প্রবাসে উন্নত জীবনের স্বপ্নে যে বিয়ে, কিন্তু এখন তারা স্বামীর দেখাই পাচ্ছেন না!
স্বামীর সঙ্গে প্রবাসে উন্নত জীবন কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন অনেক মেয়ে। কিন্তু অনেকেরই সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। যৌতুক হিসেবে বিপুল অর্থ দিয়েও অনেক সময় হতে হয় শারীরিক নির্যাতনের শিকার। বিদেশে পাড়ি দেওয়া তো দূরের বিষয়, অনেক স্ত্রী বছরের পর বছর তার স্বামীর সঙ্গ থেকেও বঞ্চিত হন। ভারতে প্রতারণার শিকার এমন নারীর সংখ্যা বিপুল। কেবল পাঞ্জাব রাজ্যেই ৩০ হাজার নারী আছেন, যাদের স্বামী আর বিদেশ থেকে ফিরে আসেনি।
পাঞ্জাবের মানুষদের প্রবাস জীবন বেছে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। সেখানের অনেক মেয়েই কোন প্রবাসীকে বিয়ে করে বিদেশে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে। শরনদীপ কৌর তাদের মতই একজন।
২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি একটি শিখ মন্দিরে ইতালি ফেরত হারজিন্দর সিংয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। শরনদীপ কৌর ভেবেছিল তার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। তবে কিছুদিন পরই তাকে দাঁড়াতে হয় এক বেদনাদায়ক বাস্তবতার সামনে।
শ্বশুরবাড়ি থেকে শরনদীপের কাছে চাওয়া হয় ১০ হাজার মার্কিন ডলার। যাতে তার স্বামী কানাডায় গিয়ে সেখানে স্থায়ী হতে পারে। শরনদীপ টাকা দিতে না পারায় তাকে নির্যাতন করা শুরু হয়। পুলিশের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করা হলেও কোন মামলা হয়নি।
বিয়ের আট সপ্তাহ পর শরনদীপের স্বামী ইতালিতে তার কর্মস্থলে ফিরে যায়। গত নয় বছরে আর স্বামী হারজিন্দরের দেখা পাননি শরনদীপ। সম্প্রতি ফাতেহ নঙ্গলের নিজের বাবার বাড়ি থেকে শরনদীপ বলেন, 'দিন, সপ্তাহ, এখন মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে। আমার চোখ এখনো তাঁকে খুঁজে বেড়ায়।'
শরনদীপ একা নন, সরকারি কর্মকর্তাদের মতে এমনই দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন আরো হাজার হাজার নারী। প্রবাসে থাকা স্বামী তাদের পরিত্যাক্ত করেছে। তারপরও স্থানীয় সামাজিক রীতি অনুযায়ী তাদেরকে শ্বশুরবাড়িতেই আটকে রাখা হচ্ছে।
স্বামী ফিরে না আসা এসব নারী পরিস্থিতি পরিবর্তনের অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির শিকার। আর অনেকে সম্পূর্ণ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যৌতুক, মধুচন্দ্রিমার খরচ আর ভিসা প্রদানের নামে তাদেরকে প্রতারিত করা হয়েছে।
ভারতে স্বামী পালিয়ে যাওয়ার নারীরা খুব সামান্য কিছু প্রতিকার পায়। তবে স্বামী বিদেশে থাকলে প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করা আরো কঠিন হয়ে ওঠে। আটজন নারী সম্প্রতি সরকারকে এই বিস্তৃত সমস্যা মোকাবেলায় নীতি প্রণয়নে চাপ দিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন।
এ বিষয়ে গঠিত কমিশনের প্রধান রাকেশ কুমার গার্গ বলেন, পাঞ্জাব প্রদেশেই এমন ভুক্তভোগী নারীর সংখ্যা ৩০ হাজার। কৃষি প্রধান এই রাজ্যে বেকারত্ব এবং মাদকাসক্তও বেশি। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং ভিসা কাউন্সেলিং সংস্থার বিলবোর্ড দেখা যায় পথে পথে। বিদেশ যেতে অনেক সময় তরুণরা বয়স্কদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে। ঋণের বোঝা আর অল্প আয়ে অনেক কৃষকই হতাশ। পাঞ্জাবে অনেক কৃষক আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সাতনাম সিং (৬৫) বলেন, এসব কারণেই সবাই পাঞ্জাব ছেড়ে ডলার আয়ের স্বপ্নে বিদেশে পাড়ি দেয়। আর এসব (শরনদীপের মত) নারীরা কিছু ক্ষেত্রে তাদের সেই স্বপ্নের শিকার।
এই শিক্ষক বলেন, কিছু স্বামী সত্যিই তাদের প্রতিশ্রুতি রেখে স্ত্রীদের প্রবাসে নিয়ে যেত চায়। তবে কিছু সময় অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা বা কঠোর ভিসা নীতির কারণে তারা সেটা করতে পারে না।
অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা আরো খারাপ অবস্থা তুলে ধরেন। ১২ ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ সময় ঘটনা এমন হয় যে, বিদেশ ফেরত কোন ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে পরিবার। তারা যৌতুক দেয়। এরপর পাঞ্জাবী সংস্কৃতি অনুযায়ী জাঁকজমভাবে বিয়ে হয়। মধুচন্দ্রিমার অর্থও দেয় স্ত্রীর পরিবার। এরপর স্বামী বিদেশ যায়। আর নারীরা তার শ্বশুরবাড়িতে থেকে ভিসার অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সে ভিসা আর আসে না। স্ত্রীরা, যারা বেশিরভাগই অশিক্ষিত, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শ্বশুরবাড়িতে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। তাদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলা হয়।
শরনদীপ কৌর পাঁচ মাস পরই স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা অন্ধকার দুর্গের কোন জেলে বসবাসের মত।
কমিশনের প্রধান রাকেশ কুমার জানান, অনেক নারী আরো গুরুতর অভিযোগ তোলেন। অনেক সময় শ্বশুরবাড়ির অন্য কোন সদস্যের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় বলেও জানান তারা।
রাকেশ কুমার বলেন, 'ছেলেরা আসে, মাস্তি করে আর যৌতুকের টাকা নিয়ে চলে যায়। পরে নাগরিকত্বের জন্য বিদেশে গিয়ে আবার বিয়ে করে। যা একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।'
স্বামী পালিয়ে যাওয়া এমন নারী পাঞ্জাবের সব জায়গায় পাওয়া যাবে। কোটলির কুলবিন্দর কৌরও তাদের একজন। ১৯৯৯ সালে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে নয় মাস শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়েছেন তিনি। কানাডার যাওয়ার আগে তার স্বামী কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তারপর থেকে ২৪ বছর তিনি শয্যাশয়ী শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে জীবন কাটাচ্ছেন। কুলবিন্দর বলেন, 'আমি বাড়ির একজন চাকরের মত।'
কিছু নারী এখন তাদের স্বামীর পাসপোর্ট বাতিলের চেষ্টা করছেন। ইংরেজি শিক্ষক রাভনিত খুরাল প্রতি সপ্তাহে ই-মেইল পাঠান কর্তৃপক্ষকে, যাতে তার স্বামী হারপ্রিত সিং ধিমানের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় একটি আইনের অধীনে এভাবে পাসপোর্ট বাতিল করা সম্ভব। যেসব স্বামী স্ত্রীদের রেখে বিদেশে চলে যায়, মামলা হওয়ার পর আদালতে হাজির না হলে তার পাসপোর্ট বাতিল করা হতে পারে।
২০১৫ সালে খুরালদের বিয়ের পর একটি ব্যবসায়ীক ভিসায় কানাডায় চলে যান ধিমানের বাবা-মা। আর ধিমান এদেশ ওদেশ ঘুরে, মাঝে মাঝে স্ত্রী ও আত্মীয়দের দেখতে দেশে এসে এখন কানাডায় বাবা-মায়েরে সঙ্গে থিতু হয়েছে।
খুরাল বলেন, কাগজপত্র ও ভিসার জন্য তিনি শশুরবাড়িকে ৮ হাজার ডলার দিয়েছেন। তবে তার শশুর কেসার সিং সে দাবি অস্বীকার করেন।
ফোনে কেসার সিং বলেন, তাকে (খুরাল) প্রমাণ করতে বলুন। খুরাল জানান, একজন আইনজীবীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদের নোটিশ পেয়েছেন। সাংস্কৃতিক ও আর্থিক কারণে সাধারণত ভারতের মেয়েরা নিজ থেকে বিচ্ছেদের আবেদন করেন না।
খুরাল এখন নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। এরকম পলাতক স্বামীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন না থাকায় আইনি প্রক্রিয়া খুব ধীরগতিতে আগায়।
খুরাল বলেন, 'আমি তাকে শিক্ষা দিতে চাই। যাতে আমার সাথে সে যা করেছে তা সবসময় মনে রাখে।'
শরনদীপের স্বামী ইতালি প্রবাসী হারজিন্দর সিং বলেন, তার বিরুদ্ধেও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও স্বামীকে এখনো পাশে চান শরনদীপ।
তার বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছিল গম ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সাদা শার্ট পরা এক পুরুষ হেঁটে যাচ্ছেন। শরনদীপ বলেন, 'আহা! এটা যদি তিনি (হারজিন্দর) হতেন।' এরপরই তার গলা ধরে আসে। চাপা স্বরে শরনদীপ বলেন, 'আমি জানি সে কখনো ফিরে আসবে না।'