আমলিগোলার মোষের শিংয়ের চিরুনি, হাতির হাড় ও দাঁতের বোতাম!
একজন শিখ ধর্মাবলম্বীকে অনায়াসেই চিহ্নিত করা সম্ভব পাঁচটি জিনিস দিয়ে। শিখধর্মে যাকে বলা হয় 'পঞ্চ ক'।
এই 'পঞ্চ ক' এর মধ্যে একটি হলো কাঙ্গী। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। কঙ্কতিকা> কঙ্কইআ> কাঁকই> কাঙ্গই, কাঙ্গী। যার অর্থ চিরুনি। রামায়ণেও এই 'কাঙ্গাই' বা 'কাঙ্গী' শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। হয়তো এখান থেকেই আদি ঢাকাইয়ারা চিরুনিকে 'কাঙ্গী' নামে চেনে।
বর্তমানে কাঙ্গী একটি অপ্রচলিত শব্দই বলা যায়। পশুর হাড় দিয়ে চিরুনি তৈরি হতো বলে এর নামকরণ 'কাঙ্গাই' হয়েছিল। এখনও আদি ঢাকাইয়াদের সাথে কথা বললে দেখা যায়, অনেক প্রবীণ বা মধ্যবয়সীরাই এই কাঙ্গী বা কাঙ্গাই শব্দটির সাথে পরিচিত।
একসময় ঢাকাতেই মহিষের শিং দিয়ে তৈরি হতো উন্নতমানের কাঙ্গাই। এই কাঙ্গাই তখন সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের চাহিদা মেটাতো।
আমলিগোলার মোষের শিংয়ের চিরুনি
গরু-মহিষের শিং, হাতির হাড় ও দাঁত দিয়ে পণ্য তৈরি হতো বলে, এ শিল্পকে বলা হতো কাঙ্গীসাজ শিল্প। ঢাকার লালবাগ কেল্লা সংলগ্ন আমলিগোলা, নবাববাগিচা, হাজারীবাগ, মসজিদগঞ্জ, চৌধুরী বাজার, ভাট মসজিদ, পোস্তা, খাজে দেওয়ান, রহমতগঞ্জ এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী মুসলমান শিল্পী পরিবারগুলো এই কাজে যুক্ত ছিল।
তবে লালবাগের আমলিগোলায় সবচেয়ে বেশি এই কাজ হতো। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল কারখানা, এবং প্রত্যেক পরিবারই এ কাজের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকতো। মুনতাসীর মামুনও তার 'হৃদয়নাথের ঢাকা' এবং 'ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী -১' উভয় গ্রন্থেই এ অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেছেন-'মোষের চিরুনি ও বোতাম তৈরির ব্যাপারে বেশ নামডাক আছে আমলিগোলার মুসলমানদের। প্রতিদিন এইসব জিনিসপত্র আমলিগোলা থেকে এনে বিক্রি করা হতো চকবাজারে।'(হৃদয়নাথের ঢাকা, মুনতাসীর মামুন)
'আমলিগোলার মুসলিমদের তৈরি মোষের শিংয়ের চিরুনি, বোতাম ও চুড়ি ছিল একসময়ের বিখ্যাত। মুঘল আমলে গড়ে উঠেছিল অঞ্চলটি। আমলিগোলা লালবাগ দুর্গের কাছেই, দুর্গের পশ্চিমে। এই আমলিগোলায় তৈরি মোষের শিংয়ের চিরুনি, বোতাম ও প্রভৃতির একসময় অনেক খ্যাতি ছিল।' (ঢাকা স্মৃতি- বিস্মৃতির নগরী -১, মুনতাসীর মামুন)।
ভারতবর্ষে মহিষের শিংয়ের চিরুনি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে মোগল আমলেই
মূলত মোগল আমলে এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মোগলরা এদেশে আসার সময় তাদের সাথে বহু পেশাজীবির মানুষ নিয়ে আসে। এদের মধ্যে এক শ্রেণি যোগ দেয় এই কাঙ্গীসাজে। এছাড়া, মোগল আমলে ঢাকায় দ্রুত বাণিজ্যিক প্রসার ও কলকারখানা নির্মিত হলে, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ সময়ে পেশাজীবীরা ঢাকায় এসে আবাস গড়ে তোলে। তাদেরও একটি অংশ যোগ দেয় হাতির দাঁত ও অন্যান্য পশুর হাড় দিয়ে বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্য তৈরির কাজে।
