আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসা জাহ্নবী যেভাবে ফোর্বসের তালিকায়!
২০১৯ সাল, জাহ্নবী রহমান তখন রুয়েট (রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ফাইনালে একটা ম্যাথ কোর্সেও পাস করতে পারেননি। ব্যাকলগ (পুনঃপরীক্ষা) দিতে হবে মোট তিন কোর্সে। ক্লাস, ল্যাব আর পার্ট টাইম প্রজেক্টের কাজে চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন আগে থেকেই। পদ্মার পাড়ে বসে ভাবছিলেন জীবনটা শেষ করে দেওয়া যায় কি না। মৃত্যু নিয়ে নিশ্চিত হতে না পারায় ফিরে এসেছিলেন সেবার। জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া সেই জাহ্নবী এবছর সামাজিক প্রভাব শ্রেণীতে জায়গা করে নিয়েছেন 'ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০২৩' এর তালিকায়।
ঢাকায় বেড়ে ওঠা জাহ্নবী পরিবার ছেড়ে রাজশাহীতে থাকতে শুরু করার পর থেকেই বুঝেছিলেন জীবন কতটা কঠিন। আপনজন থেকে দূরে, নতুন বন্ধুবান্ধব, নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন বারবার। ডিপ্রেশন, সিভিয়ার এংজাইটির সঙ্গে লড়াই করে কয়েকবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে গেছেন মায়ের কথা ভেবে। নিজের লড়াইয়ের পাশাপাশি জাহ্নবী চেয়েছিলেন তার মতো যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা আরো অনেকের পাশে দাঁড়াতে। সেই থেকেই শুরু হয় মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তায় প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠান 'রিল্যাক্সি – সেলফ কেয়ার অন দ্য গো'র পরিকল্পনা।
বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের উদীয়মান তরুণদের তালিকায় জায়গা করে নেওয়া রিল্যাক্সির সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাহ্নবী রহমান তার পথচলার গল্প শোনালেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার 'নন জাজমেন্টাল' প্ল্যাটফর্ম রিল্যাক্সি
রুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালীন মানসিক যন্ত্রণার কারণে প্রফেশনাল থেরাপিস্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল জাহ্নবীকে। আশেপাশের বন্ধুরা সে কথা জানতে পেরে বেশ হাসাহাসিই করেছিল তখন। মানসিক স্বাস্থ্য যে গুরুতর বিষয় তা বোঝার সক্ষমতা ছিল না তাদের। কারো কারো কাছে তো 'পাগল' খেতাবও পেয়েছিলেন জাহ্নবী। দুর্বল মানসিক অবস্থায় কাছের মানুষদের এমন জাজমেন্টাল ব্যবহারে আরো মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই নিজের গড়ে তোলা প্ল্যাটফর্ম রিল্যাক্সিতে নন জাজমেন্টাল পরিবেশ বজায় রাখাই ছিল তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।
'এংজাইটি, ডিপ্রেশন বা যেকোনো মানসিক সমস্যাতে থেরাপি নেওয়া অনেক পরের ধাপ। শুরুতেই সমস্যাটির গ্রহণযোগ্যতা বা স্বীকৃতি দরকার। আশেপাশের মানুষ যদি আপনার মানসিক দুরাবস্থাকে গুরুত্ব না দেয়, আপনার কী সমস্যা হচ্ছে বুঝতেই না পারে তাহলে আপনি চিকিৎসা নিয়েও পুরোপুরি সুস্থ থাকতে পারবেন না। তাই আমরা চেষ্টা করেছি মানুষের সব ধরনের অনুভূতিকে গুরুত্বের সাথে দেখার একটা নির্ভরযোগ্য জায়গা তৈরি করতে,' বলছিলেন রিল্যাক্সির সিইও জাহ্নবী।
২০১৯ সাল থেকেই দুই বন্ধু নাইমুল হক জয় ও সামিউল ইসলাম স্বপ্নীলের সঙ্গে পরিকল্পনা চলছিল রিল্যাক্সি নিয়ে। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কীভাবে অবদান রাখা যায় তা নিয়েই তারা ভেবেছেন বছরখানেক। ২০২১ সালে প্রথম ফেসবুক পেজ হিসেবেই রিল্যাক্সির যাত্রা শুরু হয়।
শুরুতে সেই ফেসবুক পেজে সাইকোলজিস্টদের সঙ্গে পডকাস্ট, ফেসবুক লাইভের আয়োজন করেন তারা। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা দিকের আলোচনা করা হয়। মেসেজিং ও কলের মাধ্যমে এক হাজারের বেশি মানুষকে ফ্রি সাইকো থেরাপির সেশনও দেওয়া হয় রিল্যাক্সি পেজ থেকে।
এই সেবাকে যথাযথভাবে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তৈরি করা হয় রিল্যাক্সি অ্যাপ। ২০২২ সালের জুলাইতে লঞ্চ করা এই অ্যাপটি এ পর্যন্ত ডাউনলোড হয়েছে ১৮ হাজারের বেশি বার। সরাসরি এই অ্যাপ ব্যবহার করেছেন ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ।
যেভাবে সেবা দেয় রিল্যাক্সি
রিল্যাক্সি অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করার সময়ই ব্যবহারকারী তার নিজের জন্য যেকোনো ছদ্মনাম বেছে নিতে পারেন। তিনি চাইলে সেই নাম দিয়েই যোগাযোগ করতে পারেন অ্যাপ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে। রিল্যাক্সিতে ব্যবহারকারীদের তথ্য গোপন রাখায় সর্বোচ্চ নজর দেওয়া হয়েছে।
