বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফেরা: শিকারি-ই যখন শিকার
বঙ্গোপসাগর তীরের অনাবীল এক প্রাকৃতিক লীলাভূমি সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাদাবনের এই রূপ 'ভয়ঙ্কর সুন্দর' বলাই যায়। জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ' - যুগ যুগ ধরে এমন পরিচিতিই এ বনের। মাছ, কাঁকড়া শিকার, মধু ও কাঠ সংগ্রহ – নানান পেশার বনজীবী মানুষের জীবিকার জোগানও দেয় এই বন। দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট অবলম্বনে।
সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের এমনই এক জেলে মিহির সর্দার। ৫২ বছরের মিহির বিপদসঙ্কুল এই অরণ্যের এক দুর্গম জনপদের বাসিন্দা। তারপরও বাঘের আক্রমণের কথা কেবল শুনেছেন গ্রামবাসীদের থেকে। ভয়াল সেই অভিজ্ঞতা তার নিজের কখনো হয়নি। বনে মাছ ধরার সময় বাঘের মুখোমুখিও হননি কখনো। ফলে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের সেই হিমেল দিনে হয়তো অসতর্কই ছিলেন কিছুটা।
সেদিন ভোর হতেই নৌকা নিয়ে বন্ধু বাবলুর সাথে মাছ শিকারে যান মিহির। বনের নিষ্পন্দ এক খাঁড়ির নোনা জলে পাতছিলেন জাল। সকাল ৮টার মধ্যেই জাল বেছানোর কাজ শেষ হয়। দুজনে ঠিক করেন, সেদিন ও রাতটা তারা বনে নৌকার ওপরই কাটাবেন। পরদিন সকালে জাল তুলে মাছভর্তি নৌকা নিয়ে ফিরবেন। নৌকা যেখানে নোঙ্গর করেছিলেন, সেখান থেকে তাদের গ্রামের দূরত্ব ২৫ মাইলের বেশি ছিল না।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইনডিপেন্ডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন মিহির।
"তখন সন্ধ্যা, ক্লান্তও ছিলাম বেশ। ফলে নৌকাতেই ঘুমিয়ে পড়ি। নৌকায় সামনে ও পেছনে দুটি দরজা। সামনের দরজায় তালা দিয়েছিলাম। কিন্তু পেছনের দরজায় তালা দিতে ভুলে যাই।"
এই ভুলেই প্রাণ হারাতে বসেন তিনি। কারণ, পেছন দিক দিয়েই বাঘ এসে তাকে আক্রমণ করে। সেদিন ভাগ্যক্রমে প্রাণ বাঁচে মিহিরের।
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চারণভূমিতে এরপর বেঁচে ফেরার বরাত খুব কম মানুষেরই হয়। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তঘেঁষা সুন্দরবনের বাঘেরা যেমন বিশ্বখ্যাত, তেমনি তাদের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এখানেই। ভারতে সুন্দরবনের জাতীয় উদ্যান অংশে প্রায় ১০০ বাঘ রয়েছে। গঙ্গা নদীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রায় ১,৩৩০ বর্গ কিলোমিটার ঘন বনভূমি এই জাতীয় উদ্যান।
দেহরাদুন-ভিত্তিক ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া'র ডিন এবং বন্যপ্রাণি সংরক্ষণবিদ ড. যোদবেন্দ্রদেব ঝালা বলেন, গোটা ভারতে বাঘের আক্রমণ খুবই বিরল এক ঘটনা। তবে হয় কখনোসখনো, বিশেষত সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। আসলে এই বাঘেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব বসতিতে না এসে, তাদের আধা-জলজ বনভূমিতে থাকতেই পছন্দ করে। কিন্তু, মানুষ যখন বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ে, তখন অন্যকথা।
"বাঘেরা এখানে শব্দ শুনে শিকার করে। তাই কোনোকিছু নড়াচড়া বা শব্দ সৃষ্টি করলেই, তারা খাদ্য মনে করে হামলা করে বসে। তাছাড়া, অন্যান্য বনের বাঘের যেমন মানুষ নিয়ে জন্মগত ভয় রয়েছে, সেটা সুন্দরবনের বাঘের নেই।"
সেদিন নৌকা করে বাঘেদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করেন মিহির সর্দার। এটা তার চরম ভুল ছিল বলেই মনে করেন আজ। প্রায় ২০ মিনিট ধরে যে জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা কোনোদিনই ভুলবার নয়। মুছে যাবার নয় শ্বাপদের নখ ও দাঁতের ক্ষতচিহ্ন।