প্রথমদিকে কাঁচামালগুলো আসতো (হাড়, শিং ও দাঁত) তৎকালীন বাংলাদেশেরই বিভিন্ন স্থান থেকে। বিশেষ করে ঢাকার পিলখানা, গাজীপুর, সিলেট ও আসামের জঙ্গল থেকে হাতির দাঁত ও হাড় সরবরাহ করা হতো। মোগল আমলের পর অবশ্য এই কাঁচামাল আসতো ভারত থেকে।
সারা ভারতবর্ষে ললনাদের চাহিদা মেটানোর একমাত্র উৎস ছিল তখন ঢাকায় তৈরি এই চিরুনি। শুধু তাই নয়, বিদেশের মাটিতেও এই পণ্যের চাহিদা ছিল। ভারতবর্ষ বাদেও ইরান, তুরান, বাগদাদ, ইস্তাম্বুল ও আরব এলাকায় অভিজাত শ্রেণির চাহিদা মেটাত এই শিংয়ের চিরুনি।
বোতামের ছিদ্রের কাজটি করতে হতো তরুণীদের
কিন্তু এই রমরমা ব্যবসা থমকে যায় ইংরেজরা আসার পর। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। পর্যাপ্ত উপার্জন না হওয়ায় অনেক শ্রমিক অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে। আবার এ শিল্পের সাথে জড়িত অনেক পরিবার ইয়াঙ্গুন (পূর্বে রেঙ্গুন), চট্টগ্রাম, বরিশাল ও কলকাতায় চলে যেতে শুরু করে।
তবে ভাগ্যের ফেরে কাঙ্গীসাজ আবার মোড় ঘুরে দাঁড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধের জন্য ভারতবর্ষে ঘাঁটি গাড়ে ব্রিটিশ রাজশক্তি ও মিত্রশক্তি দেশগুলোর ব্যাপক সৈন্য। এসব লাখ লাখ সেনার উর্দির জন্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায় শিংয়ের বোতামের চাহিদা।
ঘরে ঘরে গড়ে ওঠে মহিষের শিংয়ের বোতাম ও চিরুনির কারখানা। শুধু ঘরের পুরুষ সদস্যরাই নয়, নারী সদস্যরাও হাত মেলাতে শুরু করেন। বোতামের ছিদ্র তৈরির কাজটি করতে দরকার হতো সূক্ষ্ম মনোযোগ ও চোখের জ্যোতির। তাই এই কাজটি তরুণী বা কিশোরীদের দিয়ে করানো হতো। দু'পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আটকিয়ে, কাঠের কাঠামো হাত দিয়ে ঘুরিয়ে লোহার ধারালো শলাকা দিয়ে একপিস একপিস করে বোতামে ছিদ্র করতেন তারা। এছাড়া, কম্বল ও পুরোনো শাড়ি দিয়ে পালিশ করার কাজটিও নারীরা করতেন।
এভাবে ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কাজগুলো করে নিজেদের হাতখরচও যোগাড় করতে পারতেন তখনকার নারীরা।
একপর্যায়ে এই বোতামের চাহিদা এত বৃদ্ধি পায় যে, এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা শিং সংগ্রহের জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা শিংয়ের বিকল্প উৎস সন্ধানে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা প্রভৃতি অঞ্চলে চলে যায়। অনেকে শুধু শিং সরবরাহকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ভারতের ওইসব অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের অনেকে পরে আর দেশে ফিরে আসেনি।
