অর্ধেক বিশ্ব ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে, এ রোগ প্রতিরোধে সর্বজনীন কোনো পদ্ধতি নেই কেন?
সেই ১৭ শতক থেকেই মানুষের মাঝে ডেঙ্গুরোগের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তবে গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের হার হু-হু করে বেড়েছে। ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখের কিছু বেশি। এ সংখ্যা ২০১৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৫২ লাখে।
বিশ্বের ১০০টি দেশে ডেঙ্গুকে এখন এনডেমিক বিবেচনা করা হয়। ভ্রমণ, বাণিজ্য, নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির প্রভাবে মশার বিচরণের পরিসর বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর নতুন নতুন অঞ্চলে ডেঙ্গুরোগের কথা জানা যাচ্ছে।
সুদানে এ বছরের মার্চে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩-এর এপ্রিলে আর্জেন্টিনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বাড়ার কথা জানা গেছে। মারাত্মক গরম ও আর্দ্রতার কারণে পেরুতে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে। দেশটিতে ডেঙ্গু প্রায় নতুন একটি রোগ।
অন্য অনেক মশাবাহিত রোগের তুলনায় ডেঙ্গু অতটা প্রাণঘাতী নয়। তবে কোনো অঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামলাতে বেগ পেতে হয় সেখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে।
ডেঙ্গুর হুমকি ক্রমাগত বাড়ছে। তবে সে সঙ্গে এ রোগের চিকিৎসা নিয়ে নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি ডেঙ্গুর একটি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মশাকে ভাইরাস-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত করার একটি উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ডেঙ্গু নির্মূল করা সম্ভব হবে।
ডেঙ্গু কী?
চিকুনগুনিয়া, জিকা, পীতজ্বর, ও ডেঙ্গু সাধারণত এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। এ মশাগুলো মানুষের আশপাশে বাস করতে পছন্দ করে। মানুষের রক্ত খেয়েই এগুলো টিকে থাকে। এর ফলে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পান করা এডিস মশা সহজেই অন্যদের মাঝে ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিতে পারে।
আক্রান্ত হওয়ার চার থেকে ১০ দিন পর শরীরে প্রথম ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা যায়। তাই শরীরে ডেঙ্গু বাসা বাঁধার কথা না জেনে বাইরে ঘোরাফেরা করা মানুষকে কোনো এডিস মশা কামড় দিলে ওই মশা অন্য সুস্থ মানুষের দেহেও ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করাতে পারে। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার এটি একটি বড় কারণ।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ মানুষের ভ্রমণ। ডেঙ্গুর মতো ভাইরাসগুলো নিয়ে গবেষণা করেন ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক অ্যাশলে সেন্ট জন। তিনি বলেন, 'আমরা এখন আগের চেয়ে সার্বিকভাবে বেশি ভ্রমণ করি।
'একজন ভ্রমণকারী ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকা কোনো স্থানে গেলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে তো থাকেনই। এরপর তিনি এ রোগ সঙ্গে করে নিজের এলাকায় নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করেন।'
ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সংগ্রামের প্রধান কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুরোগের জন্য দায়ী ভাইরাসটির চারটি সেরোটাইপ বা ধরন রয়েছে। এর অর্থ, ডেঙ্গুজ্বর চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাসের মতো আচরণ করে।
চারটি সেরোটাইপের একটিতে কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু এ অ্যান্টিবডি কেবল ওই একটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কাজ করে।
ডেঙ্গুর টিকা তৈরির চ্যালেঞ্জ
ডেঙ্গু ভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য এখনো কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়নি। আর ডেঙ্গু প্রতিরোধে বৈশ্বিকভাবে ব্যবহৃত কোনো পদ্ধতিও নেই।
