পিয়েরির সঙ্গে উত্তর মেরু জয় করেন কৃষ্ণাঙ্গ অভিযাত্রী ম্যাথিউ হেনসন, জোটেনি স্বীকৃতি
মেরিল্যান্ডের চার্লস কাউন্টিতে ১৮৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভদ্রলোক। ১৮৭৯-১৮৮৪ সালে কেটি হাইনস জাহাজে কেবিন বয় হিসেবে যোগ দিয়ে বিশ্বভ্রমণ শুরু করেন। মাঝখানে কিছু অভিযান এবং এরপর ১৯০৯ সালে রবার্ট ই. পিয়েরিসহ উত্তর মেরুতে পৌঁছে সেখানে প্রথবারের মতো মার্কিন পতাকা স্থাপন করেন।
যার কথা বলা হচ্ছে তার নাম ম্যাথিউ হেনসন। অভিযাত্রী হিসেবে যেসব গুণ দরকার, সবই ছিল তার। তবে একটা জায়গায় তিনি অন্যদের চেয়ে 'পিছিয়ে' ছিলেন — হেনসন ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তার জীবনী জানিয়েছে বিবিসি।
এক্সপ্লোরারস ক্লাব-এর বোর্ড অভ ডিরেক্টরস-এর সদস্য আফ্রিকান আমেরিকান জে. আর. হ্যারিস বলেন, 'ছোটবেলায় আমরা কখনো ম্যাথিউ হেনসনের কথাই শুনিনি। আমরা সবসময় জানতাম উত্তর মেরুর আবিষ্কারক ছিলেন রবার্ট পিয়েরি।'
হেনসনের জীবন কাহিনী ভিক্টোরিয়ান যুগের কোনো অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসকেও হার মানাবে। বাবা ছিলেন কৃষক। জাহাজে যোগ দেওয়ার আগে ছুটা কাজ করতেন হেনসন। তার প্রথম মেন্টর ছিলেন ক্যাপ্টেন চাইল্ডস। কিশোর হেনসনকে তিনি নাবিকজীবনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন কীভাবে পড়তে হয়।
১৮৮৩ সালে ক্যাপ্টেন চাইল্ডস মারা যাওয়ার পর খাওয়াপরা নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন হেনসন। এরপর ১৮৮৭ সালে রবার্ট পিয়েরির সঙ্গে মোলাকাত হলে তার দুঃখ ঘোচে কিছুটা। কমান্ডার পিয়েরি ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন প্রকৌশলী। ওই বছরের শেষের দিকে নিকারাগুয়ায় একটি জরিপ মিশনে যাওয়ার কথা পিয়েরির, সেখানে তিনি হেনসনকে সহকারী হিসেবে যাওয়ার প্রস্তাব করেন।
১৮৯১ সালে পিয়েরির সঙ্গে উত্তর মেরু আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে আর্কটিক সার্কেলে অভিযান শুরু করেন হেনসন। অভিযানের দলনেতা হিসেবে পিয়েরিকে নির্বাচন করা হয়। পিয়েরির সঙ্গে কেবল একটি অভিযান বাদে বাকি সবগুলোতেই গিয়েছিলেন হেনসন।
গ্রিনল্যান্ডে অভিযানের সময় হেনসন ইনুগহুইত মানুষদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেলেন। তিনি সেখানে ইগলু ও স্লেজ বানাতে শেখেন, ইনুকতুন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। রাইফেল দিয়ে মেরু অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাণীও শিকার করা শিখে নিয়েছিলেন তিনি। তবে কুকুরে টানা স্লেজ চালানো শেখার মাধ্যমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাটা আয়ত্ত করেছিলেন হেনসন।
হেনসন সম্পর্কে পিয়েরি লিখেছেন: 'সে কুকুরগুলোকে অনেক ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারত। ইনুইত শিকারিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্লেজচালকদের পর হেনসনই স্লেজ সবচেয়ে ভালো চালাতে পারতেন। তাকে ছাড়া আমার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।'
১৮৯১ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত পিয়েরি সাতবার উত্তর মেরু আবিষ্কাররের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। প্রতিবারই তার সঙ্গে ছিলেন হেনসন — তার সবচেয়ে কাছের সহ-অভিযাত্রী হিসেবে। বেশ কয়েকবার দু'জনেই খাবারের অভাবে বা ঠান্ডায় জমে মরতে বসেছিলেন।