ভরা দুর্ভিক্ষে তারা উৎসবের আমেজে খানাপিনা চালিয়ে গেছে
স্থানীয় বাজারের চাহিদার কারণে লালবাগের পরিবারগুলো (যারা এ ব্যবসায় জড়িত) এ সময় বেশ ফুলেফেঁপে ওঠে। এমনকি '৪২ এর দুর্ভিক্ষও তাদের ছুঁতে পারেনি। ভরা দুর্ভিক্ষে তারা উৎসবের আমেজে খানাপিনা চালিয়ে গেছে আর বুক ফুলিয়ে বলেছে, 'চাউলের দাম যতই হোক, আমরা ভাত খাবোই।' (ঢাকাইয়া আসলি, আনিস আহমেদ)
'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ে নাজির হোসেন তাদের সম্পর্কে বলেন, এসব ব্যবসায়ীরা সবসময় বর্তমানে বাস করতো। ভবিষ্যৎ বলে তাদের জীবনে কিছু ছিল না। তখনকার দিনে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করেও নিজেদের বসতবাড়ির কোনো উন্নতি তারা করতে পারেনি। সে-ই একইরকম জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ছিল বাড়িঘরের। সব টাকা যেত নেশা-বেশ্যা আর জুয়োর আড্ডায়।
তবে এ জীবন ছিল মহাজন বা ব্যবসায়ীদের। কারিগরদের জীবন এমন ছিল না। তারা বেশিরভাগই আসতেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। কাজ হিসেবে টাকা পেতেন। কাজ না করলে টাকাও পেতেন না। তবে তারাও সচ্ছল ছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময়ও অনাহারে থাকতে হয়নি তাদের।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত কারিগরদের জীবনও ছিল সুখের সমৃদ্ধির। তারাও একসাথে আড্ডা দিতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন। সাপ্তাহিক ছুটি ছিল শনি ও রবি। শীতকাল এলে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে কারিগররা চাঁদা তুলে মাংস-পরোটার ভোজ উৎসব করতো। এশার নামাজের পর শুরু হতো এই 'বাংলা' (আড্ডাকে তখন বাংলা বলা হতো)। সারারাত একদিকে চলতো কিসসা কাহিনী, আর অন্যদিকে চুলায় পাক হতো মাংস, পরোটা-রুটি। কনকনে শীতের রাতে মাটিতে চট বিছিয়ে একে অপরের গল্প শুনতো। দুঃখের গল্প শুনলে কান্না, সুখের গল্প শুনলে হাসি। সমস্ত রাত চলত এই কিসসা কাহিনী। বউ, বাচ্চাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিত। যেন তারাও এই আনন্দ ভোজের অংশীদার হয়। এভাবেই চলতো তাদের সহজ, সুন্দর সাবলীল জীবন।
শেষজীবনটা এমনই কষ্টের ছিল পরিবারটির
তবে যখন এই কাঙ্গাই পণ্যের বাজার বিলুপ্ত হয়ে যায়, অনেক পরিবারই তাদের জীবিকার পথ নতুন করে খুঁজতে শুরু করে। অনেকে আবার পথে বসে যায়। এমন একটি পরিবারের কথা জানা যায় এলাকার বয়োজ্যাষ্ঠ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের কাছে। পেশায় তিনি একজন মুদি ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, 'পোলাডার নাম ছিল হুমা। হুমা এই কাজ করতো না। কিন্তু ওর বউ আর পুত এই কাজ করতো। শিং দিয়ে হাঁটার লাঠি, বক, সিংহ এসব বানাতো। বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও দিতো দেখতাম। কিন্তু বাজার পইড়া গেলে ওদের অবস্থাও খুব খারাপ হইয়া যায়।'
