ডিমের অর্থনীতি: বাংলাদেশ পারছে না, কিন্তু ভারত-চীন কীভাবে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখছে?
ডিম কিনতে গিয়েছিলেন বিল্লাল হোসেন। দোকানদার প্রতি ডজন ডিমের দাম হাঁকালেন ১৮০ টাকা। দাম শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠলেন বিল্লাল। প্রাথমিক ধাক্কা কাটানোর পর এই লাগামছাড়া দাম নিয়ে বিল্লাল কিছুক্ষণ দোকানির সঙ্গে তর্ক করলেন। কদিন ধরেই ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকার আশপাশে ঘুরছিল। তারপর গত সপ্তাহে হুট করেই সেটা ১৮০ টাকায় ওঠে যায়।
বিল্লাল অবিশ্বাসের সুরে বলেন, 'একটা ডিম ১৫ টাকায় কিনছি, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!'
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, বাংলাদেশ চাহিদার চেয়েও বেশি ডিম উৎপাদন করে, দেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার ওপরে স্থানীয় শিল্পকে সহায়তা দিতে সরকার ডিম আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এই দাবি ও রক্ষণশীল নীতির মধ্যে ডিমের দামের অস্থিতিশীলতায় ভোগান্তি পোহাচ্ছে ক্রেতারা।
ডিম উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতার তত্ত্বের সঙ্গে বাংলাদেশে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই চিত্র দুটি নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে: ১৪০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে প্রতিবেশী ভারত কীভাবে তাদের জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম খাওয়াতে পারছে? আর বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ ডিম রপ্তানিই বা করছে কীভাবে?
একইভাবে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার আরেক দেশ চীনও কীভাবে একই লক্ষ্য অর্জন করল?
এগরেট ডটইন-এর তথ্যানুসারে, ১৫ আগস্ট ভারতে প্রতি পিস ডিমের দাম ছিল ৪-৫ রুপি। ১৫ আগস্ট ৫ রুপি ছিল ৬.৫৯ টাকার সমান।
বিভিন্ন সমবায় থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য সংগ্রহের প্ল্যাটফর্মের সেলিনা ওয়ামুচির তথ্যমতে, চীনে প্রতি কেজি ডিমের দাম ০.২ থেকে ০.৬ ডলারে বিক্রি হচ্ছে (১৫ আগস্টের বিনিময় হার অনুযায়ী, প্রতি কেজি ২১ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে)।
ওজনের ভিত্তিতে প্রতি কেজিতে ১৫ থেকে ২০টি ডিম থাকতে পারে। অর্থাৎ চীনে—প্রতি কেজিতে ২০ পিস ধরে নিয়ে—প্রতি পিস ডিমের দাম ১ টাকা থেকে ৩ টাকা।
আর ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিটি ডিমের দাম ১৫ টাকা।
কী হচ্ছে?
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন ৬৩.৮ মিলিয়ন ডিম উৎপাদন হয়।
কিন্তু বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল-এর (বিপিআইসিসি) হিসাবে, দৈনিক উৎপাদন প্রকৃতপক্ষে ৪০-৪৫ মিলিয়নের কাছাকাছি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ প্রান্তিক পর্যায়ে ১০.৮৫ টাকা এবং শিল্প পর্যায়ে ১০.৩০ টাকা। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাংস ও মাছের দাম বেশি। পাঙাশ বা তেলাপিয়ার মতো কম দামের মাছ—যার দাম ছিল কেজিতে ১২০-১৩০ টাকা—এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা কেজি। এটি ডিমের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে, যা উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না বলে উল্লেখ করছেন উৎপাদনকারীরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে মোট বাণিজ্যিক খামারের (ব্রয়লার ও লেয়ার) সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৮৫ হাজার ২২৭টি। কিন্তু কৃষক সমিতির নেতারা বলছেন, লোকসানের কারণে গত তিন বছরে অন্তত ৪০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনকারীরা বলছেন, দেশে চাহিদা ও সরবরাহের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে।
ব্রিডার অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান বলেন, 'চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্রকৃত চাহিদা কত, তা আমরা জানি না। অনেক সময় দাম বেশি হলে, উৎপাদন বেড়ে যায়। আবার উৎপাদন যখন বেশি হয়, তখন দাম পড়ে যায়—উৎপাদনকারীরা লোকসান দেয়।'
উৎপাদনকারীরা নীতি সহায়তা এবং চাহিদা অনুযায়ী কতটা উৎপাদন প্রয়োজন তার সঠিক প্রাক্কলন দাবি করেন।
নীতি সহায়তা দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন পর পোল্ট্রি নীতিমালা প্রণয়ন করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। নীতিমালাটি এখনও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ডিম খাওয়ার ইতিবৃত্ত
জাতীয় চাহিদা মেটাতে দৈনিক প্রায় ৩৫ মিলিয়ন থেকে ৪০ মিলিয়ন ডিম প্রয়োজন বাংলাদেশের। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে আমদানি নিষেধাজ্ঞা থাকায় এই ডিমের সিংহভাগই সারা দেশের খামার থেকে আসে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ৩.৩৯ কেজি। আর দেশটি মোট ডিম খায় ৫.৪ মিলিয়ন টনের বেশি।
