বিমানবন্দরে গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে কেন দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয় যাত্রীদের?
বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন? আগেই বলে রাখি, আরামদায়ক জুতা পরে নিতে ভুলবেন না যেন।
মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদির ধাক্কা সামলে ভ্রমণের প্রতি যেই আবার আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, সেইসঙ্গে বিমানবন্দরের মূল গেট, যেখান থেকে বিমানে উঠতে হয়- সেই পর্যন্ত পৌঁছাতে আরও বেশি পথ হেটে পাড়ি দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। হাডসন নিউজ, শ্যানেল, এস্টি লুদা ডিউটি ফ্রি লাউঞ্জ, আন্টি অ্যান'স এবং স্টারবাকস আরও কত কি দোকান পেরিয়ে আসছেন, হাঁটছেন তো হাঁটছেনই, এই পথ যেন আর শেষ হবার নয়!
"আমি এইমাত্র নতুন লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর দিয়ে হেঁটে এলাম, আর এর মাধ্যমে নিজের একটা তত্ত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম", বলছিলেন সাবেক ট্রেজারি সেক্রেটারি ল্যারি সামারস। "টার্মিনাল যত নতুন হয়, ততই এটি যাত্রীদের জন্য কম সুবিধাজনক হয় কারণ হেঁটে যেতে অনেক বেশি সময় লাগে। কিন্তু এমনটা কেন হয়?" জানতে চান তিনি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর থেকেই বিমানবন্দরে হেঁটে যাওয়ার পথ দীর্ঘায়িত হতে হতে এখন বাজে রূপ ধারণ করেছে। এরপরে আবার মহামারির সময়ও বিমানবন্দরে নানা পরিবর্তন এসেছে। এছাড়াও, বিমানের আকার বড় হওয়ায় টেক অফ ও অবতরণের সুরক্ষার জন্য বিমানগুলোকে আরও দূরবর্তী স্থানে রাখা হয়, যার ফলে যাত্রীদের আরও বেশি হাঁটতে হয়।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিমানবন্দরে যে রীতিমতো ট্রেকিং করতে হয় তার পেছনে কারণ হলো- বিমানবন্দরে ব্যবসার জন্য তা সুবিধাজনক; এতে যাত্রীদের পায়ে ফোসকা পড়ছে কিনা তা থোড়াই কেয়ার করে কর্তৃপক্ষ। নিউয়ার্ক, শিকাগো এবং অন্যান্য শহরের বিমানবন্দরের টার্মিনালগুলোতে নতুন নতুন দোকান ও রেস্টুরেন্টকে জায়গা করে দিতে চলন্ত ওয়াকওয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
অ্যাটমসফিয়ার রিসার্চ গ্রুপের হয়ে ভ্রমণ খাতে কাজ করেন হেনরি হার্টেভেলডট। তিনি বলেন, "গেট পর্যন্ত যেতে যেতেই আপনি একদম ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। আপনাকে এসব বিমানবন্দর দিয়েই ভ্রমণ করতে হবে যেগুলো আর্থিক উদ্দেশ্যে ও নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে নকশা করা হয়েছে। যাত্রীদের কথা এখানে সবার শেষে চিন্তা করা হয়।"
একবিংশ শতাব্দীতে ভ্রমণ পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিমানবন্দরই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে নির্মিত এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসে এগুলো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। গেট এক্সটেনশন এবং সাম্প্রতিক সংস্কার কাজের ফলে বিমানবন্দরে হাঁটাপথ আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
নাইন/ইলেভেনের পর বিমানবন্দরে বিদ্যমান টার্মিনালগুলোতে নিরাপত্তা চেকপোস্ট যুক্ত করা হয় এবং টার্মিনালগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের হাটার পথ প্রশস্ত করা হয় বলে জানান ডিজাইন ফার্ম স্ট্যানটেক-এর যুক্তরাষ্ট্রে বিমানবন্দর বিষয়ক কার্যক্রমের প্রধান আলেক্সান্ডার থম।
