কৌটাজাত ইলিশ: আমাদের প্রিয় মাছের বছরজুড়ে সরবরাহ এখন বাস্তব
ধরুন কোনো এক বর্ষার দিনে আপনার বাড়িতে অতিথি এসেছে। আপনি চাচ্ছেন তাদেরকে খিচুড়ি আর সর্ষে ইলিশ খাওয়াতে। কিন্তু ফ্রিজে ইলিশ নেই, বাজারেও মাছটি এখন মিলছে না।
চিন্তা করার কারণ নেই, আপনি অতিথিদেরকে টিনজাত ইলিশ রেঁধে খাওয়াতে পারবেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি)-এর গবেষকেরা সম্প্রতি স্থানীয়ভাবে তৈরি রাসায়নিকমুক্ত কৌটাজাতকৃত সর্ষে ইলিশ তৈরি করেছেন। এ খাবার সামনে সহজলভ্য দামেই কিনতে পারবেন ক্রেতারা।
সারাবিশ্বেই যাদেরকে প্রায়ই ভ্রমণ করতে হয়, তাদের কাছে দ্রুত ও ঝামেলামুক্ত খাওয়ার বিকল্প এই কৌটাজাতকৃত খাবার। সাধারণ পদ্ধতিতে কেটেকুটে রান্না করার ঝক্কি নেই — এ খাবার কৌটা থেকে বের করে সরাসরিই খাওয়া যায়।
'মূল্যবান অথচ ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া ইলিশ মাছ সংরক্ষণের দীর্ঘদিনের চিন্তা থেকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে মাছ কৌটাজাতকরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করি আমরা। একইসঙ্গে আমারা চেয়েছি আমাদের প্রিয় এ মাছটিকে সারাবছর জুড়ে সকল শ্রেণির মানুষের পাতে তুলে দিতে,' বলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সহগবেষক মো. মাসুদ রানা।
শেকৃবি'র ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট-এর তহবিলে পরিচালিত এ গবেষণাটির তত্ত্বাবধান করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৬০টি স্বাদুপানি ও ৪৭৫টি সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি আছে। তাহলে কৌটাজাতকরণের জন্য ইলিশকে কেন বেছে নেওয়া হলো?
ইলিশের জাতীয় মাছের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে মাসুদ ব্যাখ্যা করেন, "স্বতন্ত্র স্বাদ ও গন্ধের জন্য ইলিশকে 'মাছের রাজা' হিসেবেও ডাকা হয়। বাংলাদেশসহ কেবল অল্প কয়েকটি দেশে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। আর বিশ্বের মোট ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়।" বরফ ব্যবহার করলেও ইলিশ রপ্তানি করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু বিশ্বে এ মাছের উচ্চ চাহিদা রয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
ইলিশের কৌটাজাতকরণের আরেকটি কারণ হলো, বেশি চর্বি থাকায় এ মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায় না। এছাড়া কেবল সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশকেই কৌটাজাত করা হবে।
২০২০-২১ সালে দেশে মোট মাছ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪.৬২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আর এর মধ্যে কেবল ইলিশই ছিল ০.৫৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মৎস্যবিভাগের তথ্যমতে বিভিন্ন সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে গত দশকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
তবে ইলিশের উৎপাদন বেশি হলেও তা থেকে মৎস্যজীবীরা খুব একটা লাভবান হন না। মাছ ধরার ভরা মৌসুমে মধ্যস্বত্বভোগীরা ইলিশের বড় একটি অংশ মজুত করে রাখেন এবং বাকিটা চড়া দামে বিক্রি করেন। তারা জেলেদের কাছ থেকে সস্তা দামে মাছ কিনে নেন আর মাছ সংরক্ষণের সময় বাড়াতে মাছে লবণ মেশান। কিন্তু লবণ দেওয়া ইলিশের দাম টাটকা ইলিশের চেয়ে অনেক কম।
ইলিশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৌটাজাতকরণ জেলেদেরকে উদ্বৃত্ত মাছের জন্য ন্যায্যমূল্য দিতে পারবে বলে মত প্রকাশ করেন মাসুদ।
গতানুগতিক মৎস্যব্যবসায়ীরা হয়তো দাবি করতে পারেন, ইলিশের কৌটাজাতকরণ হলে এ মাছের দাম বেড়ে যাবে। তবে শেকৃবি'র গবেষকেরা বিষয়টির সঙ্গে একমত নন।
তারা বলছেন, মাছ কৌটাজাতকরণ আদতে মূল্য সংযোজন নয়; এ প্রক্রিয়ার শিল্পায়ন গতানুগতিক মাছ ব্যবসার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে না, কারণ কৌটাজাতকৃত ইলিশের বাজার ভিন্ন।
বিশ্বজুড়ে টুনা, স্যামন, সার্ডিন, পিলচার্ডসহ আরও কিছু সামুদ্রিক মাছ কৌটাজাত করা হয়। বর্তমান গবেষকেরা তাদের গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো বিভিন্ন এশীয় দেশের কৌটাজাতকৃত মাছ পরখ করে দেখেন। কারণ ওসব দেশের মাছের প্রকার ও রেসিপি কিছুটা আমাদের এখানকার মতোই।
