সংস্কারের পথে ৪০০ বছরের পুরনো নগরীর ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘ঢাকা গেট’
মোগল আমলে পুরান ঢাকা কত বিশাল ছিল তা বুঝতে হলে আপনাকে 'ঢাকা গেট' সম্পর্কে জানতে হবে। তৎকালীন সময়ে এই ফটক পেরিয়েই সবাইকে ঢাকায় প্রবেশ করতে হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোয়েল চত্বর সংলগ্ন এই ঢাকা গেট বহু বছর ধরে অযত্ন-অবহেলার ফলে এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এক ধ্বংসাবশেষ পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল।
তবে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৪০০ বছর পুরনো তিলোত্তমা নগরী ঢাকার একসময়কার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
দেশের প্রখ্যাত স্থপতি ও স্থাপত্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ এই প্রকল্পের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, মীর জুমলার শাসনামলে এই জায়গাটি থেকেই ঢাকা একটি নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে এবং বুড়িগঙ্গা তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে মীর জুমলা ছিলেন বাংলার সুবেদার (১৬৬০-১৬৬৩)। বাংলাপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, জন্মসূত্রে ইরানী এই সুবেদারের আসল নাম ছিল মীর মুহম্মদ সাঈদ।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, "ঢাকা গেট সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হলো এর গুরত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা।"
তবে ঢাকা গেটে সংস্কারের কাজ এবারই যে প্রথম হচ্ছে তা নয়। অধ্যাপক আহমেদ জানান, ১৮০০ সালের শেষের দিকে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড'য়লি এই একই জায়গায় গেটটি পুনরায় নির্মাণ করেন। এরপরে ষাটের দশকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান রাস্তা প্রশস্ত করেন এবং এটিকে শাহবাগ এভিনিউ নামকরণ করেন। সেই সময় এই গেটের একাংশ সরিয়ে নিয়ে শিশুপার্কের কাছে পুনঃনির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে ঢাকা গেট সংস্কারের পেছনে ১২ জন শিল্পী কাজ করছেন। এর আগে ৩ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি সাইজের ইট দিয়ে গেটটি সংস্কার করা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, মুঘল আমলে এই গেটটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল দেড় ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি সাইজের ইট। এই স্থাপনায় ৬টি পিলার রয়েছে, যার মধ্যে একটি পিলার বাদে বাকিগুলো প্লাস্টার করা হবে।
এই প্রকল্পের নেতৃত্বে থাকা প্রধান কারিগর মোহাম্মদ মোসলেম বলেন, "একটি পিলারে শুধু প্লাস্টার বাদ রাখা হবে যাতে করে লোকে আসল ইটগুলো দেখতে পারে এবং বুঝতে পারে যে মোগল আমলে গেটটা দেখতে কেমন ছিল। আমরা প্রচলিত যেসব উপাদান আছে- চুন, সুরকি ইত্যাদি দিয়ে পিলারের আশেপাশে যে ক্ষতি হয়েছে ওই জায়গাগুলো ঠিক করবো।"
তবে এবার ঢাকা গেট সংস্কারের পর সেখানে আলোর এবং দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও, কর্তৃপক্ষ মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে গ্রানাইট পাথর এনেছিল এই প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু কারিগর মোসলেমের ভাষ্যে, গ্রানাইট পাথর অনেক বেশি শক্ত হওয়ায় তারা এগুলো কাটতে পারবেন না। তাই তারা এটা প্রদর্শনের জন্য রাখবেন এবং এর উপর দর্শনার্থীরা বসতেও পারবেন।
এছাড়াও, মীর জুমলার কামান, যা ওসমানি উদ্যানে রাখা রয়েছে; সেটিও এখানে নিয়ে আসা হবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা।
সংস্কার কাজে কারিগর স্বল্পতা
মোহাম্মদ মোসলেম জানান, তিনি গত মে মাস থেকে ঢাকা গেট সংস্কারের কাজে যুক্ত হয়েছেন। তার ভাষ্যে, বর্তমানে দেশে হাতেগোনা অল্প কিছু কারিগর রয়েছেন যাদের সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ পরিচালনার দক্ষতা রয়েছে।
"নাটোরে কিছু লোক আছে, নওগার পাহাড়পুরে কিছু আছেন; সব মিলিয়ে ৩০ জনের মতো হবে", বলেন মোসলেম।
কারিগর ও শিল্পীদের এসব দক্ষতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে চলে আসে। মোসলেমের পূর্বসূরিরা এই কাজ করতেন এবং তিনিও তার বাবার কাছ থেকে শিখেছেন।
লাল মিয়ার বাবা নাসির উদ্দিন মন্ডল ছিলেন তেমনই একজন কর্মী। ১৮ বছর বয়সে তিনি মুর্শিদাবাদে যান কাজ খুঁজতে এবং সেখানে তিনি স্থাপত্য সংরক্ষণকাজে দক্ষতা অর্জন করেন।
