২৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে করতে চান? জেনে নিন রূঢ় সত্য
বিবাহিত জীবন শুরু করতে দুজনের প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে বেশি আর কী দরকার! জগতের সব প্রেমিকযুগলের মতো অভিন্ন এই ভ্রান্ত ধারণা ছিল আমাদের দুজনেরও। জীবন বাস্তবতার সাত-পাঁচ ভাবতে গিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাইনি তাই। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যখন গাঁটছড়া বাঁধি তখন দুজনেরই বয়স ছিল ২৪-এর আশেপাশে। আমাদের মতো এই তৃতীয় বিশ্বের দেশেও বর্তমানের আর্থসামাজিক অবস্থায় সমবয়সী ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য আর উপযুক্ত ভাবা হয় না যে বয়সকে!
তবে দাম্পত্য জীবনের 'হানিমুন পিরিয়ড' কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমাদের। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম জীবনে রোমান্স আসলে পরের চিন্তা।
ঢাকা শহরে যার যার ব্যাচেলর মেস আর আত্মীয়ের বাসা ছেড়ে আমরা নিজেদের ঠিকানায় (দুজনের পরিবারের বসবাস ঢাকার বাইরে নিজ জেলায়) উঠেছিলাম ২০২২-এর মার্চে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিপর্যয় শুরুর ঠিক পরের মাসেই। ঢাকায় থেকেও পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ঘটে যাওয়া সেই দুর্যোগের ভার আবশ্যিকভাবেই আমাদের বইতে হলো পরের মাসগুলোতে।
যুদ্ধের কারণে শুরু হওয়া মূল্স্ফীযতিতে আমাদের বাজেটের বারোটা বেজেছিল শুরুতেই। ২০২১ সালে বিয়ের এক মাস আগেই আমাদের স্নাতক শেষ করেছিলাম দুজনেই। গতবছর পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি মাস্টার্সের পড়াশোনাও করছিলাম আমরা। তাই আমাদের 'সংসার সাজানো'র বাজেট যে নিতান্তই কম ছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে গিয়েই পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে গিয়েছিল আমাদের।
তবু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হওয়ায় কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে যৌথ জীবন শুরু করতে পারায় আমরা বেশ সৌভাগ্যবানই ছিলাম বলা যায়। মূল্যস্ফীতির এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে সংসার শুরু করাটাও ছিল বিশাল ব্যাপার। কারণ অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা সমবয়সী অনেক বন্ধুকেই দেখেছি মাস্টার্স শেষ করার পরও অনেকদিন যাবত চাকরি খুঁজে যেতে।
যা-ই হোক, আমাদের সীমিত বাজেটের গল্পে ফিরে আসা যাক। দুজনের মাথা গোঁজার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে গিয়েই শুরু হয়েছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আপনার বাজেট যদি ২০ হাজারের কম হয়, তবে ঢাকা শহরের কোনো ভদ্রস্থ এলাকায় একটা ভালো বাসা খুঁজে পাওয়া ভীষণ মুশকিল। আর সেই এলাকা যদি হয় ঢাকার কেন্দ্রে তাহলে তো কোনো কথাই নেই!
বাসা খুঁজতে গিয়ে তাই মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগসহ আশেপাশের এলাকায় এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর জন্য দুই রুমের ছোট কোনো ফ্ল্যাট খুঁজে বের করার কাছে গল্প-উপন্যাসের গুপ্তধনের সন্ধানকে মনে হতে লাগল নিতান্তই ছেলেখেলা! দেখা গেল সীমিত আয়ের নতুন দম্পতির জন্য বাসা খোঁজার চেয়ে এই শহরে ব্যাচেলর বাসা খুঁজে পাওয়াও অনেকটাই সহজ।
