সোফিয়া দুলীপ সিং: যুক্তরাজ্যে নারীদের ভোটাধিকারের জন্য লড়েছেন যে ভারতীয় রাজকন্যা
সোফিয়া দুলীপ সিং ছিলেন পাঞ্জাবের শেষ শিখ সম্রাট দুলীপ সিংয়ের মেয়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে যুক্তরাজ্যে গিয়ে থিতু হয় তার পরিবার। সোফিয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানেই। একসময় তিনি জড়িয়ে পড়েন ব্রিটেনের নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলনে। কয়েকবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন এই ভারতীয় রাজকন্যা। একসময় সমান ভোটাধিকারে জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯১০ সালে, নারীদের ভোটাধিকার চেয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এইচ. এইচ. অ্যাসকুইথের সাথে সাক্ষাতের দাবিতে লন্ডনের পার্লামেন্টের দিকে যাত্রা করা ৩০০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের অংশ ছিলেন সোফিয়া।
কিন্তু অ্যাসকুইথ তাদের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে পুলিশ সদস্য এবং পুরুষরা তাদের মারধর করায় বিক্ষোভটি সহিংস হয়ে ওঠে। অনেক বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হন এবং দিনটিকে যুক্তরাজ্যে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ১১৯ জন নারীর মধ্যে সোফিয়াও ছিলেন।
সোফিয়ার জীবনী লিখেছেন অনিতা আনন্দ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'সোফিয়া: প্রিন্সেস, সাফ্রাগেট, রেভল্যুশনারি' থেকেই কেবল এই রাজকন্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। বিশদ আর্কাইভাল গবেষণা, পুলিশ ও গোয়েন্দা নথি এবং তাকে যারা চেনেন তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে বইটি লেখা হয়।
১৮৭৬ সালে জন্ম সোফিয়ার। দুলীপ সিংয়ের প্রথম স্ত্রী বাম্বা মুলারের ঘরে ছিল ছয় সন্তান। সোফিয়া ছিলেন তাদের মধ্যে পঞ্চম।
১৮৪৯ সালে বৃটিশরা শিখ রাজ্য দখল করার পর বালক দুলীপ সিং ভারত থেকে ইংল্যান্ডে নির্বাসিত হন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, অমূল্য কোহিনূর হীরাসহ সব সম্পদ তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি সমর্পন করতে বাধ্য হন।
সোফিয়া বড় হয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাফোকে। শৈশব জীবন খুব একটা মধুর ছিল না। ১৯৮৬ সালে সিংহাসন পুনরুদ্ধারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর দুলীপ সিং নির্বাসিত হন ফ্রান্সে। আর পরিবারকে রেখে যান ঋণে ডুবিয়ে।
কিন্তু রানি ভিক্টোরিয়ার সাথে তাদের পারিবারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। সোফিয়া ছিলেন রানির ধর্মকন্যা। এই সম্পর্কের সুবাদে একটি বাড়ি পান সোফিয়ারা। ব্রিটিশ সরকারের দপ্তর 'ইন্ডিয়া অফিস' থেকে বাৎসরিক ভাতাও পেতেন তারা।
সোফিয়া বড় হওয়ার পর রানির অনুগ্রহে তাকে হ্যাম্পটন কোর্ট প্রাসাদে একটি অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়া হয়। সেখান থেকেই তিনি পরে ভোটের অধিকার আদায়ে প্রতিবাদে অংশ নিতে যেতেন।
জীবদ্দশায় সোফিয়া ভারতে চারবার সফর করেন। সব সফরই ব্রিটিশ কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, দুলীপ সিংয়ের পরিবারের উপস্থিতি ব্রিটিশ বিরোধীদের উসকে দেবে।
১৯০৬-০৭ সালে সোফিয়া লাহোরে (বর্তমান পাকিস্তান) স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং লালা লাজপত রায়ের সাথে দেখা করেন এবং তাদের বক্তৃতা এবং রাজনৈতিক প্রত্যয়ে অনুপ্রাণিত হন।
পরে সোফিয়া যোগ দেন নারীদের ট্যাক্স রেসিসট্যান্স লিগে। তাদের স্লোগান ছিল 'নো ভোট, ভোট ট্যাক্স'। অর্থাৎ ভোটাধিকার না থাকলে ট্যাক্সও দেওয়া হবে না। সোফিয়া এই আন্দোলনের সাথে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯১১ সালে তিনি একবার প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির সামনে ঝাপিয়ে পড়েন। তার হাতে ছিল একটি ব্যানার। তাতে লেখা ছিল 'নারীদের ভোট দিতে দিন'। একই বছর তিনি নিজের আদমশুমারির ফর্ম পূরণ করেননি এবং কর দিতেও অস্বীকার করেন।