এর বদলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম গ্রহণ, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান ইত্যাদির পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ (হু)। এছাড়া ডেঙ্গু ছড়ানো রোধে মশার কামড় এড়াতে ভালোমতো শরীর ঢেকে পোশাক পরা, মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো ইত্যাদি চিরায়ত পদ্ধতিগুলোর কথাই বলছে সংস্থাটি।
কিন্তু মশা এড়াতে সবার পক্ষে এ ধরনের ব্যবস্থা সবসময় নেওয়া সম্ভব হয় না। এজন্যই গত কয়েক দশক ধরে ডেঙ্গুর জন্য একটি টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন গবেষকেরা।
সর্বপ্রথম ২০১৫ সালে সানোফি পাস্তুরের তৈরি ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নামক একটি টিকার অনুমোদন দেয় মেক্সিকো। পরপর প্রায় ১১টি দেশ এ টিকার অনুমোদন দেয়। কিন্তু দুই বছর পর ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।
কারণ এ টিকার বড় একটি সীমাবদ্ধতা হলো, যারা আগে কখনো ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হননি, তারা ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া টিকা নেওয়ার পর প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
এরপর সানোফি এর ডেঙ্গুটিকা দেওয়ার গাইডলাইনে পরিবর্তন আনে। সেখানে বলা হয়, এ টিকা কেবল তাদেরকেই দেওয়া যাবে যারা আগে কমপক্ষে একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া বাদে আরও প্রায় পাঁচটি টিকা তৈরি নিয়ে কাজ করার কথা জানা গেছে। জাপানের তাকেদা কোম্পানির টিএকে-০০৩ টিকাটি এক্ষেত্রে আশা দেখাচ্ছে।
একাধিক বারে দেওয়া এ টিকা ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগে যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন (সেরোপজিটিভ) এবং যারা কখনোই ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের মুখে পড়েননি (সেরোনেগেটিভ), উভয় ধরনের মানুষই এ টিকা গ্রহণ করতে পারবেন।
টিকার বাইরে অন্য পদ্ধতি
গত দু্ই দশকে ডেঙ্গু ভাইরাসের টিকা তৈরিতে গবেষকেরা বেশ সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু ভাইরাসটির যে প্রকৃতি, তাতে কেবল একক ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দিয়ে এ রোগের প্রকোপ থামানো যাবে না।
সেন্ট জন বলেন, 'আমরা যখন কোনো টিকাকে ভালো বিবেচনা করি, তখন কেবল সেটার তাৎক্ষণিক প্রতিরোধক্ষমতার কথা ভাবা হয় না। পাশাপাশি কত সময় ধরে এ প্রতিরক্ষা টিকে থাকে, কীভাবে এ প্রতিরক্ষার পরিবর্তন ঘটে — এসবের কথাও মাথায় রাখতে হয়।'
মশবাহিত রোগ প্রতিরোধে টিকার বাইরে বৈশ্বিক পরিবেশে আর যে পদ্ধতিটি সফল হয়েছে, তা হচ্ছে ভাইরাস-প্রতিরোধী মশার জন্মদান।
উলবাকিয়া নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া এডিস মশাকে ডেঙ্গু, পীতজ্বর, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইত্যাদি ভাইরাস ছড়ানো থেকে বাধা দেয়। ওয়ার্ল্ড মাস্কিটো প্রোগ্রাম এ ধরনের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া বহনকারী এডিস মশা উৎপাদন করে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়।
২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর থেকে দেশটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আর খবর পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ায় উলবাকিয়া-পজিটিভ মশা এখন নিজে নিজেই টিকে থাকতে পারে।
এভাবে মশার ভেতরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে মশাবাহিত বিভিন্ন ভাইরাস প্রতিরোধ পদ্ধতিটি ব্য়য়সাশ্রয়ী এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
বিশ্ব বর্তমানে কোভিড মহামারি থেকে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। তাই বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের এখন দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধে টিকা ও অন্যান্য পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য অর্জনে নিয়ত চেষ্টা করে যেতে হবে।
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে টিকা উৎপাদক ও জনস্বাস্থ্যের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদেরকে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে যাতে এসব প্রচেষ্টায় মানুষের আস্থা কখনো হারিয়ে না যায়।