উড়ন্ত গাড়ি এখনো কেন উড়ছে না!
উড়োযান দিয়ে চলাচলের নতুন যুগ শুরু হচ্ছে। গত জুনের ১২ তারিখে আলেফ অ্যারোনটিকসের তৈরি করা একটি উড়ন্ত গাড়িকে 'স্পেশাল এয়ারউঅর্দিনেস সার্টিফিকেট' দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)। ফলে গাড়িটি প্রদর্শনী, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য সীমিত পরিসরে উড়তে পারবে।
উন্নত পর্যায়ের অটোমেটেড যাত্রী বা মালামাল পরিবহনকারী উড়ন্ত যানকে এডভান্সড এয়ার মোবিলিটি (এএএম) বলা হয়। তাত্ত্বিকভাবে এসব বাহন দ্রুত, একেবারে ঘরের দুয়ার পর্যন্ত পরিবহন সেবা দিয়ে থাকে। কোনো ভৌত অবকাঠামো কিংবা যানজটের জন্যও এদের চলাচলের গতি কমবে না। উড়ন্ত গাড়ি এখনও শিশু অবস্থায় থাকলেও আলেফের সনদপ্রাপ্তি শূন্যে গাড়ি নিয়ে চলাচলের ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।
কিন্তু দুনিয়াজোড়া উড়ন্ত গাড়ি ঘুরে বেড়ানোর পথে এখনও অনেক বাধা রয়ে গেছে।
আলেফের প্রতিষ্ঠাতারা উড়ন্ত গাড়ির ধারণার ওপর কাজ শুরু করেন ২০১৫ সালে। এরপর ২০১৯ সালে তারা প্রথম পূর্ণ-আকারের উড়ন্ত গাড়ির প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। ওই প্রোটোটাইপের নাম মডেল 'এ'। সড়কে চলাচলের উপযোগী এই যাত্রীবাহী গাড়িটি দুইজন যাত্রী বহন করতে পারবে। রাস্তায় এর ড্রাইভিং রেঞ্জ হবে ২০০ মাইল ও শূন্যে ফ্লাইট রেঞ্জ হবে ১১০ মাইল।
চমৎকার দেখতে আঁটসাঁট গড়নের উড়ন্ত গাড়িটিকে অনেকটা প্রথাগত গাড়ির মতো করেই ডিজাইন করা হয়েছে। শূন্যে উড়াল দেয়ার জন্য গাড়িটির রানওয়ের দরকার হবে না। এমনকি প্রথাগত পার্কিং লটেও গাড়িটি অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে।
আলেফের দাবি, মডেল 'এ'-তে অনন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে গাড়িটি জায়গা থেকেই সটান উড়তে পারে এবং তাৎক্ষণিক নিজেকে বাইপ্লেন মিডফ্লাইটে রূপান্তরিত করতে পারে। ওড়ার সময় এর দরজাগুলো ডানায় পরিণত হয়।
২০১৯ সালে একটি প্রদর্শনীতে এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজন বিনিয়োগকারী মডেল 'এ'-কে আকাশে উড়তে দেখেছেন।
কিন্তু এখনও বেশ অনেকগুলো প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আলেফ অ্যারোনটিকসের প্রধান নির্বাহী জিম দুখোভনি বিবিসিকে বলেন, তাদের এমন কিছু জিনিস প্রয়োজন, পৃথিবীতেই যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন, তাদের অত্যন্ত বিশেষায়িত প্রপেলার মোটর সিস্টেম দরকার।
এই বাহন কত দ্রুত জনসাধারণের জন্য বাজারে আসবে—এবং এগুলোতে চড়া নিরাপদ হবে কি না—তা নির্ভর করছে এদের আকার, ওজন ও দামের ওপর।
ক্যালিফোর্নিয়ার কোম্পানিটি ২০২৫ কিংবা ২০২৬-এর প্রথমভাগ নাগাদ উৎপাদন শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে। যদিও তারা এখনই উড়ন্ত গাড়ির প্রিঅর্ডার নিচ্ছে। বর্তমানে উড়ন্ত গাড়ির মূল্য ৩ লাখ ডলার—তবে আলেফ আশা করছে, খরচ শেষতক ৩৫ হাজার ডলারে নেমে আসবে।
মডেল 'এ' অত্যন্ত হালকা ও কম গতির বাহন—গলফ কার্ট ও ছোট বৈদ্যুতিক বাহনের মতো। এছাড়া মডেল 'এ'-কে অত্যন্ত কঠোর গাইডলাইন মেনে চলতে হবে।
দুখোভনি বলেন, 'এটা স্রেফ শুরু। গাড়ি যখন ঘোড়ার জায়গা নিতে শুরু করে, তখনও এরকম অনেক প্রশ্ন উঠেছিল: নিরাপত্তা নিয়ে, শহরগুলোর কী হবে তা নিয়ে...অনেকেই ঘোড়ার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চেয়েছিল। সবকিছু ঠিকমতো চললে উড়ন্ত গাড়ি আরও বেশি নিরাপদ হবে।'
তবে দিনশেষে মডেল 'এ' কিন্তু গাড়িই। আর এ গাড়ি নিরাপদে আকাশে ওড়াতে হলে একে হালকা এবং বাতাসে ভেসে থাকার মতো করেই বানাতে হবে। এর অর্থ হলো, গাড়িটি সড়কের জন্য কম নিরাপদ হবে। দুখোভনি বলেন, সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে বাহনটি মাটি থেকে শূন্যে ওঠার পর কী হবে, তা এখনও ঠিক জানান নেই।
কারা চালাবে এসব উড়ন্ত গাড়ি? যাত্রীদের কি লাইসেন্স লাগবে?
