আমেরিকায় দক্ষিণ এশীয় শিক্ষার্থীদের ‘মক ওয়েডিং’! বাংলাদেশিরাও আছে...
৩ মার্চ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। গায়ে চকচকে সোনালি রঙের শেরোয়ানি পরে, নিজের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে, ঢোল ও ড্রামের শব্দে নাচতে নাচতে সাদা ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে এসেছেন বর বিলাল নাসির।
অন্যদিকে একই উদ্দেশ্যে সাদা ঘাগরা, মাথায় ওড়না, হাতে ও কপালে চাকচিক্যময় গহনায় সজ্জিত হয়ে লেহেঙ্গা পরা একদল বান্ধবীর সঙ্গে হাজির হয়েছেন কনে সামার ইকবাল। কয়েকজন হাত দিয়ে কনের মাথার ওপর ধরে রেখেছেন নীল রঙের একটি ছাউনি।
২৩ বছর বয়সী বিলাল ও ২২ বছর বয়সী সামার কিন্তু সেদিনের ঐ আয়োজনে উপস্থিত হওয়ার আগে একে অপরকে চিনতেনও না। এমনকি তারা সত্যি সত্যি বিয়েই করছেন না!
মূলত এ আয়োজনে বিলাল ও সামার বর ও কনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার বিয়ের রীতি উপলব্ধি করতে এটি একটি অনুষ্ঠান যা মক শাদি (নকল বিয়ে) কিংবা মক ওয়েডিং নামে পরিচিত।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সটিরি 'পাকিস্তানি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন' কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সঙ্গে একত্রে এই মক শাদি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এজন্য বিলাল নাসিরকে বর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য মনোনীত করা হয়।
নিজের সংস্কৃতিকে এভাবে উদযাপন করতে দেখার সুযোগ বিলাল আগে কখনোই পাননি। এ নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, "বেশিরভাগ মানুষ তো মাত্র একবার বিয়ে করে। আর আমি একবার বিয়ের অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছি।"
আয়োজনের বিষয়ে বিলাল বলেন, "আমি যখন বামে তাকাই, দেখি আমার দেশি বন্ধুরা আনন্দ করছে, গান উপভোগ করছে। আবার ডানে তাকালে দেখি আমার শ্বেতাঙ্গ বন্ধুরা গানের অর্থ না বুঝলেও একই পরিমাণে আনন্দ করছে। এটা খুবই উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটা মুহূর্ত।"
উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী শিক্ষার্থীরা মক বিয়ের ট্রেন্ডে যুক্ত হচ্ছেন। যেমন, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের মতো বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও মক বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির 'বেঙ্গলি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন' কর্তৃক আয়োজিত এমনই একটি মক বিয়েতে অংশ নিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সুমাইয়াহ মুহিত। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে খুব বেশি পরিমাণে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব আছে বিষয়টি এমনও নয়।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সুমাইয়াহর অংশ নেওয়া মক বিয়েতে প্রায় ৫০০ জন অতিথি উপস্থিত হয়েছিলেন। প্রায় মাসখানেক ধরে চলা নির্বাচন শেষে আয়োজনটির জন্য বর ও কনে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আয়োজিত মক বিয়েতে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নয় এমন বহু শিক্ষার্থীকেও এই বিয়ে উপভোগ করতে দেখা গিয়েছে। এ সম্পর্কে সুমাইয়াহ মুহিত বলেন, "ক্যাম্পাসে সকলেই মক বিয়ে উপলক্ষে বেশ উচ্ছ্বাসিত ছিল।"
সুমাইয়াহ জানান, মক বিয়ের পুরো ইভেন্টজুড়েই ক্লাবটির সদস্যরা অতিথিদের উদ্দেশে বাঙালি বিয়ের রীতিনীতি উল্লেখ করেন। যেমন, বরের জন্য গেইট ধরা কিংবা বিয়ের পরের দিন সিলেটের রীতি অনুসারে কনের নিজের বাড়িতে ফিরে এসে মাছ কাটা ইত্যাদি।
সুমাইয়াহ নিজেও এই মক বিয়েতে বাঙালি ঐতিহ্য বেশ উপভোগ করেছেন। তিনি বলেন, "বিয়েতে অতিথি হিসেবে থাকা অনেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতেন না। এমনকি দেশটি এশিয়া মহাদেশের কি না সেটি সম্পর্কেও অবগত ছিলেন না।"
কয়েক দশক ধরেই নানা আঙ্গিকে মক বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়াও, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ক্লাবের পক্ষ থেকে অনেক সময় পার্টির আয়োজন করা হয় যেখানে শিক্ষার্থীরা বর ও কনে সেজে আসেন।
গত বছরের জুলাইতে কানাডার ক্যালগারি ব্যাঙ্কুয়েট হলে মিউজিকাল গ্রুপ 'বেটটা বয়েজ' মক নাইজেরিয়ান বিয়ের আয়োজন করেছিল। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ক্যাম্পাসগুলোতেও শিক্ষার্থীদের মাঝে এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের রীতি রয়েছে।
যেমন, গত মার্চে লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষার্থীরা অনেকটা বড় আকারে মক বিয়ের আয়োজন করেছিল। ঐ ইভেন্টের ছবি ও ভিডিও টিকটক ও টুইটারে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোর সহকারী অধ্যাপক, পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ ঋজুতা মেহতা মনে করেন, এমন অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে পপ কালচার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ঋজুতা মেহতা বলেন, "বলিউড সিনেমা কিংবা 'ইন্ডিয়ান ম্যাচমেকিং'-এর মতো টেলিভিশন শো এমন বিয়ে আয়োজনে উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। পুরো মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি বিলাসবহুল, অমিতব্যয়ী ও অত্যন্ত উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিয়ের চিত্রায়ন করে থাকে।"