"বাম পায়ে কামড়ে ধরে বাঘ আমাকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। এরপর খাবার জন্য আমার ওপর হামলে পড়ে। আমি কোনোরকমে সামনের দুই থাবা ধরে ঠেকানোর চেষ্টা করি। বাবলু সেদিন আমার জীবন বাঁচাতে অসম সাহসীকতার পরিচয় দেয়। সে পিঠে চেপে বাঘের মাথা উঁচু করে ধরে রাখার চেষ্টা করে, যাতে বাঘ আমাকে খেতে না পারে। এরপর সে এক পর্যায়ে মাটিতে পড়ে যায়।"
শিকারের সময় বাঘ যাকে লক্ষ্য করে, তাকেই হত্যার চেষ্টা করে। আশেপাশের অন্যদের দিকে তেমন মনোযোগ দেয় না। তাই বাবলু যখন বাঘকে ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন সুযোগ বুঝে আহত পা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নৌকার ফিরে আসেন মিহির। এদিকে বাঘের পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর বাঘের চোখে কাদা ছুঁড়ে দেন বাবলু, আর তারপর তিনিও পালিয়ে আসেন।
ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেনি বাঘটি। বরং চলে যায় সেখান থেকে। বাঘ যদি তার মাথায় বা ঘাড়ে কামড়াতে পারতো তাহলে যে কী হতো – সেকথা ভেবে আজো শিউরে ওঠেন মিহির। কিন্তু, তাই বলে অক্ষত ছিলেন না। তার জখম এতটাই মারাত্মক ছিল যে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কোনোক্রমে টিকেছিলেন। বাঘের আক্রমণে এক পা, এক চোখ হারান তিনি। মাথার খুলির বাম পাশের অংশও ছিল না।
আহত মিহিরের জীবন এবার দ্বিতীয়বার বাঁচান বাবলু। রক্তপাত বন্ধ করতে ঘাগুলোয় কাদার পুরো প্রলেপ লাগিয়ে দেন। মিহির বলেন, "আরো রক্তপাত হলে সেদিন আমি হয়তো সেখানেই মারা যেতাম।"
দুর্ভোগের তখন শুরু কেবল। বাঘের আক্রমণ রাতের দিকে হওয়ায় তখনই জঙ্গল থেকে বেরোনোর উপায় ছিল না। সেজন্য ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হতো। ফলে রাতটা নৌকাতেই কাটান তারা। এরপর ভোর হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান বাবলু।
পরের দুই মাস হাসপাতালের শয্যায় যমে-মানুষে টানাটানি চলে মিহিরকে নিয়ে। ডাক্তাররা বলতে পারছিলেন না, এই রোগী বাঁচবে কিনা। কিন্তু, এবারও বেঁচে যান মিহির।
"(হাসপাতাল থেকে) বাড়ি ফিরে আসলেও এখনও ভীষণ ব্যথা হয়। আমার খুলির একপাশ দেখে মনে হয় সমান। কিন্তু, সিটি স্ক্যানে দেখলে বুঝবেন খুলিতে কি মারাত্মক আঘাত পেয়েও আমি বেঁচে গেছি"- বলছিলেন তিনি।
ওই আক্রমণের পর থেকে তার পরিবারের আর কেউই বনের পথ মাড়ায়নি। মিহির বলেন, "ঋণ নিয়ে আমার ছেলে একটি অটোরিক্সা কিনে চালায়, আয়ের উৎস হিসেবে আমরা আর বনের ওপর নির্ভরশীল নই। বাঘের মুখ থেকে নিজে বেঁচেছি, তাই পরিবারের আর কাউকে সেই বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাইনি।"
ভারতের সুন্দরবন অংশের ৫৪টি দ্বীপে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের বসবাস।
বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ সংস্থা- ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার গবেষক ড. মেধা নায়ক বলেন, এসব মানুষ তাদের দৈনন্দিন চাহিদা ও জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা কাঁকড়া, চিংড়ি, মাছ শিকার করে। সংগ্রহ করে মধু ও রান্নার কাঠ।
এরমধ্যে কিছু সম্পদ টেকসইভাবে আহরণ করা হলেও, টাইগার রিজার্ভের আশেপাশের গ্রাম এবং সীমান্ত এলাকায় উপলব্ধ সরবরাহের চেয়ে অন্য সম্পদগুলোর উপর চাপ বেড়েছে।