দেশে স্থানীয়ভাবে যে কৌটা পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে ইলিশের কৌটাজাতকরণ সম্ভব নয়। কারণ মাছটির শরীরের ফ্যাটি এসিড টিনের কৌটার সঙ্গে রাসায়নিকভাবে বিক্রিয়া করে। তাই গবেষকেরা মাছ ও কৌটার অ্যালুমিনিয়ামের স্তরের মাঝখানে জিংক্স-অক্সাইডের স্তরসমৃদ্ধ কনটেইনার আমদানি করেছেন।
সিলিং মেশিন এবং মাছকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত মেশিনও বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
গবেষকেরা ইলিশের চর্বি উপাদান ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ নিয়েও পরীক্ষা চালান। তাছাড়া গর্ভবতী মা, ও শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ওমেগা-৩ ও ৬-এর মতো দরকারি সব ফ্যাটি এসিড কৌটার ভেতর যেন অক্ষুণ্ণ থাকে তা নিশ্চিত করেছেন গবেষকেরা। মাসুদ জানিয়েছেন, এ কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়নি।
এরপর তারা স্থানীয় ভোক্তাদের স্বাদের কথা মাথায় রেখে রেসিপির পরিকল্পনা করেছেন। 'বাঙালি ইলিশকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে সর্ষে দিয়ে। তাই আমরা প্রথমে সর্ষে দিয়েই কৌটাজাত করেছি,' মাসুদ বলেন।
বর্তমানে এ গবেষকেরা তিনটি রেসিপির পরিকল্পনা করছেন: সর্ষে ইলিশ, চিলি ইলিশ, এবং মসলা ছাড়া ইলিশের সঙ্গে সবজি। শেষ আইটেমটি বিদেশি ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে।
শেকৃবি'র গবেষকেরা উৎপাদন ও মার্কেটিংয়ের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ করেন। কারণ কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়াটিতে উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের দরকার।
সাগর ফিশ এক্সপোর্ট নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তারা ইলিশ কৌটাজাতকরণের পাইলট প্রকল্পে আমন্ত্রণ জানান। কয়েক মাস ধরে দুই পক্ষের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের পর প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও কক্সবাজার চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিক আবেদ আহসান সাগর ২০২২ সালে প্রকল্পটিতে আগ্রহী হন এবং কক্সবাজারে তার নিজস্ব জায়গায় একটি প্ল্যান্ট তৈরি করেন।
'দেশে এবং বাইরের রপ্তানি বাজার — দুজায়গাতেই কৌটাজাতকৃত মাছের দারুণ ভবিষ্যৎ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের আশপাশের মাছের শেল্ফ লাইফ তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশি কৌটাজাতকৃত মাছের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে,' কৌটাজাতকৃত মৎস্যশিল্প নিয়ে নিজের আগ্রহের কথা জানাতে গিয়ে বলেন সাগর।
ইতোমধ্যে কৌটাজাতকৃত ইলিশের প্রথম ব্যাচ বিভিন্ন দলের কাছে স্বাদপরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, এ বছরের মার্চ মাসের শুরু থেকে প্রায় ৫০০ মানুষ তাদের উৎপাদিত কৌটাজাতকৃত ইলিশ খেয়েছেন এবং ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছেন। বর্তমানে পণ্যটির শেল্ফ লাইফ তিন মাস।
বর্তমানে শেকৃবি, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এ টিনজাত ইলিশের পুষ্টি উপাদান ও শেল্ফ লাইফের ওপর একাধিক বিশ্লেষণ চলছে। পণ্যটির মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নির্দিষ্ট করার জন্য প্রায় এক বছর ধরে এ বিশ্লেষণ চলবে।
গবেষকেরা এবং সাগর মনে করেন, কৌটাজাতকৃত মাছের শিল্পায়ন হলে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
সাগর বলেন, সাধারণত একটি বড় শিল্প তৈরি হলে তার জন্য বিভিন্ন ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও ক্রমশ গড়ে ওঠে।
তিনি আশা করেন, ভবিষ্যতে মাছ কৌটাজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় কনটেইনার দেশেই তৈরি হবে।
শেকৃবি'র গবেষকদের কৌটাজাতকৃত ইলিশের দাম রাখা হয়েছে ৩২০ টাকা। কিন্তু কৌটার ভেতর কেবল চার টুকরা মাছের জন্য এ দামটি কি খুব একটা কম?
গবেষকেরা জানিয়েছেন, সব ধরনে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পর তারা এ দাম ঠিক করেছেন। 'মডেল কনটেইনারগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। দেশে কৌটা তৈরি হলে দাম আরও কমে যাবে। এমনকি একজন রিকশা চালকও মাসে একবারের বেশি এ ইলিশ কিনতে পারবেন,' আশাবাদী শোনাল মাসুদকে।