নগরাঞ্চলে শূন্যে গাড়ি চলাচল মূলত নিয়ন্ত্রণ করবে এয়ার নেভিগেশন সার্ভিস প্রোভাইডার (এএনএসপি)—যুক্তরাষ্ট্রে এ কাজ করে এফএএ। একটি দেশের আকাশে যান চলাচলের ওপর এনএনএসপির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। তারাই নিরাপত্তা পর্যালোচনার পর নতুন ধরনের উড়োযানকে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য শহরগুলোকে এরকম সংস্থার প্রণয়ন করা নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
এফএএর প্রকাশ করা এক ব্লুপ্রিন্ট রিপোর্ট অনুসারে, উড়ন্ত গাড়ি প্রথমে বিদ্যমান আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে প্রচলিত নিয়মকানুন মেনেই চলাচল করবে। রিপোর্টেকিছু শব্দ, দূষণ, নিরাপত্তা, টেকসই, ব্যয়—এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
এছাড়া আরও কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। উড়ন্ত গাড়ি কে চালাবে? যাত্রীদের কি লাইসেন্স লাগবে? নিচু উচ্চতা দিয়ে চলাচল করা এসব উড়ন্ত বাহন কি আশপাশের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে? মাঝ-আকাশে উড়ন্ত গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলে, তার জন্য দায়ী হবে কারা—কোন কর্তৃপক্ষ এই মামলা সামলাবে?
তাছাড়া এসব বাহন যে গতিতে চলবে, তাতে বাহনগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হতে পারে অথবা উড়ন্ত গাড়ি উঁচু ভবনের গায়ে গিয়ে ধাক্কা মারতে পারে। এ কারণে উড়ন্ত গাড়ির পথ ও ওড়ার গতিপথ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঠিক করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এফএএ চায়, 'এয়ার ট্যাক্সি' যেন বিমানবন্দর ও এদের জন্য নির্মিত 'ভার্টিপোর্ট'-এর মধ্যকার নির্দিষ্ট করিডর দিয়ে চলাচল করে। তবে এখন পর্যন্ত উড়ন্ত গাড়ির গতিপথ নির্দিষ্ট করার জন্য কোনো বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।
এরপর আছে আওয়াজের বিষয়। উড়ন্ত গাড়ি যেন অস্বাভাবিক রকমের কম শব্দ উৎপাদন করে, সেরকম করে ডিজাইন করাটা কঠিন হবে। বিশেষ করে বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হলে প্রতি ঘণ্টায় শত শত উড়ন্ত গাড়ি উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। বৈদ্যুতিক প্রপেলার ও অন্যান্য উড়ন্ত গাড়ির প্রপালশন ডিজাইনের উপাদান শব্দদূষণ কমাতে পারে। এসব গাড়ির 'ভার্টিপোর্ট' অবতরণস্থলে কত ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে হবে নগর পরিকল্পনাবিদদের। তবে শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর সরকারি নিয়মনীতি প্রয়োজন।
এফএএ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অন্যান্য শিল্পের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে মিলে নাসা এখন সফটওয়্যার টুল তৈরি করছে। যাতে এএমের জন্য উড়ন্ত গাড়ির আওয়াজের মাত্রা আন্দাজ ও ঠিক করা যায়। উদ্দেশ্য, উৎপাদকদের তুলনামূলক তুলনামূলক কম আওয়াজের বাহন বানাতে সাহায্য করা।
কিন্তু তীব্র যানজটের শহরগুলোতে উড়ন্ত গাড়ি কতটা কাজে আসবে? সত্যি বলতে কী, আকাশপথে উড়ন্ত গাড়ির চলাচল যানজট কমাতে খুব একটা সাহায্যে আসবে না। আদতে আকাশে চলাচলকারী বাহনের সংখ্যা সড়কে চলাচলকারী গাড়ির সংখ্যার ধারেকাছেও হবে না। আর তা যদি হয়ও, তাহলে আকাশেও যানজট লেগে যাবে।
শুরুর দিকে খুব সম্ভব অতিধনীরাই এয়ার ট্যাক্সি ব্যবহার করে আকাশপথে চলাচল করতে পারবে। সেন্ট্রাল লন্ডন অথবা নিউইয়র্ক সিটির মতো অতি জনঘনত্বের শহরগুলোতে এয়ার ট্যাক্সি ব্যবহার করে ধনীরা উপকার পেতে পারে।
তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত গাড়ি ব্যবহার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসতে পারে। বিশেষ করে শহরগুলো যদি কোম্পানিগুলোকে স্বল্প-আয়ের এলাকার মানুষদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রণোদনা দিতে পারে।