তাদের অভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাসিরুদ্দীন একদিনের ঘটনার কথা বলেন- 'একদিন রাস্তা দিয়ে হাইট্টা যাইতাসি, হুট কইরা হুমা বিশ টাকা চাইলো আমার কাছে আইসা। আমি দিতে চাইনাই। কারণ আর টাকাও ছিল না তহন পকেটে। কিন্তু হুমা রাস্তায় জোরাজুরি শুরু করলো। পরে দিলাম পকেট থেইকা বাইর কইরা বিশ টাকা। আর নিজে হাইটা চইলা গেলাম নয়াবাজার।'
একবার নাকি হুমার স্ত্রী আশি টাকা দিয়ে একটা জালি কেনে তার দোকান থেকে। সে টাকা আর ফেরত দিতে পারেনি। মৃত্যুর পর নাসিরুদ্দিনও মাফ করে দেন। শেষজীবনটা এমনই কষ্টের ছিল পরিবারটির।
হুমার স্ত্রী বর্তমানে বেঁচে নেই। ছেলের সন্ধান করতে গিয়েও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এক কাঁচানে সব উকুন ঝরঝর করে নামতো
যুদ্ধ একসময় শেষ হলো। সেই সাথে কাঙ্গীসাজের রমরমা ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেতে থাকলো। তাছাড়া বাজারে এসব পণ্যের বিকল্প হয়ে আসলো প্লাস্টিক ও নাইলনের বোতাম- চিরুনি। প্লাস্টিকের চিরুনি আর শিংয়ের চিরুনির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। পশুর শিং দিয়ে তৈরি এ চিরুনিগুলো গোটা ভারতবর্ষের মেয়েদের চাহিদা মেটাতো। সেই সাথে চাহিদা ছিল উকুন মারার চিরুনিরও। তখনকার নারীরা ফেরিওয়ালাদের না-কি বলে দিতেন, 'উকুন মারার চিরুনি নিয়ে আইবা'। একপাশ মোটা, একপাশ চিকন ছিল সে চিরুনিগুলোর। এক কাঁচানে সব উকুন ঝরঝর করে নামতো…
চার সুকিয়া, ছায় সুকিয়া, দাস সুকিয়া
কাঁচা শঙ্খের যেমন দুর্গন্ধ থাকতো তেমনি থাকতো কাঁচা শিংয়েরও। শিংয়ের শক্ত আবরণের ভিতরে ছিল একটা নরম পেটা। ওখান থেকেই গন্ধটা বের হতো। আগুনে শুকোলে ভেতর থেকে পেটা বের হয়ে আসতো। তখন দুর্গন্ধও চলে যেত। প্রথমে হাতকরাত (যাকে বলা হতো আড়ি) দিয়ে শিংয়ের সামনের দিকের পুরু অংশ কাটা হতো। শিংয়ের পুরো অংশ দিয়ে তৈরি হতো বোতাম আর গোঁড়ার ফাঁপানো অংশ দিয়ে তৈরি হতো চিরুনি।
বোতাম তৈরি হতো মোট ছয়টি ধাপে। প্রথমে গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা, এরপর চেঁছে সমান করা-এমন ছয়টি ধাপ। সাইজ অনুযায়ী তিন ধরনের বোতাম হতো-চার সুকিয়া, ছায় সুকিয়া, দাস সুকিয়া।
সারা ভারতবর্ষে বঙ্গদেশের 'ঢাকাই চিরুনি'র কদর ছিল
অপরদিকে চিরুনি তৈরিতে প্রথমে ফাঁপানো অংশটুকু লম্বালম্বিভাবে কেটে চারখন্ড করা হতো। এরপর আগুনে পুড়িয়ে চিমটা দিয়ে ধরে সোজা করে পরে বাটালি দিয়ে চেঁছে করা হতো মসৃণ। এরপর দু'পায়ের মাঝে আটকিয়ে হাতকরাত দিয়ে চিরুনির দাঁত কাটা হতো।
সে চিরুনিও হতো বিভিন্ন নকশার। সমান চিরুনি, মাছের ডিজাইন, নকশি, হাতির মাথা, ময়ূরপঙ্খী প্রভৃতি নকশার চিরুনি। সারা ভারতবর্ষে বঙ্গদেশের 'ঢাকাই চিরুনি'র কদর ছিল। বেদেরাও শিংয়ের চিরুনি গ্রাম-গ্রামান্তরে বিক্রি করতো।