ফ্রস্টবাইটে পায়ের অনেকগুলো আঙুল হারিয়েছিলেন পিয়েরি। হেনসন একবার বরফের স্তর ভেঙে নিচে পানিতে পড়ে প্রায় ডুবে মরতে বসেছিলেন। তার ইনুইত বন্ধু উটাহ তাকে টেনে তোলেন। অভিযানের সময় ভয়ংকর ঝড় আর প্রযুক্তিগত বাধা তো ছিলই।
অবশেষে ১৯০৯ সালে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করেন তারা। রসদ কমতির দিকে, অভিযাত্রীরা তখন উত্তর মেরু থেকে ১৩৪ মাইল দূরে। পিয়েরি তার ৫০ সদস্যের অভিযাত্রী দলের সবাইকে জাহাজে ফিরে যেতে বলেন, কেবল চারজন ইনুইত ও হেনসনকে সঙ্গে রেখেছিলেন তিনি।
স্মিথসোনিয়ান-এর এক নিবন্ধ অনুযায়ী, ১৯০৯ সালের ৬ এপ্রিলের দিনকয়েক পরে হেনসন নাকি পিয়েরিকে বলেছিলেন, তার 'মনে হচ্ছে' তারা উত্তর মেরুতে পৌঁছে গিয়েছেন। এরপর পিয়েরি কোটের ভেতর থেকে একটি মার্কিন পতাকা বের করে একটি ইগলুর ওপর বসিয়ে দেন।
পরেরদিন পিয়েরি একটি সেক্টট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করেন। তারপর একটি খালি টিনের পাত্রে একটি নোট ও মার্কিন পতাকাটি রেখে টিনটি বরফের নিচে পুঁতে ফেলেন। এরপর ঘরে ফেরার জন্য সবাই মিলে জাহাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
নিজের বই আ নিগ্রো এক্সপ্লোরার আ্যাট দ্য নর্থ পোল-এ হেনসন লিখেছিলেন, 'আরেকটা বিশ্বের অর্জন পরিসমাপ্ত হলো। এবং অতীতের মতো, ইতিহাসের শুরু থেকেই কোনো শ্বেতাঙ্গ এ বিশ্বে যা কিছু অর্জন করেছেন, তার সঙ্গী হয়েছেন কোনো কৃষ্ণাঙ্গ।'
কিন্তু নিজের এ অর্জনের বিশেষ স্বীকৃতি পাননি হেনসন। পরবর্তী এক শতক ধরে ইতিহাসবিদেরা তার অর্জনকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী জিম ক্রো আইনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছিলেন হেনসন। তার বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন পিয়েরি। সেখানে তিনি হেনসনের প্রশংসা করেন। কিন্তু উত্তর মেরুতে পৌঁছানোর বেশিরভাগ কৃতিত্ব পেয়েছেন রবার্ট পিয়েরি, হেনসনের নাম ক্রমশ ভুলে যান সবাই।
পিয়েরির জরিপের নির্ভুলতা অথবা তিনি উত্তর মেরুতে পৌঁছানো আদৌ প্রথম মানুষ ছিলেন কি না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ইতিহাসবিদেরা বিতর্ক করলেও তারা বেশিরভাগ স্বীকার করে নিয়েছেন যে হেনসন ছাড়া উত্তরের এত দূরে পৌঁছাতেই পারতেন না পিয়েরি।
হেনসন এ অভিযানের জন্য পুরোদস্তুর ইনুইত জীবনযাপন শুরু করেছিলেন, শিখেছিলেন হাজার বছরের পুরোনো টিকে থাকার বিভিন্ন দক্ষতা। এছাড়া লোমের পোশাক ও কুকুরে টানা স্লেজের মতো ইনুইত জিনিসপত্রের ব্যবহারও আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। ইনুইত আদিবাসীরাও তাকে বেশ আপন করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হেনসনকে এক্সপ্লোরারস ক্লাবের সদস্য করা হয় কেবল ১৯৩৭ সালে। শেষতক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ও ডুইট আইসেনহাওয়ারের কাছ থেকে সম্মাননা পান তিনি, কিন্তু সেগুলো পেয়েছিলেন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে। তার কবরের ওপর একটি বিশেষ মনুমেন্ট আছে, কিন্তু সেটাও তৈরি করা হয়েছিল তার মৃত্যুর ৩৩ বছর পরে, ১৯৮৮ সালে।
পিয়েরি তার সঙ্গে হেনসন বাদে চারজন ইনুইতকে রেখেছিলেন শেষ অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ২০২২ সালে এক্সপ্লোরারাস ক্লাব সিগলু, এগিনগা, ওকিয়া ও উটাহ নামক ওই চার ইনুইতকে মরণোত্তর সদস্যপদ প্রদান করে। 'আমার মতে, তারা সবাই — ছয়জন মিলেই উত্তর মেরু আবিষ্কার করেছিলেন,' বলেন জে. আর. হ্যারিস।