১৯১৩ সালের একটি ছবিতে দেখা যায়, রাজকন্যা সোফিয়া হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে 'বিপ্লব' লেখা থাকা একটি বোর্ডের পাশে তিনি দ্য সাফ্রাগেট সংবাদপত্রের কপি বিক্রি করছিলেন। আর এ ছবিটি তাকে 'দ্য ফেস অভ সাফ্রোগেট উইক' বানিয়ে দেয় ।
কর না দেওয়ায় কীভাবে কর্তৃপক্ষ তার গয়নাগুলো জব্দ করে এবং নিলামে তোলে সেসব বর্ণনা সংবাদপত্রে উঠে আসে। সোফিয়াকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল। যেমনটা বাকিদের ক্ষেত্রে করা হয়নি।
দ্য ব্রিটিশ উইম্যান'স সাফ্রেজ ক্যাম্পেইন বইয়ে ইতিহাসবিদ এলিজাবেথ বেকার বলেন, সোফিয়া দুলীপ সিং-এর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন সংগ্রহ করেছিলেন ইন্ডিয়ান অফিসের আমলারা। তার ব্যক্তিগত এবং আর্থিক বিষয়ে স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন।
এই ইতিহাসবিদ সোফিয়াকে 'নারী ভোটাধিকারের জন্য ভারতীয় কর্মী ও শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ কর্মীদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু' বলে অভিহিত করেছেন।
১৯১৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি আইন পাশ করে। যেখানে সম্পত্তি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট যোগ্যতা পূরণের শর্তে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। আর সমান ভোটাধিকার দেওয়া হয় আরো দশ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৮ সালে।
১৯১৯ সালে রাজনৈতিক কর্মী সরোজিনী নাইডু এবং অ্যানি বেসান্টের সাথে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে যান সোফিয়া। নাইডু এবং বেসান্ত ভারতীয় নারীদের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে দেন। তারা রাজ্য সচিবের সামনে ভোটের অধিকারের পক্ষে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। রাজ্য সচিব তাদের কথা শুনেছিলেন কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয়রা সর্বজনীন ভোটাধিকার পেয়েছিল)।
অনিতা আনন্দ তার বইতে লেখেন, সোফিয়ার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিলেন 'নারীর ভোটাধিকার বিরোধী' রাজা পঞ্চম জর্জ। তবে রাজার বেশি কিছু করার ছিল না। কারণ সোফিয়ার আর্থিক বিষয়ের উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল পার্লামেন্টের।
সোফিয়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজেও জড়িত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনে আহত ভারতীয় সৈন্যদের সাহায্য করেছিলেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
অনিতা আনন্দ তার বইতে লেখেন, রাজকুমারী ১৯২৪ সালে পুরো পাঞ্জাব দর্শনের সংকল্প নিয়ে ভারতে আসেন। যখন তিনি তার বোন বাম্বাসহ পুরনো শিখ রাজ্য পাড়ি দিচ্ছিলেন তখন তাদের দেখার জন্য ভিড় জমে যায়। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিলেন, 'আমাদের রাজকুমরীরা এসেছে!'
তারা জালিয়ানওয়ালাতেও ভ্রমণ করেছিলেন। যেখানে ১৯১৯ সালে শত শত ভারতীয়কে ব্রিটিশ সেনারা গুলি করে হত্যা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, তিনি তার বোন ক্যাথরিন এবং আরো তিনজনসহ বাকিংহামশায়ারের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।
সোফিয়ার জীবনের শেষ বছরগুলো অতিবাহিত হয়েছিল তার সহচর এবং গৃহকর্মী জ্যানেট আইভি বওডেনের সাথে। বওডেনের মেয়ে দ্রোভনা ছিলেন সোফিয়ার ধর্মকন্যা।
দ্রোভনা লেখক অনিতাকে জানান, রাজকুমারী প্রায়ই ভোটের গুরুত্ব নিয়ে তার সাথে কথা বলত।
১৯৪৮ সালের ২২ আগস্ট ৭১ বছর বয়সে ঘুমের মধ্যেই সোফিয়া মারা যান।
রাজকুমারীর ইচ্ছা অনুযায়ী, তার ভস্ম বোন বাম্বা লাহোরে নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু কোথায় তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় তা স্পষ্ট নয়।
কিন্তু এখনো তাকে অনুরাগীরা স্মরণ করেন। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে। এই বছরের শুরুর দিকে তার পুরনো বাড়ির সামনে সোফিয়াকে সম্মান জানিয়ে একটি ফলক উন্মোচন করা হয়। তার সম্পর্কে একটি চলচ্চিত্র আগামী বছর মুক্তি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।