লাল মিয়া নিজে জমিদার বাড়ি, মসজিদ এবং আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা সংস্কারে কাজ করেছেন। তিনি পাবনার বিখ্যাত তাড়াশ ভবন বা তাড়াশ প্যালেস সংস্কারের কাজেও যুক্ত ছিলেন।
তিনি জানান, এই কাজটি সুনিপুণভাবে সবাই করতে পারে না। তার ভাই খুবই দক্ষ কারিগর ছিলেন বিধায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ফোরম্যান হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন।
লাল মিয়া আরও জানান, তিনি তার ১৮ বছর বয়সী ছেলেকেও এই কাজগুলো শেখাচ্ছেন, কারণ তিনি চান তার মৃত্যুর পরেও এই কাজগুলো টিকে থাকুক। তার ছেলে রাজমিস্ত্রী হিসেবেও কাজ করতে পারবে।
একসময় ময়নামতি শালবন বিহার এলাকায় কিছু শিল্পী বসবাস করতেন। কিন্তু লাল মিয়া জানান, তারা এখন আর কাজ করেন না। এদের কেউ কেউ মারা গেছেন এবং বাকিদের কেউ কেউ খুবই বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন।
লাল মিয়া বলেন, "তাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো সংস্কারের কাজ আর শেখেনি, সেজন্যেই এই কারিগরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি এবং তারা হারিয়ে গেছে।"
৬২ বছর বয়সি মোহাম্মদ মোসলেম জানান, তিনি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থাপত্য সংরক্ষণ শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন। তবে একইসঙ্গে তারা বালু-সিমেন্ট ব্যবহার করে কংক্রিটের ভবন নির্মাণকাজেও পারদর্শী।
কিন্তু প্রাচীনকালের ভবন নির্মাণের উপকরণগুলো এখনকার চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল। তাই কারিগররা বালুর পরিবর্তে ইটের পাউডার এবং সিমেন্টের পরিবর্তে চুন ব্যবহার করছেন সংস্কারের কাজে।
অতীতে কারিগররা ঝিনুকের চুন ব্যবহার করতেন। কিন্তু বর্তমানে তা খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে তারা পাথরের চুন ব্যবহার করেন। এছাড়াও, কাঠামোকে আরও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে তারা খয়েরের পানি, সুপারির রস ইত্যাদি ব্যবহার করেন।
মোহাম্মদ মোসলেম বলেন, "কংক্রিটের তৈরি ভবন যদি ১০০ বছর টিকে, তাহলে আমাদের তৈরি ভবন টিকবে ৫০০ বছর।"
এই শিল্পীরা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হয়ে কাজ করেন এবং ঢাকা গেটের পাশেই একটি মসজিদও তারা সংস্কার করেছেন।
তারা জানান, ঢাকা গেটের সংস্কার কাজ শেষ করতে আরও এক মাস লাগবে।
মোসলেম জানান, ১০ বছর আগে রাজধানীর নিমতলী এলাকায় অধ্যাপক আবু সাঈদ এম এহমেদের সঙ্গে তার পরিচত হয়। ওইসময় তারা দুজনেই এশিয়াটিক সোসাইটি প্রাঙ্গণে একটি পুরনো ভবনের কাজ করছিলেন।
এরপর থেকে তারা দুজন নিয়মিতই বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি এবং তার দল অধ্যাপকের সঙ্গে কাজ করেন। তারা সোনারগাঁও জাদুঘরের একটি প্রকল্পে টানা সাত বছর একসঙ্গে কাজ করেছেন বলেও জানান।
তিনি জানান, তার ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়ও শিল্পী এবং তারা এখন খুলনা অঞ্চলে কাজ করছেন। একটি দল কাজ করছে লালবাগ কেল্লা নিয়ে। আরও কয়েকজন কাজ করছেন পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ওপর।
অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদও বলেন, যেহেতু দেশে চুন এবং ইটের গুড়া ব্যবহার করে কাজের পরিমাণ কমে আসছে, তাই এদের মতো শিল্পীরা বাধ্য হয়ে টিকে থাকার জন্য এই পেশা বদলে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। এর ফলে সংস্কার ও সরক্ষণ কাজে দক্ষ হাতেরও অভাব দেখা দিয়েছে।
"পাহাড়পুরের কিছু কারিগর আছে যারা খুবই দক্ষতার সাথে ইট কাটতে পারে। নাটোরে কিছু শিল্পী আছে যারা দেয়ালের ওপর মোটিফ তৈরিতে বেশ পারদর্শী", বলেন অধ্যাপক।
এই শিল্পীদের দলটি কেরানিগঞ্জে দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ সংস্কারেও কাজ করেছেন। এই মসজিদটি ২০২১ ইউনেস্কো এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশন-এ 'অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট' পুরস্কার জিতেছিল।
১৮৬৮ সালে দারোগা আমিনুদ্দিন আহমেদ এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করায় এটি 'দারোগা মসজিদ' নামেও পরিচিত।
এখানেই শেষ নয়; এই শিল্পীরা সোনারগাঁও বড় সরদার বাড়ি এবং পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লায় মুঘল হাম্মামখানা সংস্কারেও কাজ করেছেন।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজে বেশি সময় লাগলেও, এই শিল্পীরা সাধারণ রাজমিস্ত্রীদের মতোই পারিশ্রমিক পান।