এছাড়া, হাতের দাঁতের তৈরি পাখা, চুড়ি, পাশার ছক, ঘুঁটি, পানপাত্র, পেয়ালা, বাদ্যযন্ত্র, কৌটা, তীর-ধনুক, আতরদানি, তলোয়ার, ছড়ি, ছড়ির বাট, ছড়ি লুকানোর ছোরা ও নানা ধরনের শৌখিন শোপিস বানাতো তারা। বিদেশিরা এলে জন্মদিন, বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো বিভিন্ন ডিজাইনের এই কাঙ্গীসাজ পণ্য।
আছে সমবায় সমিতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসব পণ্যের চাহিদা বাড়তে শুরু করলে বহু হিন্দু পরিবারও যুক্ত হয় এ কাজে। এই হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা কো-অপারেটিভ বিষাণ শিল্প সমিতি'।
সমিতির বর্তমান কোষ্যাধক্ষ হাজী মোহাম্মদ মোখতার হোসেন। ১৫ বছর পর্যন্ত ভাই-বাবার সঙ্গে নিজে বানাতেন এসব। বিভিন্ন মেলায় গিয়ে বিক্রিও করতেন। তিনি জানান, ১৯৪২ সালের মহাদুর্ভিক্ষের সময় এই সমিতি মাত্র দুই পয়সার বিনিময়ে ৩টি আটার রুটি ও ভাজি প্রদান করতো। 'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ের লেখক নাজির হোসেন নিজেও তখন স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করেছেন এই সমিতির সাথে।
প্লাস্টিক আর নাইলনের বোতাম বাজারজাত হওয়ায় এই সমিতির কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন বন্ধ থাকার পর সমিতির নিজস্ব ভবন চৌধুরীবাজারের সুবলদাস রোডে স্থানান্তরিত হয়। বিষাণ সমিতির নামে নির্মিত হয়েছে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট। যার নাম বিষাণ অ্যাপার্টমেন্ট। ভবনের নিচেই একটি রুম বরাদ্দ রাখা হয়েছে সমিতির অফিসরুমের জন্য। সমিতির মানুষদের নিয়েই এই অ্যাপার্টমেন্ট।
এলাকার মানুষ কাঙ্গাই না, বরং শিঙ্গার কাজ হিসেবে চেনে
কাজী মোখতার হোসেনের ভাতিজা মাহমুদুল্লাহ। মাহমুদুল্লাহর দাদা, প্রয়াত আহমদুল্লাহ সরদার ছিলেন ঢাকার মহিষের শিংয়ের স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রাণপুরুষ। মাহমুদুল্লাহ জানান, 'তার বাবা রুস্তম মহাজন এ ব্যবসা করতেন। খ্যারাকপুরে আমাদের দোকান ছিল। ভারতের কলকাতায়, মুর্শিদাবাদ, আসামে আমাদের কারখানা ছিল। তখন তো বাংলা ভাগ হয়নি। সহজেই আসা-যাওয়া করা যেত। ভারত থেকে কাঁচামাল এনে এখানে কাজ করতেন তারা।'
'বিদেশিদের উপহার দিতো, চিংড়ি মাছ ইলিশ মাছ। মাঝে মাঝে বিভিন্ন মিশন থেকে ফরেনাররা আসতো। তারা এসে কুটিরশিল্পগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতো।'
মাহমুদুল্লাহদের ছয় পুরুষের বাড়ি এই আমলিগোলায়। এই কাঙ্গাইয়ের ব্যবসা তার দাদার দাদার আমল থেকে। অর্থাৎ আহমদুল্লাহর দাদার সময় থেকে শুরু। মাহমুদুল্লাহর বাবা-চাচারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একটা সময় পর্যন্ত। এরপর তো বিলুপ্তই হয়ে যায় এ শিল্প।