সারাদিন ক্লাস আর অফিস শেষ করে বাসা খোঁজার মতো অসীম ধৈর্য আর ক্লান্তিকর কাজে এক পর্যায়ে আমরা হালই ছেড়ে দিতে চলেছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় বিল আর সার্ভিস চার্জসহ ১৮ হাজার টাকা ভাড়ায় আমাদের চাহিদামাফিক ফ্ল্যাট খুঁজে পেলাম মগবাজারেই। কিন্তু ফ্ল্যাট তো শুধু একটা খালি জায়গা। একে বসবাসযোগ্য করতে হলে প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে পূর্ণ করতে হবে আগে। তাই আমাদের কাজের কেবল শুরু তখন।
শুরুতেই ঘরের সবচেয়ে বেসিক কিছু আসবাবপত্র কিনলাম আমরা। যার মধ্যে ছিল একটা খাট, একটা আলমারি, একটা পড়ার টেবিল আর দুটি চেয়ার। আমাদের সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জিনিসগুলো পাওয়ার জন্য বেশ খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে এক্ষেত্রেও। বিছানা-বালিশসহ খাটের দাম পড়ল সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা, আলমারি ১২ হাজার টাকা, পড়ার টেবিল ৫ হাজার টাকা আর দুটি চেয়ারের প্রতিটা ৬০০ টাকা।
বিছানায় বা ফ্লোরে বসে খেতে আমাদের কোনো সমস্যা ছিল না বলে ডাইনিং টেবিল কেনার চিন্তা বাদ দিলাম। সংবাদকর্মী হওয়ায় আমাদের কাছে খবরের কাগজের কোনো কমতি ছিল না, তাই টেবিল ক্লথ নিয়েও ভাবতে হয়নি আর। বিশ্বাস করুন, নিজের নাম আর লেখা ছাপা কাগজের ওপর বসে ভাত খাওয়ার মতো তৃপ্তি আর কোনোকিছু নেই।
ড্রেসিং টেবিল কেনার বদলে আমরা দেয়ালের লাগানোর একটা বড় আয়না কিনে নিলাম। কাঠের ফ্রেমের সেই আয়নার দাম পড়েছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। মেহমানদারির জন্য বাসায় সোফাসেট কেনাটাও আমাদের জন্য বেশ বিলাসিতার ব্যাপার ছিল। তার বদলে একটা জাজিম কিনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবলাম। মেহমানরা তাতে বসার পাশাপাশি চাইলে ঘুমাতেও পারবেন। কয়েকটি কুশনসহ সেই জাজিমের দাম পড়ল ৫ হাজার টাকার মতো।
আসবাবপত্রের চিন্তা শেষ হওয়ার পর এবার এলো রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে নজর দেওয়ার পালা। প্রথমেই আমাদের দরকার ছিল একটা ডাবল বার্নারের গ্যাসের চুলা, যার দাম পড়ল ৩ হাজার ৫০০ টাকা। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ন্যাশনাল গ্যাসের লাইন না থাকায় এলপিজি সিলিন্ডারও কিনতে হলো। ১২ কেজি গ্যাসসহ নতুন সিলিন্ডার আর পাইপ লাইন কেনায় দাম পড়ল ৩ হাজার ৪০০ টাকা।
এলপিজি গ্যাসের এই উচ্চমূল্যের অবশ্য একটা ভালো দিক ছিল আমাদের জন্য। রান্না করতে আলসেমি হলে বাইরে খাওয়ার একটা যুক্তিসঙ্গত অজুহাত তো পাওয়া গেল!
রান্নাবান্নার জন্য না হলেই নয় এমন কিছু হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে ছুরি, চামচ, থালা-বাসন ইত্যাদি কিনতে পকেট থেকে আরো ৪ হাজার টাকা খরচ হলো। পানির ফিল্টারও কিনতে হলো একটা। যদিও আমাদের মধ্যে একজন ফিল্টার কিনে একবারে বেশি টাকা খরচের চেয়ে রোজ পাঁচ লিটারের পানির বোতল কিনে আনার পক্ষপাতী ছিল। তবে 'লেডি অব দ্য হাউজ'-এর, 'রোজ ৮০ টাকা জলে ফেলার চেয়ে পানি খাওয়া বন্ধ করে দেওয়াই ভালো' হুমকি পেয়ে মতি ফিরে এলো তার। আর এভাবেই ইরান-সৌদি আরবের পদরেখা অনুসরণ করে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় একটি ফিল্টার কেনায় সম্মত হলাম দুজনেই।
ওয়াশরুমের কিছু সরঞ্জাম কিনতে খরচ হলো ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো। এই ১ হাজার ৫০০ টাকাই হয়তো আমাদের সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। কারণ স্থানীয় প্লাস্টিক সরঞ্জামের দোকানদার অন্তত ২০ বার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন তার বিক্রি করা সবগুলো পণ্যই পুরোপুরি 'ভার্জিন ম্যাটেরিয়াল'-এ তৈরি!
