বন্যার্তদের আবাস ‘খুদি বাড়ি’ ও বিশ্বমঞ্চে স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম
নদীমাতৃক ভূখণ্ড আমাদের বাংলাদেশ; বঙ্গভূমিকে তার উর্বরতা, সবুজের প্রাচুর্য সবই দুহাতে দিয়েছে নদ-নদী। প্রকৃতি একহাতে দেয়, অন্য হাতে নেয়ও। তাই ফিবছরের বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এদেশবাসীর চিরসঙ্গী। হাজারো বছর ধরে চলে আসা প্রকৃতির এই ভাঙ্গাগড়ার চক্রের সাথে পললভূমির বাসিন্দারা মানিয়েও নিয়েছেন; কিন্তু সেই সহাবস্থানকে ভেঙে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন। যতদিন যাচ্ছে বন্যাগুলো ততোই বিধ্বংসী হয়ে উঠছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃষ্টিপাতের তারতম্য ঘটাচ্ছে, ফলে অকালবন্যাও সচরাচর চোখে পড়ে এখন। সিএনএন অববলম্বনে
অপ্রত্যাশিত বানের আঘাত মানুষকে সহায়সম্বলহীন করছে, কেড়ে নিচ্ছে মাথা গোঁজার ঠাই-ও। বিষয়টি হয়তো আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত মেরিনা তাবাসসুমকেও ভাবিয়ে তুলেছিল।
বন্যার্তদের জন্য তিনি গড়েছেন 'খুদি বাড়ি'। নামকরণ স্বার্থকই বটে, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ নদী অববাহিকার বুকে খুদেই দেখায় এই বাড়িকে। কোণাকুণিভাবে বাঁশ বসানো খুটি হিসেবে, আর তার ওপরই বাড়ির মূল প্ল্যাটফর্ম। কৌণিক অ্যাঙ্গেলে দুপাশের টিনের দেয়ালই গড়েছে মাথার উপরের ছাউনি; সবমিলিয়ে আকৃতিটাই ত্রিকোণ। প্লাটফর্মের নিচের অংশে চলাচলের জন্য বাঁশের একটা মইও যুক্ত করা যায়।
দেখতে যেমন সাদামাটা, তেমনি এতে ব্যবহৃত উপকরণও সহজলভ্য। তবুও বর্ষায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করা বাংলার নদীগুলোর সামনে 'খুদি বাড়িকে' নাজুক এক স্থাপনাই মনে হবে। যে ভৌগলিক অবস্থানের জন্য এ বাড়ির নকশা করা হয়েছে, সেটি কিন্তু পরিবর্তনশীল। প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়, শুস্ক মৌসুমে আবার নদীর বুকে জাগে চর, এভাবেই বদলাতে থাকে অববাহিকার মানচিত্র।
মেরিনা তাবাসসুম বলেন, 'বন্যায় অজস্র মানুষ তাদের জমিজমা, বাড়ি সব হারায়। নদীগর্ভে বিলীন হয় অনেক জনপদ'। মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস (এমটিএ)-র প্রতিষ্ঠাতা তেমনই মানুষের জন্য সমাধান খুঁজেছেন– বন্যাকালে যাদের দ্রুত একস্থান থেকে অন্যত্র সরে যেতে হয়।
তিনি বলেন, "নদীতীর যখনই ডুবতে শুরু করে, তখনই তাদের অন্যত্র সরে যেতে হয়। এখানে আইডিয়াটা হলো, তারা যেন অস্থায়ী এই স্থাপনাসহ সরে যেতে পারে।"
হালকা ও খুলে জোড়া দেওয়ার মতো সহজ নকশায় তৈরি- খুদি বাড়ি। ফলে বানভাসীরা এটি সহজেই সাথে নিয়ে যেতে পারেন। বন্যা চলাকালে তীব্র বাতাস ও ভারি বৃষ্টিতেও তাতে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে, ভ্রাম্যমাণ থাকার সময় যেখানেই যান- একটা আশ্রয় তৈরির সুযোগ পাবেন তারা।
ছোট্ট ঘরের বড় অবদান
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্ত, তারমধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ। জলবায়ুর এই পরিবর্তন মৌসুমি বৃষ্টিপাতকে তীব্র করে তুলেছে, প্রতিবছরে কয়েক মাস ধরে দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল বন্যা কবলিত থাকছে।