জাহ্নবীর ভাষ্যে, 'অনেকেই তার সমস্যাগুলো অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না লোকে তার সম্পর্কে কী ভাববে তা চিন্তা করে। এক্ষেত্রে নাম, পরিচয় গোপন রেখে কথা বলার ব্যবস্থাটা খুব কার্যকরী। রিল্যাক্সিতে ইউজারদের সব তথ্য পুরোপুরি গোপন থাকে। এমনকি আমাদের টিমের কেউ চাইলেও গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না।'
রিল্যাক্সি অ্যাপের মাধ্যমে অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্টদের সঙ্গে ফ্রি-তে চ্যাট করা যায় যেকোনো বিষয়ে। থেরাপির প্রয়োজন হলে ৪৫০ টাকায় বুক করা যায় অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্টদের অনলাইন সেশন। ব্যবহারকারীদের সমস্যার ধরন অনুযায়ী আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে সেশনগুলোকে। 'ওভারকাম ডিপ্রেশন', 'স্লিপ বেটার', 'কিপ ইউর কাম', 'বার্ন আউট', 'বিল্ড ফোকাস', 'ফাইন্ড হ্যাপিনেস', 'ফাইট লোনলিনেস', 'কন্ট্রোল অ্যাংগার' নামে বিভক্ত সেশনগুলোতে পাওয়া যায় বিশেষায়িত সেবা। এক্সপার্টদের সঙ্গে অডিও, ভিডিও কল, অনলাইন সেশন, নানা ধরনের ওয়ার্কশিট অন্তর্ভুক্ত থাকে এই সেশনগুলোতে। এপর্যন্ত রিল্যাক্সিতে থেরাপি সেশন বুক করেছেন সাত হাজারের বেশি মানুষ।
ফেসবুক স্ট্যাটাসের মতো করে নিজেদের মনের কথাও ব্যক্ত করা যায় রিল্যাক্সির ফিডে। তবে ফেসবুকের সঙ্গে এর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো রিল্যাক্সির ব্যবহারকারী সবাই একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। যে যার মতো করে সাহায্য করার চেষ্টা করে হতাশা, দুশ্চিন্তা বা অবসাদগ্রস্ত কোনো ব্যবহারকারীকে।
ব্যবহারকারীরা একে অন্যের সঙ্গে চ্যাটও করতে পারেন এখানে। 'লিসেনার' হিসেবে শুনতে পারেন সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো ব্যক্তির মনের কথা। যা পরিচিত কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছিলেন না ব্যক্তিটি।
অ্যাপ ব্যবহারপকারীরা তাদের তাৎক্ষণিক 'মুড' আপডেট জানাতে পারেন তাদের প্রোফাইলে। 'মুড জার্নাল'-এ জমা হয়ে থাকে ব্যবহারকারীদের মানসিক অবস্থার বিবরণী। যা থেকে পরবর্তীতে সেবা নেওয়াও সহজ হয়। মেডিটেশনের ব্যবস্থাও আছে অ্যাপটিতে।
দুইজন সাইকোলজিস্ট ছাড়াও রিল্যাক্সির যাবতীয় কাজ দেখাশোনার রিল্যাক্সির দলে আছেন ১০ জন। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে আইসিটি টাওয়ারে তাদের অফিস কার্যক্রম চলে।
পথচলার সবে শুরু
রিল্যাক্সির অফিসিয়াল যাত্রা শুরুর এক বছরও হয়নি এখনো। এরমধ্যেই ফেসবুক পেজ ও নিজস্ব অ্যাপ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার নানা দিক তুলে ধরেছে জাহ্নবী ও তার দল।
আত্মহত্যা নিরোধক সচেতনা তৈরির জন্য ফিজিক্যাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক (পিএইচডব্লিউসি)-এর সঙ্গে পার্টনারশিপে কাজ করছে রিল্যাক্সি। হুয়াওয়ের আইসিটি ইনকিউবেটর ২০২২-এ দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিল অ্যাপটি।
ফোর্বসের থার্টি আন্ডার থার্টি-তে মনোনীত হওয়ার পর চারদিক থেকে প্রশংসায় ভাসছেন জাহ্নবী রহমান। রিল্যাক্সি ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুতবেগে। কিন্তু এপর্যন্ত আসার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না তার জন্য।
স্টার্টআপ নিয়ে খুব একটা ধারণা ছিল না তার বাবা-মায়ের। পড়ালেখার বাইরে জাহ্নবীর এসব কর্মকাণ্ডে তাই খুব একটা খুশি ছিলেন না তারা। ২০২২ সালে রিল্যাক্সির অ্যাপ লঞ্চ করার সময় তিনি ছিলেন সিএসই-র শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব সামলে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষকদের বকুনিও শুনতে হয়েছে অনেকবার। সব বন্ধু-বান্ধবেরাও যে খুব একটা সহযোগী ছিলেন তা বলা যায় না। তবু দুই বন্ধু স্বপ্নীল আর জয়কে পাশে পেয়েছেন বলেই রিল্যাক্সি নিয়ে এতদূর আসতে পেরেছেন বলে মনে করেন জাহ্নবী।
সম্প্রতি সাজেদা ফাউন্ডেশন থেকে বেশ ভালো অংকের বিনিয়োগ পেয়েছে রিল্যাক্সি দল। ভবিষ্যতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও রিল্যাক্সি বেশ লাভজনক হবে বলে আশা করছেন জাহ্নবী রহমান। রিল্যাক্সি নিয়েই ভবিষ্যতে সফলতার পথে এগোতে চান তিনি।