এখনও ৩০০ কোটি মানুষ ব্যবহার করেন ফেসবুক, কিন্তু তরুণরা ছেড়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটি
ফেসবুক বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে এটি এখনো নিষ্প্রাণ হয়ে যায়নি। একইসঙ্গে এটির দাবি, কেবল 'বুড়ো মানুষেরা'ই ফেসবুক ব্যবহার করছেন না। যদিও কয়েক বছর ধরে ফেসবুককে বুড়োদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দেখছে হালের তরুণ প্রজন্ম।
বর্তমানে ফেসবুককে টিকটকের সঙ্গেও পাল্লা দিতে হচ্ছে। আর তরুণ ব্যবহারকারীরাও ক্রমশ ফেসবুক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
ডেভিন ওয়ালশ এরকম একজন তরুণী। 'শেষবার কবে ফেসবুকে লগইন করেছি, সেটাও মনে নেই আমার। খুব সম্ভবত কয়েক বছর আগে,' বলেন ম্যানহাটনের ২৪ বছর বয়সী এ জনযোগাযোগ কর্মী।
তার বদলে তিনি এখন ফেসবুকের প্যারেন্ট কোম্পানি মেটার মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন। দিনে পাঁচ-থেকে ছয়বার ইনস্টাগ্রামে প্রবেশ করেন তিনি। আর দৈনিক ঘণ্টাখানেক টিকটকে স্ক্রল করে কেটে যায় তার।
ষষ্ঠ গ্রেডে থাকতে ফেসবুকে যোগ দিয়েছিলেন ওয়ালশ। এখন তিনি আর ভাবতেই পারেন না তার জীবনের নিয়মিত অংশ হতে পারে এটি।
ফেসবুকের কথা শুনলে এখন তার বুড়োদের তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের ছবি পোস্ট করার জায়গা, আর রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মানুষের ঝগড়াঝাঁটির কথাই মনে হয় বলে জানান তিনি।
আইফোনের আগে জন্ম হয়েছিল ফেসবুকের। এক সময়ের 'কুল' এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বয়স প্রায় দুই দশক হতে চলল। ২০০৪ সালে মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ফেসবুক চালু করেছিলেন।
এ মুহূর্তে এসে বেশ অদ্ভুত একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে প্ল্যাটফর্মটি। বর্তমানে প্রতি মাসে তিন বিলিয়ন তথা তিনশ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। এ সংখ্যাটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। প্রতিদিন ফেসবুকে লগ ইন করেন দুইশ কোটি মানুষ। তারপরও প্রাসঙ্গিকতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে ফেসবুক। সেই সঙ্গে দুই দশক পুরোনো এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি এখন ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়েও চিন্তিত।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের যারা হাইস্কুলে থাকতে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল অথবা যারা এখন হাইস্কুলে পড়ছে — তাদের কাছে ফেসবুক সন্দেহাতীতভাবে সেকেলে বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ প্রজন্ম যেকোনো ট্রেন্ড শুরু করার অগ্রভাগে থাকে।
তাই তাদেরকে আকৃষ্ট করতে না পারলে ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা ইমেইলের মতো — জিনিসটা হয়তো বেশ কাজের, কিন্তু ব্যবহার করে আনন্দ নেই।
কিন্তু বিষয়টি সবসময় এমন ছিল না। প্রায় এক দশকের মতো সময় ফেসবুক সবার আকাঙ্ক্ষিত সোশ্যাল মিডিয়া ছিল। মানুষের প্রতিদিনকার কথাবার্তা, আলাপের একটা অংশজুড়ে থাকত ফেসবুক। এমনকি হলিউডের সিনেমাতেও জায়গা পেয়েছিল ফেসবুক।
ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মাইস্পেস। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকে ঝুঁকে পড়ায় মাইস্পেস তার জনপ্রিয়তা পুরোপুরি হারায়। 'মাইস্পেস ব্যবহারের জন্য আমাদের সবাইকে ছোটখাটো কোডিং জানতে হতো,' বলেন ২৮ বছর বয়সী মইরা গেনর। 'এ কারণেই হয়তো ফেসবুক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কারণ মাইস্পেসের তুলনায় ফেসবুক ব্যবহার করাটা সহজ ছিল,' জানান তিনি।
জাকারবার্গ ফেসবুক বিক্রি করার চেষ্টা করেননি কখনো। তার বদলে ফেসবুককে মোবাইলে এনে তিনি একটি বিপ্লবই ঘটিয়ে ফেলেন। মাঝখানে ফেসবুকের কিছূ প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছিল। অর্কুট-এর কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। কিন্তু ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে এসব প্ল্যাটফর্ম হারিয়ে যায়।