ঝুঁকিটা বেশি উপকূলীয় অঞ্চলে। এখানে বন্যার সাথে আরো আছে জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জলাবদ্ধতার ঘটনা। এতে স্থানীয় মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না।
মেরিনা তাবাসসুম বলেন, "বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের মারাত্মক পরিবর্তন লক্ষ করছি। এসব বিষয়ে যথেষ্ট নজর দেওয়া দরকার।"
আর এই উপলদ্ধি থেকেই ২০১৮ সালে উপকূলীয় জনপদের মানুষের প্রয়োজন অনুসারে, কম খরচের ও সহজে বহনযোগ্য আবাস নির্মাণের গবেষণা শুরু করেন তিনি, সঙ্গে তার টিমের অন্যান্যরাও ছিলেন। তবে ব্যস্ত কর্মজীবনে গবেষণার কাজ এগোচ্ছিল না বেশি। এরমধ্যেই হানা দিল মহামারি, আর তাতে হাতে থাকা অনেক প্রজেক্ট স্থবির হয়ে পড়লে– তারা গবেষণা নিয়ে এগোনোর অবকাশ পান। এক পর্যায়ে ধারণাও পান, কেমন হওয়া উচিত বন্যাকালের অস্থায়ী স্থাপনা।
বন্যাকালীন আবাস নির্মাণের বেশকিছু আইডিয়া নিয়েই কাজ করছিল তার দল। তবে প্রধান উপকরণ হিসেবে তারা বাঁশকেই বেঁচে নেন; কারণ বাঁশ স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য, মজবুত ও হালকা। বাঁশ দিয়ে তৈরি আবাস সহজে বহন করাও যায়। বাঁশের সাথে কাঠামোকে দৃঢ়তা দেওয়ার জন্য ইস্পাতের জয়েন্ট ও লোহার ব্রেস ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ন্যূনতম কায়িক পরিশ্রমে বাড়িটি সহজেই খোলা বা জোড়া লাগানো যায়।
তবে খুদি বাড়ির ব্যতিক্রমীও বটে। অন্যান্য অস্থায়ী স্থাপনায় না থাকলেও, খুদি বাড়িতে দুটি তলা করার মতো ব্যবস্থা আছে। কারণ বাড়ির নিচতলা মাটির তৈরি ভিতের তৈরি। চাইলে শুকনো মৌসুমে যখন বানের পানির চিন্তা থাকে না, তখন টিন বা বাঁশের দেয়াল তুলে এটিকে আরেকটি তলা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আর দ্বিতীয়তলা মাটি থেকে ছয় ফুট উঁচুতে অবস্থিত। এতে চারজনের একটি পরিবার থাকতে পারবে। চলাচলের জন্য আছে মইয়ের ব্যবস্থা, বন্যার সময় যার প্রয়োজন বেশি হবে।
পারিবারিক অভিজ্ঞতা যখন স্থাপত্যের প্রেরণা
নিজস্ব পারিবারিক ইতিহাস ও শিক্ষাই হয়তো ভূমিহীন মানুষের জন্য তাবাসসুমের দরদের অন্যতম উৎস। কারণ, অভিবাসী পরিবারেরই উত্তরসূরি যে তিনি। তার পরিবারের আদিবাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের দাঙ্গার সময় তার দাদাদাদী পালিয়ে আসেন আজকের বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে)। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অনাহার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করে, সেই প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছিলেন তাবাসসুম।
জীবনের এসব অভিজ্ঞতা গভীর ছাপ ফেলে তার মনে। তাবাসসুমের মতে, "স্থাপত্য আসে মাটি থেকে, তাই কোথাও শেকড় গড়তে চাইলে, সেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার গভীর বোঝাপড়া থাকা চাই।"
