ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ: বাজারে স্যালাইন, সাপোজিটরি ও ব্লাড ব্যাগ সংকট
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় বেশি প্রয়োজন হয় ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন ও সাপোজিটরির। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এখন তাই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্যালাইন ও সাপোজিটরির সংকট দেখা গেছে।
ডেঙ্গু রোগীদের অনেকের প্লাটিলেট প্রয়োজন হচ্ছে। এতে চাহিদা বেড়েছে ডাবল ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগেরও। এলসি খুলতে না পারায় ব্লাড ব্যাগের সংকটের পাশাপাশি দাম বেড়েছে।
সংকট মোকাবেলায় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তিন শিফটে স্যালাইনের প্রোডাকশন চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। পাশাপাশি ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা যেন ব্যবসা করতে না পারে সেজন্য ঢাকা শহরের জন্য ৪০ সদস্যের ৮টি মনিটরিং টিম করেছে ডিজিডিএ।
অর্ডার দেয়ার সাতদিন পর গত সোমবার এক বক্স নাপা সাপোজিটরি পেয়েছিলো ইস্কাটনের 'মা ফার্মেসি'। সেদিনই সব সাপোজিটরি বিক্রি হয়ে যায়। মঙ্গলবার কয়েকজন রোগী সাপোজিটরি কিনতে প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসে ফিরে গেছেন। দোকানটিতে কয়েকদিন ধরে আইভি স্যালাইনও নেই।
'মা ফার্মেসি'র দোকানদার সোহেল মাহমুদ বলেন, "ডেঙ্গু ও অন্যান্য জ্বর বেড়ে যাওয়ায় সাপোজিটরি ও স্যালাইনের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আগে এক বক্স সাপোজিটরি এক সপ্তাহ যেত, এখন একদিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাপোজিটরি, স্যালাইনের রানিং অর্ডার দিয়ে রেখেছি তাও কোম্পানিগুলো দিতে পারছেনা। প্রতিদিন হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, আদ দ্বীন হাসপাতাল থেকে রোগীরা সাপোজিটরি, স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছে।"
মগবাজারে অবস্থিত লাজ ফার্মায় কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া যায়। সাপোজিটরির সাপ্লাই একেবারে কম, আইভি স্যালাইনও চাহিদামতো পাচ্ছেনা দোকানটি।
শাহবাগের ফার্মেসিগুলোতে যোগান কম থাকায় প্রেসক্রিপশন ছাড়া আইভি স্যালাইন ও সাপোজিটরি বিক্রি করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কাজী ফার্মেসির কর্মচারী রাজীব হোসেন।
তবে চাহিদা বাড়লেও স্যালাইন ও সাপোজিটরির দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো ও ফার্মেসি দোকানদারেরা।
এদিকে ব্লাড ব্যাংকগুলোতেও ডাবল এবং ট্রিপল ব্যাগের সংকট দেখা দিচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে রক্তের একটি বড় চাহিদা পূরণ করে রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংক। অথচ প্লাটিলেটের চাহিদা বাড়ায় তারাও ব্লাড ব্যাংক সংকটে পড়েছে।
রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, "আমাদের কাছে এখন কোন ট্রিপল ব্লাড ব্যাগ নেই। আমরা নিজেরাই অন্যান্য ব্লাড ব্যাগ বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করে প্ল্যাটিলেট রাখছি। ট্রিপল ব্যাগ না থাকার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমরা বাজারে ট্রিপল ব্যাগ পাচ্ছি না আর যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম অনেক বেশি।"
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে আগে ডাবল ব্লাড ব্যাগের দাম ছিল ৩৪০-৩৫০ টাকা। এখন তা ৬৫০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ট্রিপল ব্যাগের দাম আগে যেখানে ৪০০-৪০৫ টাকা ছিল, বর্তমানে তা ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলারস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন- এর সভাপতি (ঢাকা জেলা) আতিকুর রহমান বলেন, ব্লাড ব্যাগ আমদানির এলসি খুলতে ডিজিডিএ'র অনুমোদন না পাওয়ায় বাজারে ডাবল ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগের তীব্র সংকট। এতে ডেঙ্গু রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
দ্রুত ব্লাড ব্যাংক আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনুমোদন দেয়ার জন্য ডিজিডিএর প্রতি আহবান জানান তিনি।
পাওয়া যাচ্ছে না ব্লাড ডোনার
জুন থেকেই প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে। এখন ব্লাড ব্যাংক আর রোগীরা ডোনারও খুঁজে পাচ্ছে না।
রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি এক ডেঙ্গু রোগীর জন্য এ পজিটিভ রক্ত পাওয়া যায়নি।
রোগীর আত্মীয় আবুল কাশেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি এ পজিটিভ ব্লাড গ্রুপের চারজন ডোনারের সাথে যোগাযোগ করেছি; সবাই বলছে যে, তারা সম্প্রতিই রক্ত দিয়েছে।"
শীর্ষ প্লাটিলেট সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর একটি কোয়ান্টাম ব্লাড ল্যাবের সংগঠক শামীমা নাসরিন মুন্নি বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে ডোনারের সংকট চলছে।
তিনি বলেন, "প্রতিদিন ২১০ ব্যাগ প্লাটিলেটের চাহিদা রয়েছে কিন্তু আমাদের ডোনার খুঁজে পেতে অসুবিধা হচ্ছে, বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং যাদের এবি-পজিটিভ।"
স্যালাইনের চাহিদা মেটাতে ৩ শিফটে উৎপাদন চালু রেখেছে কোম্পানিগুলো
ডিজিডিএ'র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র নুরুল আলম জানান, "ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় আইভি স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে ২০ গুণ। কোম্পানিগুলো আগে এক শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করতো। আমরা কোম্পানিগুলোকে তিন শিফটে ও ছুটির দিনও স্যালাইন উৎপাদন করতে বলেছি। এখন দিনে এক লাখ ১০ হাজার বোতল স্যালাইন উৎপাদন করছে কোম্পানিগুলো।"
তিনি বলেন, "সাতটি কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় স্যালাইনের সংকট ছিলো। তবে এখন সেই সংকট কমতে শুরু করেছে। অনেক কোম্পানি সাপোজিটরি তৈরি করে তাই সেটির সংকট হওয়ার কথা না, সংকট আছে কিনা আমরা মনিটর করে দেখবো। ব্লাড ব্যাগের সংকট মেটাতে এলসির অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।"
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, "ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য স্যালাইনের প্রোডাকশন বন্ধ রেখে এখন শুধু আইভি স্যালাইন ও কলেরার তৈরি করছি আমরা। তিন শিফটে ৩০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন তৈরি করা হচ্ছে। এটি আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা।"
বাজারে সাপোজটরির চাহিদা বাড়লেও সংকট নেই বলে জানিয়েছেন রাব্বুর রেজা।
স্যালাইনের সংকট মেটাতে ছুটির দিনসহ তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডও। কোম্পানিটি দিনে ২৫ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করছে।
ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল বাশার টিবিএসকে বলেন, "আগস্টের ১৪ দিনে আমরা এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)-কে ১ লাখ ৪০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন সরবরাহ করেছি। এছাড়া দেড় লাখ ব্যাগ লোকাল মার্কেটে দিয়েছি। যেকোন হাসপাতাল থেকে চাহিদা পেলে আমরা স্যালাইন পৌঁছে দিচ্ছি। কোন দোকান এমনকি রোগী স্যালাইন চেয়ে আমাদের ফোন করলে স্যালাইনের ব্যবস্থা করছি।"