দুটি ফ্যান আর চারটা এলইডি বাল্বও কিনতে হয়েছিল আমাদের দুই রুম, করিডোর আর ওয়াশরুমের জন্য। প্রতিটি ফ্যান ৩ হাজার টাকা করে আর সবগুলো বাল্বের দাম ছিল ১ হাজার টাকা।
এদিকে ইন্টারনেট সংযোগের জন্য ওয়াইফাই রাউটার কিনতে হলো ২ হাজার টাকায়। যদিও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার আগে কোম্পানি থেকে জানানো হয়েছিল লাইন সেটাপের জন্য এক টাকাও দিতে হবে না, কিন্তু আমাদের হতাশ করে প্রথম মাসের অগ্রিম বিল হিসেবে ৮০০ টাকা দাবি করল তারা।
এবার আসা যাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে, যেটির উল্লেখ না করলে পুরো লেখাটাই বৃথা। যত ছোটই হোক বা বড়, যেকোনো পরিবারে তার সদস্যদের পর সবচেয়ে জরুরি উপকরণ মনে হয় ফ্রিজ। তাই আমাদের সংসারেও ফ্রিজ না কিনে উপায় ছিল না। কিন্তু সত্যি বলতে খুব বড় বা দামি কোনো ফ্রিজ কেনার চিন্তা ছিল আমাদের সাধ্যের বাইরে। আবার খরচ কমাতে না দেখেশুনে যেকোনো একটা ফ্রিজ কিনে নেওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। কারণ তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে খুব জলদি হয়তো এত টাকা খরচ করে আবার নতুন ফ্রিজ কেনা সম্ভব হবে না।
যে কারণে সবদিক ঠিক রেখে ফ্রিজ পছন্দ করতে গিয়ে বেশ মাথা ঘামাতে হয়েছে আমাদের। এমনকি এই অল্প বয়সে, ক্যারিয়ারের শুরুতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেও এতটা চিন্তা করিনি আমরা দুজনে।
বিস্তর গবেষণা আর অসংখ্য নির্ঘুম রাতের পর আমরা ৩৬ হাজার টাকা দামে কপার কন্ডেন্সারযুক্ত ২১৭ লিটারের একটা নন-ফ্রস্ট ফ্রিজ কেনার সিদ্ধান্ত নিই।
ফ্রিজ কেনার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, 'সন্তুষ্টি' শব্দটির সঠিক অর্থ এখন অনুধাবন করতে পারি আমরা। তাছাড়া ফ্রিজ কেনার পর থেকে নিজেদের ফ্রিজের ঠান্ডা পানি আর বরফের চেয়ে সুস্বাদু আর কিছু নেই আমাদের জন্য।
একটা স্মার্ট টিভি কেনারও খুব খুব ইচ্ছা ছিল আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে সম্পর্কের শুরুর সময় থেকেই স্বপ্ন ছিল একদিন নিজেদের ঘরে বড় স্ক্রিনে প্রিয় সিনেমা-সিরিজ দেখব একসঙ্গে। কিন্তু বাজেটে টান পড়ায় সেই স্বপ্ন মুলতবি রাখতে হলো তখন।
আমাদের বাবা-মায়েরা অবশ্য খুব সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। 'লোন' হিসেবে হলেও কিছু টাকা নিয়ে প্রয়োজনীয় সব জিনিস কেনার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সুদহীন সেই লোনে টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো বাঁধাধরা সময়ের উল্লেখও থাকত না। কিন্তু আমরা ঘোর বিরোধী ছিলাম এই লোন নেওয়ার। কারণ দুজনেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, লোন নেওয়া মানেই হলো ফাঁদে পা দেওয়া।
একবার কোনোকিছুর জন্য লোন নেওয়ার পর সেখান থেকে আর মুক্তি পাওয়ার উপায় থাকে না। আগের সেই লোন মেটানোর জন্য আবার নিতে হয় নতুন লোন। লোনের এই চক্র চলতে থাকে অনন্ত কাল ধরে।
ইতোমধ্যেই আমরা জীবনে বড়সড় একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি অল্প বয়সে বিয়ে করে, আমাদের অনেক বন্ধুর মতেই যেটা নাকি স্রেফ বাল্যবিবাহ। এরপর আরো একটা ঝুঁকি নেওয়ার কথা তো চিন্তাই করা যায় না!
তাই মোটামুটি সোয়া লাখ টাকাতেই আপাতত আমরা রাশ টেনেছি খরচের বহরে। বলাই বাহুল্য, এখনো খরচের আরো অসংখ্য জায়গা বাকি। কেবল তাহলেই 'পূর্ণতা' পাবে আমাদের যৌথ জীবন।
কিন্তু সামনের রাস্তাটা খুব কঠিন। বিবাহিত জীবন শুরু তো করা গেছে, এখন পালা সেটাকে ঠিকঠাক সামলানোর।
'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।' তাই নয় কি?