স্থপতি হিসেবে প্রায় তিন দশকের কর্মজীবনে দেশের কিছু আইকনিক স্থাপত্যের নকশা করেছেন তিনি। এরমধ্যে স্বাধীনতা জাদুঘর এবং বায়তুর রউফ মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদের অসাধারণ স্থাপত্য কৌশল ও নকশার জন্য ২০১৬ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কার পান স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে তাবাসসুম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখতেন কারিকুলাম ভর্তি শুধু বিদেশের খ্যাতিমান স্থপতিদের নকশায় – তখন থেকেই তিনি 'বাংলা ও বাংলাদেশের স্থাপত্যবিদ্যার একটি ভাষা' সৃষ্টির সংকল্প নেন।
তবে বিদেশি একজন স্থপতির বড় অনুপ্রেরণা আছে তার জীবনে। তিনি হলেন, বিশ্বখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই আই কান। তার বাংলাদেশি ছাত্র প্রয়াত স্থপতি মাজহারুল ইসলামও ছিলেন তাবাসসুমের প্রেরণার উৎস। এই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি স্থাপনাকে রাখেন সরল, আর অসামান্যতা আনেন আলোআঁধারির খেলা যোগ করে। এভাবে স্থাপনার ভেতরের অংশকে বাইরের প্রকৃতির সাথে জড়িয়ে এক বৈচিত্র্যময় রূপ দেন।
২০২১ সালে সোন পদক জিতেছেন তাবাসসুম, সম্প্রতি একক প্রদর্শনী উদযাপন করেছে জার্মানির মিউনিখের টুম মিউজিয়াম অব আর্কিটেকচার।
তার স্থাপত্যে সব সময়েই বাঁশ বা মাটির তৈরি বিশেষ ইটের মতো স্থানীয় পরিবেশ, প্রকৃতি, ঐতিহাসিক উপকরণের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এতে খরচ যেমন কমে, তেমনি নির্মাণ উপকরণ পরিবহন বা উৎপাদন চক্রে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রাও কম থাকে।
নিজের নকশাকৃত স্থাপনায় আলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে মেরিনা তাবাসসুম এর আগে বলেছিলেন, 'আলোর প্রতি আমার এই আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ঢাকায় লুই কানের নকশায় নির্মিত জাতীয় সংসদ ভবন দেখার পর। আলো নিয়ে তার কাজ একইসঙ্গে আধ্যাত্মিক ও সংবেদনশীল এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। ১৯৮২ সালে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় আমি প্রথম সংসদ ভবন দেখি। স্থাপনার চারপাশে হাঁটার সময় এক পরাবাস্তব অনুভূতি পেয়েছিলাম, যা আগে কখনো হয়নি'।
'অপর যে স্থাপনাটি আমাকে মোহাবিষ্ট করেছিল তা হলো ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া। আলোছায়ার খেলায় মুগ্ধ হয়ে আমি ভাবছিলাম, কীভাবে এত নীরব থেকেও স্থাপনাটি নিজের শক্তিশালী উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। তখন থেকে আমার স্থাপনাগুলোতে আমি সাধ্যমতো আলো ব্যবহারের চেষ্টা করি'।
ঢাকার দক্ষিণখানে মেরিনা তাবাসসুমের দাদী বায়তুর রউফ মসজিদের জমি দান করেছিলেন। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সীমিত অর্থায়নের মসজিদটি শেষ করার মতো অর্থ মেরিনার কাছে ছিল না। পুরো প্রকল্পটির ব্যবস্থাপক, অর্থ সংগ্রহকারী, নকশাকার এবং নির্মাতা ছিলেন মেরিনা নিজেই। আলো ছিল এই পুরো স্থাপত্যের অলঙ্কার। বছরের বিভিন্ন সময় মসজিদটিতে ভিন্ন সব আলোছায়ার খেলা সৃষ্টি হয়।