এ দীর্ঘ যাত্রাপথে হোঁচট খাওয়ার কথা ছিল ফেসবুকের। ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি ক্ষুণ্ণ করা, হেট স্পিচ ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরও ২০১৫ সালে একশ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলকে পৌঁছায় ফেসবুক।
ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্স-এর বিশ্লেষক ডেবরা আহো উইলিয়ামসন ফেসবুকের শুরু থেকেই এটির খোঁজখবর রাখছেন। যদিও তার মতেও ফেসবুকের তরুণ ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে, তবে তিনি মনে করছেন না খুব শীঘ্রই ফেসবুক এর প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।
'এই যে ফেসবুকের ২০ বছর হওয়া নিয়ে আমরা কথা বলছি, এটাই প্রমাণ করে কলেজ জীবনে মার্ক জাকারবার্গ কী বস্তু তৈরি করেছেন। এটা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার,' বলেন তিনি।
তার মতে, বিশ্বজুড়েই ফেসবুক এখনো দারুণ শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফর্ম।
একসময় এওএল প্ল্যাটফর্মও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এর ব্যবহারকারীরা এখন বুড়িয়ে গেছেন। এওএল ডটকম ইমেইল ঠিকানা দিয়ে আজকাল নির্দিষ্ট বয়সের মানুষদের প্রযুক্তিগত অদক্ষতা নিয়ে কৌতুক বোঝানো হয়।
ফেসবুকের বর্তমান প্রধান টম অ্যালিসন (জাকারবার্গের উপাধি এখন মেটা'র সিইও) প্ল্যাটফর্মটির তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে আকৃষ্ট করার পরিকল্পনা নিয়ে অবশ্য বেশ আশাবাদী।
দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'একসময় আমাদের আলাদা একটি দল ছিল যারা কেবল তরুণদের নিয়েই কাজ করত। কিন্তু বছর দুয়েক আগে আমরা ভাবলাম, বিষয়টিকে বাদ দিতে হবে। বরং তরুণদের প্রয়োজনের কথা ভেবে আমাদের পুরো প্রোডাক্ট লাইনকেই বদলাতে হবে।'
অ্যালিসন এটিকে 'সামাজিক আবিষ্কারের' যুগ বলে অভিহিত করেছেন।
'তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে কী চাচ্ছে সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। সহজ কথায় বললে, আমরা ফেসবুককে এমন একটি স্থানে পরিণত করতে চাই যেখানে আপনি আপনার পরিচিতদের সঙ্গে, যাদেরকে চিনতে চান তাদের সঙ্গে এবং যাদেরকে চেনা উচিত তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন,' অ্যালিসন বলেন।
আর এ পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। টিকটক এর এআই ও অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীকে এমন সব আধেয় দেখায়, যেগুলো আগে না দেখলেও আগ্রহ বোধ করেন তারা। ফেসবুকও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুনরায় তরুণ ব্যবহারকারীদের ফিরে পেতে চাইছে।
ব্যবহারকারীদের জনমিতি বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করতে সবসময় অস্বীকৃতি জানিয়েছে ফেসবুক। তবে বাইরের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, তরুণ ব্যবহারীর সংখ্যা কমছে। একই কথা সত্য কিশোর ব্যবহারকারীদের জন্যও। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ফেসবুক এখন সরাসরি কিশোরদের প্ল্যাটফর্মটিতে আকৃষ্ট করছে না।
'প্রায়শই তরুণেরাই যোগাযোগের ভবিষ্যৎ দাঁড় করিয়ে দেন। মানে ফেসবুকটাইতো এভাবেই দাঁড়াল। ফেসবুকের পর যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসেছে, সেগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে — তরুণেরা আকর্ষণ বোধ করেছেন,' বলেন উইলিয়ামসন।
তিনি মনে করেন না, এ দৃশ্যপট সহসা উল্টে যাচ্ছে। কিন্তু ইনসাইডার-এর অনুমান, এ ট্রেন্ড চলবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। তরুণদের এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে সংখ্যা কমে যাচ্ছে সত্য, তবে এ হ্রাস ধীরগতির।