উইলিয়ামস কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অপর্ণা কাপাডিয়া জানান, মক বিয়ে আয়োজন করা ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠনগুলো বাৎসরিক ইভেন্ট আকারে এটি আয়োজনের কথা ভাবছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা এটিকে একটা নতুন ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে তুলছে।
অপর্ণা কাপাডিয়া বলেন, "পশ্চিমা দেশগুলোর ক্যাম্পাসগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা মক বিয়ে উপলক্ষে একত্র হতে পারে এবং একে অপরের সম্পর্কে জানতে পারে। তবে নিজ দেশে এসে অনুরূপ আয়োজন রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোর কারণেই বেশ কঠিন।"
নর্থ আমেরিকায় মক বিয়ে যেমন একদিকে জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমনি এটি নিয়ে ভিন্নমতও আছে।
এ সম্পর্কে এমআইটির 'সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ স্টুডেন্টস'-এর কো-প্রেসিডেন্ট ২০ বছর বয়সী নিইল মালুর বলেন, "প্রথমে এটাকে বেশ অদ্ভুত মনে হয়েছিল। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, মক বিয়ের আয়োজন? ক্যাম্পাসে আমরা কেন একটা মক বিয়ের আয়োজন করব?"
অন্যসব ক্যাম্পাসে মক বিয়ে আয়োজিত হতে থাকলে এমআইটির অ্যাসোসিয়েশনে গত সিমেস্টারে আইডিয়াটা শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচিত হতে থাকে।
এ সম্পর্কে নিইল মালুর বলেন, "আমরা অনেকটা ঠাট্টা হিসেবে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের কাছে ব্যাপারটা আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীসময়ে কমিউনিটির পক্ষ থেকে আমরা ব্যাপক সাড়া পাই। সবাই খুব উচ্ছ্বসিত ছিল। শিক্ষার্থীরা বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ক্যাম্পাসে মক বিয়ের আয়োজন কবে হবে?"
গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ২২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী তাহান মালিক মোট তিনটি মক বিয়েতে অংশ নিয়েছেন। তার মতে, দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় সেজেগুজে এটি নিজ সংস্কৃতিকে উপভোগ করার একটি মোক্ষম সুযোগ।
অন্যদিকে শিক্ষক ঋজুতা মেহতা বলেন, "শিক্ষার্থীরা বহু দূরে থাকায় নিজের বাড়ির প্রতি তাদের একটা আকুল আবেদন থাকে। আর এমন সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সেসবের স্মৃতিচারণ করেন।"
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ২২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী দেভানশি মেহতা প্রায় দুই বছর আগে একটি মক মেহেদী ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, "কলেজে আপনি যখন একটি নতুন পরিবেশে আসবেন তখন আপনি নিজের সঙ্গে মেলে এমন সব জিনিস খুঁজতে থাকবেন। এটা অনেকটা এমন যে, আপনি দেখবেন, শুনবেন এবং আশেপাশের মানুষের মাধ্যমে নিজের বাড়ির মতো উপলব্ধি করবেন।"
তবে ঋজুতা মেহতা উল্লেখ করেন, মক বিয়ের আয়োজন সকল শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করে না। যেসব শিক্ষার্থী আর্থ-সামাজিকভাবে একটু কম সুবিধাপ্রাপ্ত কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার যেসব শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য উত্তর আমেরিকায় যেতে পারেননি তাদের ক্ষেত্রে এমন চর্চা দেখা যায় না।
অন্যদিকে নিইল মালুর জানান, প্রথমবার তিনি যখন মক শাদির কথা শুনেছেন, তখন আয়োজনটি আসলে কী নিয়ে তিনি তা বুঝতেই পারেননি। কেননা জন্মসূত্রে তিনি একজন তামিল এবং হিন্দি কিংবা উর্দু ভাষা তার কাছে পরিচিত নয়।
নিইল মালুর বলেন, "অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। মক বিয়েতে এই অঞ্চলের বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিয়ের রীতিনীতি প্রতিফলিত হয় না।"
এমআইটির অ্যাসোসিয়েশনটি আগামী বছর পর্যন্ত মক বিয়ের আয়োজন স্থগিত করেছে। কারণ হিসেবে নিইল মালুর বলেন, "একটি মক বিয়ে আয়োজনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, সেটি যেন দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ সকল ঐতিহ্যের প্রতি সংবেদনশীল হয়। যার কারণে আমাদের অনেক পরিকল্পনার দরকার।"
মক বিয়েকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে এমআইটির অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করছেন।
মক শাদি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। তবে এটিকে আবার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অপর্ণা কাপাডিয়া।
উইলিয়ামস কলেজের এ শিক্ষক বলেন, "মক বিয়ের এ আচারটিকে আমি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হিসেবে ভাবতে চাইনা। বরং এটা যে আমেরিকান ক্যাম্পাসে দক্ষিণ এশিয়ান শিক্ষার্থীদের কমিউনিটির একটা বিকাশ হিসেবে কাজ করছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চাই।"