৮০'র দশকের শেষে বাংলাদেশের প্রথিতযশা স্থপতি মাজহারুল ইসলামের "স্থানিক-প্রতিক্রিয়াশীল স্থাপত্য" দ্বারা প্রভাবিত স্থপতিদের একজন মেরিনা তাবাসসুম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী মেরিনা স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সমসাময়িক হয়ে উঠার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিকেও খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বাণিজ্যিক প্রকল্প নিয়ে কিছুটা সংকোচ আছে তাবাসসুমের। এখানে প্রেরণা তার বাবার। তিনি ছিলেন মহল্লার একমাত্র চিকিৎসক, ফলে মানুষের অসুখেবিসুখে বিপদে পাশে দাঁড়ানোই ছিল তার কাজ। বাবার মতই মানুষের বিপদে পাশে এসে দাঁড়াতে চান তাবাসসুম, চান তাদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করতে।
তিনি বলেন, 'জনপরিসরের কাজ করতে ভালবাসি, বিশেষত যেসব জায়গায় মানুষ জমায়েত হয়, এমন স্থাপনা তৈরিতে আমার আগ্রহ থাকে। একটি শহরের সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে এর পাবলিশ স্পেসগুলো কতোটা ভালো তার ওপর। এটা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। তাই আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে'।
দুর্গত মানুষের জন্য 'ফেস'
খুদি বাড়ি নির্মাণ ও বিতরণের জন্য তার প্রতিষ্ঠানের একটি অলাভজনক শাখা ফাউন্ডেশন ফর আর্কিটেকচার, কমিউনিটি, ইক্যুইটি (ফেস) প্রতিষ্ঠা করেছেন তাবাসসুম। ফেস- জলবায়ু শরণার্থী, যাযাবর সম্প্রদায় ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য যথাযথ আবাস নির্মাণে সহায়তা করছে।
২০২১ সালে ঢাকাস্থ সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস খুদি বাড়ি প্রকল্পে ১০০টি বাড়ির জন্য অনুদান দিয়েছে। ছোট্ট এসব বাড়ির প্রতিটি তৈরিতে মার্কিন ডলারে ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ৪৫০ ডলার করে। তাবাসসুম জানান, সামাজিক কর্মশালা ও অন্যান্য সম্পৃক্ততামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার টিম যাদের এমন আবাসন সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই মানুষদের নির্বাচন করে।
সন্তানসহ দুস্থ বিধবা নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী থেকে শুরু করে নানান ধরনের বঞ্চিত মানুষ এই সুবিধা পাচ্ছে। এপর্যন্ত, দক্ষিণে চাঁদপুরে এবং উত্তরে বন্যাপ্রবণ কুড়িগ্রাম ও সুনামগঞ্জে ৪০টি খুদি বাড়ি বানিয়েছে ফেস।
তাবাসসুম বলেন, 'আমাদের পুরো গ্রাম তৈরির উদ্দেশ্য নয়। আগে আমরা কিছু বাড়ি বানিয়ে দেখছি, সেগুলো চারপাশের পরিবেশের সাথে কীভাবে মানিয়ে নিতে পারে, বা মানুষই বা তার কতোটা কদর করে'।
শুধু চরাঞ্চলেই খুদি বাড়ি বানাচ্ছে না ফেস। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও গড়ছে। সেখানে সামাজিক মেলামেশার জায়গা ও ব্যক্তিগত আবাস দু'ভাবেই খুদি বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাবাসসুমের ভাষায়, 'সব মানুষেরই ভালো স্থাপত্য পাবার অধিকার রয়েছে'।