ড. মেধা বলেন, "সময়ের সাথে সাথে চিংড়ি ও মধুর মতো কিছু আইটেমের বাজার চাহিদা অনেকগুণ বেড়েছে। আর এসবের চাহিদা শুধু ভারতে নয়, বিশ্ববাজারেও রয়েছে।"
অথচ সংরক্ষিত রিজার্ভ এলাকা শুধু বাঘের আবাসস্থলই নয়, অন্যান্য প্রাণবৈচিত্রেও ভরপুর। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এস পি যাদব বলেন, সংরক্ষিত এলাকায় প্রায় ১১০ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, ৬৪ ধরনের কাঁকড়া এবং ১১০ ধরনের মাছের প্রজাতি রয়েছে।
"এখানে বাঘ ছাড়াও আছে মেছোবাঘ, বিরল চিতাবাঘেরও (গুলবাঘ) দেখা মেলে। এছাড়া চিতল হরিণ, বন্যশুকর ও বাঁদর আছে, যারা বাঘের প্রধান খাদ্য। যে বনে মানুষের এত চলাচল সেখানে বন্যপ্রাণি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত হতেই পারে। তবে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের (এসটিআর) একটি ভালো দিক হচ্ছে, এখানে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। আর বন্যপ্রাণি (সুরক্ষা) আইন অনুসারে, কোর এরিয়া পুরোপুরি মানব বসতি মুক্ত। "
"তবে এই রিজার্ভের প্রধান সমস্যা – মাছ ধরতে স্থানীয় মানুষের অবৈধ অনুপ্রবেশ। বন্যপ্রাণির সাথে সংঘাতের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা আসে"- যোগ করেন তিনি।
বাঘের কবলে পড়ে মিহির সর্দার প্রাণে বাঁচলেও তার জেলা- দক্ষিণ ২৪ পরগণার অন্যদের ভাগ্য এতটা সহায় হয়নি। এই হতভাগ্যদের একজন বিনয় সরকার, ২০১৮ সালে বাঘের শিকারে পরিণত হন। এমনকী তার দেহাবশেষও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তার বিধবা স্ত্রী গীতা সরকার ঘটনার বর্ণনা দেন। "আমার স্বামী নৌকায় রান্না করছিলেন। তার সাথে আরো দুজন ছিলেন। তার সঙ্গীরা তখন মাছ ধরতে ব্যস্ত। এরমধ্যেই বাঘ এসে ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায়।"
গীতা জানান, বন থেকে মাছ ধরেই চলতো তাদের সংসার। "আমাদের ছয় সন্তান। তাই ওকে জঙ্গলে যেতেই হতো। কারণ, মাছ না ধরলে আমাদের দিন চলবে কীভাবে? আয়ের অন্য উপায়ও তো আমাদের ছিল না।"
তিনি দাবি করেন, সেদিন তার স্বামী ও তার দুই সঙ্গী বনবিভাগের পাস নিয়েই টাইগার রিজার্ভ সংলগ্ন বনে মাছ ধরতে যান। তাই আইনিভাবে তারা সরকার থেকে ক্ষতিপূরণের দাবিদার। তিন লাখ রুপির এই ক্ষতিপূরণ পেলে এই বিধবার অভাব ঘুচবে অনেকটাই।
কিন্তু, স্বামীর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরও একটি টাকাও পাননি তিনি। গীতা জানান, যাতায়াত ভাড়া জোগাড় করতে তিনি কিছু টাকা বাঁচিয়ে কলকাতার আলিপুরে সরকারি দপ্তরে যান ক্ষতিপূরণের টাকা দাবি করতে। "কিন্তু, কর্মকর্তারা আমাকে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আনতে বলেন। বিষয়টি তখন আমার জানা ছিল না। তাই আমি আবার গ্রামে ফিরে আসি। আবারো কিছু টাকা জমা করে আলিপুর যাই। এবার রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ার পর তারা আমাকে বলেন, এই মৃত্যুর ঘটনা অন্যান্য ফাইলের পেছনে পড়ে গেছে। আবার যখন ফাইল সিরিয়ালে আসবে আমরা আপনাকে জানাব।"
২০১৬ সালে বাঘের আক্রমণে অপর্ণা সিঁয়ালির স্বামী মারা যান। তিনি অবশ্য ক্ষতিপূরণের কথা জানতেনই না। ফলে সেজন্য আবেদনও করেননি। তবে গত নয় মাস ধরে তাকে বিধবা ভাতা দিচ্ছে সরকার।
এতে তার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে, কিন্তু অভাব দূর হয়নি। আসলে সিঁয়ালির স্বামী মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারের একমাত্র রুজিরোজগারের দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। পরলোকগত স্বামীর চেয়ে অনেক কম আয় করতেই পারতেন। এই বৈষম্যের প্রধান কারণ ছিল এই অঞ্চলে মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য। ফলে বহু বছর ধরে কষ্টেসৃষ্টে চালান সংসার।
