কখনো কি ভেবেছেন, পরীক্ষায় পাশ করতে কেন ‘৩৩’ নম্বর লাগে?
আমার ঠিক মনে নেই। হয়তো আমি তখন চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেসময় পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। কিন্তু জানেন, কেন ফেল করেছিলাম?
কারণ পরীক্ষায় আমি ৩২ পেয়েছিলাম, আর পরীক্ষায় পাশের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩৩ শতাংশ নম্বর।
সে পরীক্ষার খাতা দেখাতে আমাকে ও আমার মাকে স্কুলে ডেকে আনেন আমার গণিতের শিক্ষক। সেদিন তিনি আমাকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেছিলেন। পরে ওই শিক্ষক আমাকে সতর্ক করেছিলেন, যদি আমি পরীক্ষায় পাশ না করি তাহলে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারব না।
এ ঘটনার পর আমার মা প্রায় এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আর এদিকে আমি ভাবছিলাম ৩২ আর ৩৩-এর মধ্যে পার্থক্য কী? শিক্ষক চাইলে তো আমাকে এক নম্বর বাড়িয়ে দিতে পারতেন।
লজ্জা, অপমান এবং মা-বাবা, সহপাঠী ও শিক্ষকদের চাপ থেকে মুক্তির জন্য আমি পরিশ্রম করলাম এবং শেষ পরীক্ষায় ৯৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করলাম।
এরপর আর কখনো পরীক্ষায় ফেল করিনি। কিন্তু আমি ভাবা থামাতে পারিনি। '৩৩' এত বিশেষ কেন? পাশ নম্বর কেন ৩৩? পাশ নম্বর ৩২, ৩৪, ৩৫ কেন হলো না? এমনকি ৫০ হলে তো আরও যৌক্তিক হতো বলে ভাবছিলাম।
আপনারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? কেন পাশ করতে ৩৩ শতাংশ নম্বরই প্রয়োজন?
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশ- ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এখনও এ নিয়মেই চলছে।
প্রত্যেক বিষয়ের পেছনে একটি ইতিহাস থাকে। ঠিক তেমনি এর পিছনেও ইতিহাস আছে। আমরা এ নিয়ম উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রেখে যাওয়া নিয়ম! যা আমরা যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছি।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এ উপমহাদেশে প্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৮৫৮ সালে। তখন শিক্ষার্থীদের পাশ করানোর মানদণ্ড নির্ধারণ করা নিয়ে কর্মকর্তারা দ্বিধায় পড়ে যান। তারা চিন্তা করছিলেন, এটি কি ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের মতো হওয়া উচিত, নাকি কম রাখা উচিত?
এই বিভ্রান্তি দূর করতে ব্রিটিশ লর্ডদের পরামর্শ নেওয়া হয়। তখন ব্রিটেনে পাশ নম্বর ছিল ৬৫। তারা ভাবলেন, আমাদের বুদ্ধিমত্তা তাদের অর্ধেক। তাই তারা পাশ নম্বর নির্ধারণ করলেন ৩২.৫ যা ৬৫-এর অর্ধেক।
এভাবেই তারা আমাদের নীচু চোখে দেখত, আর আমরা এখনো এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হতে পারিনি।
পরে ১৮৬১ সালে গণনার সুবিধার্থে পাশ নম্বর ৩২.৫ শতাংশকে একটি পূর্ণসংখ্যা ৩৩-এ রূপ দেওয়া হয়। তারপর থেকে কেউই এই মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি বা পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই মানদণ্ড গ্রহণ করেছিল। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় পরে এসেও ওই পুরোনো পদ্ধতিতেই এখনও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে।
আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলো এখনো ঔপনিবেশিক সময়কার নিয়মেই চলে। সেসময় পরীক্ষাগুলো ছিল মূলত মুখস্থ নির্ভর, এখনও তাই-ই আছে।
ইতোমধ্যে নোবেল পুরস্কার জেতা থেকে শুরু করে অস্কার জেতা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, খেলাধুলায় বিশ্ব জয় সবক্ষেত্রেই এ উপমহাদেশের মানুষ নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছে।
আমাদের মানুষ কখনোই শ্বেতাঙ্গ শাসকদের চেয়ে কম বুদ্ধিমান, কম মেধাবী বা কম দক্ষ ছিল না। বরং আমাদের সাহিত্য, ব্যবসা ও বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এ ঐতিহ্য দেখেই ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ গড়তে আগ্রহী হয়েছিল।
আমরা ব্রিটিশদের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করেছি। কিন্তু ১৫০ বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া সেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে আমরা মানসিকভাবে এখনো বের হতে পারিনি।