মায়ানমারে মাথাপিছু ডিম খাওয়া হয় ৯.২৫ কেজি, আর মোট ডিম খাওয়া হয় ৫ লাখ টনের বেশি। একজন পাকিস্তানি বছরে গড়ে ৩.৬ কেজি ডিম খায়, আর তারা মোট ডিম খায় প্রায় ৮ লাখ টন।
এই সাইটের তথ্য অনুযায়ী. বাংলাদেশিরা মাথাপিছু ৪.০২ কেজি ডিম খায়। আর আমাদের মোট ডিম খাওয়া পড়ে ৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি।
তবে চীনে বছরে ৩০ মিলিয়নেরও বেশি ডিম খাওয়া হয়। দেশটিতে মাথাপিছু ডিম খাওয়া হয় ২১.৬৬ কেজি। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার পরিমাণ ১৬.১২ কেজি, কানাডায় ১৫.০৯ কেজি ও জাপানে ১৯.৮৬ কেজি।
বেশি ডিম খাওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভারত তাদের স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ ডিম রপ্তানি করে। যেমন, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই দেশটি মালয়েশিয়ায় রেকর্ড ৫০ মিলিয়ন ডিম রপ্তানি করেছে।
ফিড উৎপাদন সক্ষমতায় গুরুত্ব দিতে হবে
১৯৭০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত এদেশে পোল্ট্রি বলতে ছিল পরিবার পর্যায়ে প্রাণী পোষা। গ্রামের মানুষের ঘরোয়া চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয় করত। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই খাত।
দেশে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খাত বিকশিত হতে শুরু করে ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে। বর্তমানে এই খাতের বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তবে পোল্ট্রি শিল্পের কার্যকারিতা, মুনাফা ও প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা নির্ভর করে ফিডের প্রাপ্যতার ওপর। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি সমস্যা আছে। দেশে বর্তমানে ২৬১টি নিবন্ধিত ফিড মিল রয়েছে। এসব মিলে বিনিয়োগ আছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ বছরে ৪.৪৫ মিলিয়ন টন পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন করে। কিন্তু এই খাতের ভালো করতে না পারার অন্যতম কারণ হলো ফিড উৎপাদনের খরচ বেশি হওয়া।
উদাহরণস্বরূপ, ব্রয়লার ফিড প্রতি কেজি ৭২ টাকায় বিক্রি হয়, কিন্তু এর উৎপাদন খরচ ৭২ থেকে ৭৪ টাকা। আর লেয়ার ফিড বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬২ টাকায়, এর উৎপাদন খরচ ৬০-৬২ টাকা।
বিপিআইসিসির তথ্যানুসারে, গত বছর ডিমের উৎপাদন খরচ ছিল ১০.৩১ টাকা, কিন্তু বিক্রি হয়েছে ৮.৭৯ টাকায়—অর্থাৎ লোকসান হয়েছে ১.৫২ টাকা থেকে ২.৩৯ টাকা।
এর জন্য চাহিদা-সরবরাহ বৈষম্য ছাড়াও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিকেও দায়ী করেছে বিপিআইসিসি।
২২.৫ মিলিয়ন টন পশুখাদ্যের চাহিদার বিপরীতে শুধু ৮.৬৪ মিলিয়ন টন অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়, বাকি ৩.৪৫ মিলিয়ন টন আমদানি করা হয়।
বিপিআইসিসির একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, পোল্ট্রি খরচের প্রায় ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করা হয় ফিডে। বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে ব্যবহৃত মোট ফিডের প্রায় ৭৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ ভুট্টা ও সয়া।
চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের তুলনায় তাদের পশুদের জন্য অনেক বেশি পশুখাদ্য উৎপাদন করে। বিপিআইসিসির তথ্য থেকে জানা যায়, ভারত ১১ হাজার ৫০০ ট্রিলিয়ন টন সয়াবিন উৎপাদন করে, অন্যদিকে বাংলাদেশ উৎপাদন করে মাত্র ১৪৫ ট্রিলিয়ন টন। ভারত ও চীন ১১ হাজার ট্রিলিয়ন টন জোয়ার উৎপাদন করে, যেখানে বাংলাদেশ উৎপাদন করে ২৩০ ট্রিলিয়ন টন।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সহসভাপতি মো. আহসানুজ্জামান বলেন, 'হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রে ফিডের দাম একটা বড় সমস্যা। আমাদের ফিডের দাম বেশি, কারণ বেশিরভাগ আইটেমই আমদানি করা হয়। ডলারের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ব্যাংকগুলো এখন এলসি খুলছে না।
'এছাড়া ভারত জিআরবি রাইস ব্রানের মতো অনেক আইটেম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভুট্টার দামও বেড়েছে।'
বাংলাদেশের ডিমের মূল্য ইস্যুতে অন্যান্য বড় দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনা।
বিভিন্ন দেশ হিমায়িত মুরগি বিক্রির পাশাপাশি সেগুলো সংরক্ষণও করে। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা নেই, কারণ এদেশ এখনও জ্যান্ত মুরগি বেচাকেনা করে। বাংলাদেশের কোনো সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই।
আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো খামারের আকার।
বাংলাদেশে ২০০ থেকে ২৫০ মুরগির খামার আছে অনেকগুলো। কিন্তু অন্যান্য দেশে প্রতিটি খামারে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার হাজার মুরগি রাখা হয়।
উৎপাদনকারীরা বলছেন, টেকসই উৎপাদনের জন্য কমবেশি চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে নীতিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের খামারের আকার বাড়াতে হবে।