সিঁয়ালি জানান, "উনি বেঁচে থাকতে মাসে ৮-১০ হাজার রুপি আয় করতেন। তার মৃত্যুর পর আমাকেও কাজে যেতে হয়েছে। কিন্তু, যেখানে পুরুষরা মজুরি পায় ৩০০ রুপি, সেখানে আমাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৫০ রুপি।"
ড. যাদব জানান, কেউ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে কিনা ভারতে তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয়। প্রমাণিত হলে, নিহতের পরিবার পাঁচ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ পায়। তবে রাজ্যভেদে ক্ষতিপূরণের অর্থ কমবেশি হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে তা কিছুটা কম।
তবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে যায় যদি ভিকটিম সুরক্ষিত এলাকায় বিনা-অনুমতিতে প্রবেশ করে। তিনি বলছিলেন, "টাইগার রিজার্ভে বাঘ ও মানুষের সংঘাতের ঘটনা ঘটে –কারণ সেখানে বাঘের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। বিশেষত, গর্ভবতী ও ছোট শাবক আছে এমন বাঘিনীরা খুবই সতর্ক থাকে। বাঘিনী তার এলাকায় কোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তাকে আক্রমণ করে।"
নাম না প্রকাশের শর্তে ভারতের সুন্দরবন অংশের একজন সিনিয়র বন-কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, "অনুমতি ছাড়া বনে যাওয়ার পর বাঘের আক্রমণে কেউ মারা গেলে, তার আত্মীয়দের পক্ষে ক্ষতিপূরণ পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে যায়।"
তবে বিদ্যমান ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে তিনি বলেছেন, যথাযথ লাইসেন্স দিয়ে বনে যারা যায় তাদের কেউ হতাহত হলে – দ্রুত ক্ষতিপূরণ পেয়ে যায়। ফলে এটি কার্যকর একটা ব্যবস্থা। "কোনো দূর্ঘটনার কথা জানা মাত্রই ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা হয়। এরপর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে তার প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় ঘটনার ২০ থেকে সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে ভিকটিমের স্বজনরা ক্ষতিপূরণ পেয়ে যান।"
তবে এসব বিষয়ে গ্রামবাসীর যথাযথ জানাশোনা না থাকাটাকেই তিনি প্রধান সমস্যা বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, গ্রামবাসীর দাবি নৌকার পাস নেওয়া তাদের পক্ষে বেশ ব্যয়বহুল। ফলে অনেক সময় তারা বিনা অনুমতিতে বনে যেতে বাধ্য হয়। সুন্দরবন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। সাইক্লোনের পর পরই বনে অবৈধভাবে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এখন ঘন ঘন হানা দিচ্ছে। ফলে বনের সম্পদের ওপর তারা আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগানের চেষ্টায়।
এক দশক আগে সাইক্লোন আইলার কথা স্মরণ করে ৬০ বছরের বৃদ্ধা আরতি মণ্ডল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বহু মাস ধরে মাটি লবণাক্ত হয়েছিল। নতুন করে ফসল ফলানোর উপায়ও ছিল না। আমাদের মাছের ঘের, মুরগির খামার সব ভেসে যায়। তখন আমার স্বামী নিরুপায় হয়ে বনে যান। কিন্তু, নদী সাঁতরে এসে বাঘ তার ওপর হামলা করে হত্যা করে।
