
২০২০ সালে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় নিজস্ব জমিতে প্রথমবারের মতো টার্ফকোর্ট তৈরি করেন এশিয়ান অ্যান্ড ডাফ গ্রুপের পরিচালক ওয়াসিফ সালাম। প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে কৃত্রিম মাঠটি করা হয় শুধু তার নিকটজনদের খেলার জন্য। এটি বাণিজ্যিক নয়।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে বন্দর নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় চট্টোটার্ফ নামে প্রথম বাণিজ্যিক টার্ফকোর্ট শুরু করেন ওয়েস্টার্ন মেরিন গ্রুপের কর্ণধার সাখাওয়াত হোসনের দুই ছেলে ওয়াইস হোসেন ও আওসাফ হোসেন।
বর্তমানে এখানে প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে গেম জোন গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে দুটি টার্ফকোর্ট, একটি হাফ বাস্কেট কোর্ট, ক্রিকেট কোর্ট, একটি বাচ্চাদের খেলার জায়গা, দুটি গেমিং জোন, একটি টেবিল টেনিস কোর্ট, পুল টেবিল, একটি পেইন্ট বল স্টেশন ও রেস্তোঁরা রয়েছে।
ওয়াইস হোসেন বলেন, "আমি নিজেও ফুটবল খেলি। চট্টগ্রামে খেলার মাঠ কমে আসায় এ উদ্যোগ। ঢাকাতেও আমাদের একটি টার্ফকোর্ট রয়েছে। এর বাইরে নগরীর চকবাজার বালি আর্কিডের ১২ তলায় টার্ফকোর্ট করছি। আমাদের গেমিং জোন সেখানে শিফট করা হচ্ছে।"
ভবিষ্যতে সিলেট, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টার্ফকোর্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
কৃত্রিম মাঠের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আওসাফ হোসেন বলেন, "এখানে ভাড়া ছাড়াও টুর্নামেন্ট সংক্রান্ত ব্যবসা আছে। আমাদের এখানে অনেক কর্পোরেট গ্রাহক রয়েছেন। যেমন সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকার বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বুকিং থাকে।"
করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালে পরিবারের সদস্যদের খেলার জন্য চট্টগ্রাম নগরীর কাপ্তাই রাস্তার বাহির সিগন্যাল এলাকায় নিজস্ব জমিতে কৃত্রিম খেলার মাঠ করেছিলেন সিকো গ্রুপের কর্ণধার এ এম এম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী।
নগরীতে মাঠের চাহিদা বাড়াতে থাকায় ২০২২ সালের মার্চে সিকো এরিনা' নাম দিয়ে এটিকে বাণিজ্যিক টার্ফকোর্টে রূপান্তর করা হয়। প্রকল্পটির দেখভাল করেন সাইফুল ইসলামের ভাগ্নে ও সিকো গ্রুপের পরিচালক ইশমাম চৌধুরী।
ইশমাম বলেন, "এক একর জায়গাজুড়ে প্রকল্পটি করা হয়েছে। এখানে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, পেইন্ট বল, টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল কোর্টের পাশাপাশি ভিআর ও কিডস গেম জোন রয়েছে।"
চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়ী চাঁন মিয়া সওদাগর পরিবারের পাঁচ তরুণ মিলে ২০২২ সালের শুরুর দিকে নগরীর চাঁদগাওয়ে তৈরি করেছেন ফরচুন স্পোর্টস এরিনা। এর উদ্যোক্তা সায়মন সাদাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা নিজেদের ৪০ কাঠা জমিতে পুরো প্রকল্পটি করেছি। টার্ফকোর্টের প্রচলিত ধারার বাইরে আমরা আরো কিছু সেবা যুক্ত করতে যাচ্ছি।