আমলিগোলার প্রায় প্রতিটা বাড়িই একসময় এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখানকার নিবাসী আবদুল আলীম বড় হয়েছেন এই কাঙ্গাইয়ের কাজ দেখতে দেখতেই। নিজের পরিবার এ ব্যবসায়ে যুক্ত ছিল না ঠিকই। কিন্তু ছোটোবেলায় এলাকার মুরুব্বিদের এই কাজ করতে দেখেছেন। এখন যে বাড়ির নিচে বসে কাজ করছেন, সে বাড়ির মালিকরাও একসময় কাঙ্গাইয়ের ব্যবসাই করতেন। নাম ছিল সাহাবুদ্দীন। ছোটোবেলায় দেখতেন, দুজন কারিগর দিয়ে কিভাবে সাহাবুদ্দীন চিরুনি বানান। নিজেই বানাতেন, নিজেই বিক্রি করতেন। সাহাবুদ্দিনের বাড়ি আমলিগোলার বড় মসজিদের পরে।
তবে স্থানীয়দের কাছে কাঙ্গাই শব্দটি একটু অপরিচিত। কাঙ্গাই শব্দটির চেয়ে 'শিঙ্গার কাজ' বললে তারা ধরতে পারে বেশি। তারা বরং শিঙ্গার কাজ বলেই চেনেন এই শিল্পকে। শিং নিয়ে কাজ হতো বলে শিঙ্গার কাজ নাম হিসেবেই চেনে তারা।
মুদি ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক জানান, 'আমরা তো ছোটোবেলায় দেখেছি এই কাজ। আমরা বলতাম, শিঙ্গার কাজ। হস্তশিল্পের মতো ছিল। দুটো সিংহ মুখোমুখি বানাতে দেখতাম। মসলিন শাড়ির মতোই কদর ছিল তখন। লন্ডন, ইউরোপ থেকে আগত বিদেশীরা এসে এসে বিভিন্ন পুরাকীর্তির মতো এই পণ্যগুলোও নিয়ে যেত।'
তবে মুরুব্বিরা 'কাঙ্গাই'-ই বললেই ধরতে পারেন। হয়তো ঐ সময়টা দেখেছেন বলে শব্দটির সঙ্গে পরিচিত তারা।
অল্পবিস্তর আবার শুরু হচ্ছে এসব পণ্য তৈরি
প্লাস্টিকের আগমনে এই শিল্প হারিয়ে যেতে শুরু করে। পশুর শিং, হাড়, দাঁত দিয়ে পণ্য তৈরিতে যে শ্রম ও সময় দিতে হয়, প্লাস্টিকের পণ্যে তার কিছুই দিতে হয় না। উপরন্তু দামেও কম। দশ টাকায় চিরুনি পাওয়া যায়। একই চিত্র নাইলনের বোতামেও। ফলে প্লাস্টিক ক্রমেই বাজার দখল করে ফেলে আর কাঙ্গাই শিল্প হারাতে বসে।
তবে আভিজাত্যের এবং পরিবেশকে বাঁচাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই পণ্যগুলো ক্ষুদ্র পরিসরে আবার তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া, বিদেশে এসব দ্রব্যের তৈরী পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকায় ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হয়েও উঠছে নতুন করে।
ইতোমধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই শিল্পের বাজার আবার গড়ে উঠছে। সৈয়দপুরে গরু-মহিষের শিং ও হাঁড় থেকে তৈরি করা হচ্ছে উন্নতমানের বোতাম। সেই সাথে তৈরি হচ্ছে চিরুনি ও শোপিস। নজরকাড়া ডিজাইন ও নকশার এসব বোতাম, চিরুনি, শোপিস রপ্তানি হচ্ছে চীন, অস্ট্রেলিয়া, হংকং, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রাঙ্গামাটি ও যশোরেও ব্যক্তিপর্যায়ে পশুর শিং বা হাড়ের চিরুনি বানানো হচ্ছে। সরাসরি কসাইখানা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার আড়ৎ থেকে হাড় ও শিং কিনে নিয়ে পণ্যগুলো তৈরি করছে তারা। আগে এসব পণ্য গণমানুষের ব্যবহারের জন্য তৈরি হতো। এখন তা কেবলই শৌখিন পণ্য হিসেবেই তৈরি হচ্ছে।
বাইরের দেশে এসবের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই উদ্যোগগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।