স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে বনের ধারেকাছেও আর যেতে দেননি তিনি। কিন্তু, বিকল্প কাজের সুযোগও খুব কম দারিদ্রপীড়িত এই অঞ্চলে। অনেক কষ্টে অবশ্য সে ব্যবস্থাও হয়। অনেক কষ্টে ঋণ করে ছেলেকে একটি গাড়ি কিনে দেন। এখন সেই গাড়িতেই যাত্রী বহন করে সে।
স্থানীয় একটি এনজিও – গোড়ানবোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র দাবি করে, সাইক্লোনের পাশাপাশি অন্যান্য কিছু ঘটনাও সুন্দরবন এলাকায় বাঘ ও মানুষের মধ্যে চিরায়িত ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে।
এরমধ্যে অন্যতম হলো করোনা মহামারি। কোভিডের প্রথম লকডাউনের সময়েই শহরে কাজ করা বহু শ্রমজীবী মানুষ নিজ গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়।
এনজিও'র প্রতিস্থাতা-সচিব নীহার রঞ্জন রপ্তান বলেন, সুন্দরবনের গ্রামগুলোয় হঠাৎ করেই অনেক মানুষ চলে আসায়, বনের সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এতে বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণে বেড়েছে।
বাঘের আক্রমণের ঘটনাগুলো একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে গোড়ানবোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র। সেই সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে (মহামারির আগে) যেখানে মাত্র ৩০টি বাঘের আক্রমণের ঘটনা ঘটে, তা মহামারির প্রথম বছর ২০২০ সালে হঠাৎ করেই বেড়ে ৭৮টিতে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬০টি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান – অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো ড. অনামিত্র অনুরাগ দন্ড বলেন, রাতারাতি বাঘে-মানুষে সংঘাতের ঘটনা বাড়ে না। "কিন্তু, তেমনটাই হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সাইক্লোন ও করোনা মহামারির মতো আকস্মিক সংকটের সময় স্থানীয় মানুষের বনের সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াই এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে।"
এছাড়া, বাঘ যেন না আসতে পারে সেজন্য গ্রামগুলোর পাশে বেড়া দেওয়া হয়। এই বেড়া সাইক্লোনে ভেঙ্গে পড়লেও বাঘ খাদ্যের সন্ধানে চলে আসতে পারে। "তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর বন্যপ্রাণি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়ার সেটাও আরেক কারণ।"
তবে তার মানেই যে বাঘের আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে, এমনটা মনে করেন না তিনি।
ড. যাদব-ও দাবি করেন, করনা-জনিত অভিবাসনের সাথে বাঘ ও মানুষের সংঘাত বৃদ্ধির তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানের তথ্য সমর্থন করেন না। গত চার বছরে সুন্দরবন রিজার্ভ এলাকায় এই সংঘাত বৃদ্ধির কোনো নির্দিষ্ট প্রবণতা দেখা যায়নি বলে জানান তিনি।
তবে বনের ওপর মানুষের ক্রমে বেড়ে চলা নির্ভরশীলতা কমানো যে একান্তই দরকার এবিষয়টি স্বীকার করেন অনেকেই।
ড. যাদব জানান, মানুষ যেন বনের রান্নার কাঠ সংগ্রহে না যায় সেজন্য 'উজালা' কর্মসূচির আওতায় দরিদ্রদের রান্নার গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।
সংরক্ষণবিদ ড. ঝালা জানান, পর্যটন ও প্রবেশ ফি বাবদ বনবিভাগ যে রাজস্ব আয় করে, তার অন্তত ৩০ শতাংশ স্থানীয় অধিবাসীদের পেছনে ব্যয় করার পরামর্শ দিয়েছে টাইগার টাস্ক ফোর্স।
তিনি বলেন, "সরকারের উচিত পর্যটনের মুনাফা থেকে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা দেওয়া। এতে সুরক্ষিত বনের আশেপাশের মানুষ লাভবান হবে, প্রকৃতি সংরক্ষণের গুরুত্বও তারা বুঝবে।"