"আমাদেরটাই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় কোর্ট অর্থাৎ এখানে দুই দলে মোট ১৬ জন খেলতে পারেন। মাল্টিপল প্লে ফিল্ড অর্থাৎ একই মাঠে একাধিক খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। ফিফা স্বীকৃত কোম্পানি থেকে কৃত্রিম টার্ফ আমদানি করা হয়েছে। ক্রিকেটের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে পিস আনা হচ্ছে। এছাড়া সুইমিংপুল, ফাইন ডাইনিং এবং বাচ্চাদের শিক্ষামূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে।"
এছাড়া, চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় কেবি টার্ফ, কাতালগঞ্জে এসিএম টার্ফ, জিইসিতে ডাগআউট টার্ফ এবং মেরিন ড্রাইভে হালিশহর টার্ফ রয়েছে।
নগরীর বায়েজিদ লিংক সড়ক এলাকায় বড় পরিসরের টার্ফকোর্ট তৈরি করছেন পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ মহসিনের ছেলে ভিক্টর মহসিন। তিনি জানান, "চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় অ্যাস্ট্রো টার্ফকোর্ট (কৃত্রিম মাঠ) তৈরি করছি আমরা। প্রায় ১৫,৮০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে টার্ফ করা হবে।
"এছাড়া ইনডোর ব্যাডমিন্টন, বাস্কেট বল, ক্রিকেট কোর্টও থাকবে। পুরো প্রকল্পটি করা হচ্ছে এক একর জমিতে। বড় মাঠ করা হয়েছে মূলত স্কুল-কলেজের বিভিন্ন আয়োজনের জন্য। আগামী জুন-জুলাইয়ে চালুর চিন্তা রয়েছে।"
টার্ফ ব্যবসায় বিনিয়োগ ও আয়
টার্ফ ব্যবসার জন্য কতোটা বিনিয়োগ দরকার হয় তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে চাননি উদ্যোক্তারা। তবে তারা বিনিয়োগের পরিমাণ ও আয় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তারা জানান, টার্ফকোর্টের বিশেষ কৃত্রিম ঘাস আনা হয় চীন থেকে। এছাড়া এ ধরনের খেলার মাঠ তৈরির জন্য লোহার অ্যাঙ্গেলসহ বিভিন্ন কাঠামো দরকার হয়।
একটু ফুটবল কোর্ট ভাড়া নিতে প্রতি ঘণ্টায় দিতে হয় ২-৩ হাজার টাকা, পুরো দিনের জন্য নিলে খরচ পড়বে ৫০-৬০ হাজার টাকা। একজন খেলোয়াড়ের জন্য ক্রিকেট নেটের ভাড়া ৫০০ টাকা, ছয় জনের জন্য বাস্কেটবল কোর্টের ভাড়া ১,০০০ টাকা, ব্যাডমিন্টন কোর্টের ভাড়া ৫০০ টাকা, পুল টেবিলের ভাড়া ২০০ টাকা, পেইন্ট বল কোর্টে জনপ্রতি দিতে হয় ২০০ টাকা এবং গেমিং স্ক্রিনের জন্য জনপ্রতি ১১০ টাকা।
এ খাতে প্রথমদিকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অগ্রদূত ইকবাল হায়দার গালিব জানালেন, "একটি মানসম্মত টার্ফকোর্ট তৈরিতে এক থেকে দেড় কোটি টাকা ব্যয় হয়। খোলা স্থানে হলে ৭০-৭৫ লাখ টাকা লাগে। গড়ে দৈনিক ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হয় টার্ফকোর্ট থেকে।"
সিকো এরিনার পরিচালক ইশমাম চৌধুরী জানান, তাদের অন্তত ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে পুরো প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে। তারা এর পরিসর আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তাদের দৈনিক আয় ১৫-২০ হাজার টাকা।"
ফরচুন স্পোর্টস এরিনার উদ্যোক্তা সায়মন সাদাতও ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা জানান। তাদের আরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে। কৃত্রিম মাঠটি চাঁদগাও আবাসিক এলাকায় হওয়ায় গ্রাহকদের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলেছে। দিনরাত সবসময় মাঠে খেলোয়াড়দের পদচারণা থাকেই। সুইমিংপুল, জিম, ফাইন ডাইনসহ পুরো গেমিং জোন চালু হলে তাদের দৈনিক গড় আয় ৫০-৬০ হাজার টাকায় পৌঁছাবে বলে আশা করছেন তিনি।