এদিকে বিমানবন্দরগুলো টার্মিনালে আরও বেশি খুচরা ও ছাড়ের দোকান যুক্ত করেছে, যেহেতু ফ্লাইটে খাবারের বন্দোবস্তো এখন অনেক এয়ারলাইনই বাদ দিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বিমানে উঠে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না, সেগুলো টার্মিনালে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে।
মূলত দুটি উপায়ে বিমানবন্দরের আয় হয়: প্রথমটি হলো 'অ্যারোনটিক্যাল রেভেনিউ'- এই যেমন, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে এবং পার্কিং এর জায়গা ব্যবহারের জন্য এয়ারলাইনগুলো যে চার্জ দিতে হয়। আরেকটি হলো 'নন-অ্যারোনটিক্যাল রেভেনিউ'- যার মধ্যে রয়েছে পার্কিং ও ভাড়ায় চালিত গাড়ি থেকে প্রাপ্ত ফি, রিটেইলারদের ভাড়া দেওয়া এবং বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়।
বর্তমানে বিমানবন্দরগুলো তাদের 'নন-অ্যারোনটিক্যাল রেভেনিউ' বাড়ানোর চেষ্টা করছে। অপারেটররা আগের চেয়ে বেশি দোকান, রেস্টুরেন্ট ও বার যুক্ত করেছে; বিশেষ করে যখন ভ্রমণকারীরা বিমানবন্দরে পৌঁছাতে গণপরিবহন বা রাইড শেয়ারিং ব্যবহার করছে এবং এর ফলে বিমানবন্দরের আয় কমে যাচ্ছে।
"আজকাল তো মানুষ মজা করে বলে যে বর্তমানে বিমানবন্দরই হয়ে উঠেছে শপিংমল এবং এর বাইরে পার্ক করা থাকে বিমানগুলো। আপনি যদি টার্মিনালের নকশার দিকে তাকান, দেখা যাবে বেশিরভাগ জায়গাই বরাদ্দ রয়েছে রিটেইল সার্ভিসের জন্য", বলেন হার্টেভেলডট।
এদিকে অধিক যাত্রী ধারণের জন্য বিমানের আকারও বড় করা হয়েছে এবং এয়ারলাইনগুলো তাদের কিছু ছোট বিমান এই পরিষেবা থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইউনাইটেড এয়ারলাইন তাদের ২০০টি ছোট রিজিওনাল জেট বিমান সরিয়ে নিচ্ছে। এই বিমানগুলো ৫০ জন করে যাত্রী ধারণ করতে পারতো।
আর্কিটেকচারাল ফার্ম গ্রেশাম স্মিথ-এর এভিয়েশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট উইলসন রেফিল্ড বলেন, "বড় আকারের বিমানগুলোর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা দেয়, এয়ারলাইনগুলো তাদের বিমানের ধারণক্ষমতা বাড়াতে পারে। যখন আপনি পাশাপাশি ১০টি বিমান রাখবেন এবং প্রতিটি বিমান হবে ৭৫ ফুট, তখন স্বভাবতই যাত্রীদের অনেকটা পথ হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হবে।"
'ফিটনেস ট্রেইল'
বিমানবন্দরে এতদূর পথ হেঁটে আসা শুধু যে যাত্রীদের জন্যই সমস্যা তা নয়, একইসঙ্গে ক্রু এবং বিমানবন্দরের কর্মীদের জন্যও সময়মতো ফ্লাইট ধরা কঠিন হয়ে পড়ে।
কিছু বিমানবন্দরে ইলেক্ট্রনিক সংকেত চিহ্নও দেওয়া থাকে যে হেঁটে গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে কিংবা টার্মিনাল-লিংকিং মনোরেল আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডালাস ফোর্ট ওর্থ বিমানবন্দরে হাঁটতে হয় সবচেয়ে বেশি। জুতা প্রস্তুতকারক কোম্পানি কুকুর ফুটওয়্যারের একটি গবেষণা বলছে, এই বিমানবন্দরে টার্মিনাল বি-এর একটি প্রবেশপথ থেকে ২.১৬ মাইল হেঁটে টার্মিনাল ই পর্যন্ত পৌঁছাতে হয় (সৌভাগ্যবশত, এই বিমানবন্দরে একটি ট্রেন আছে)।
যুক্তরাষ্ট্রের ফিনিক্স স্কাই হারবার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি 'ফিটনেস ট্রেইল' রয়েছে, যেখানে ভ্রমণকারীরা সেখান থেকেই পাহাড়, পার্ক এবং শহরের অন্যান্য ল্যান্ডমার্ক দেখতে পারেন।
সম্প্রতি চলন্ত ওয়াকওয়ে ছাড়াই কিছু বিমানবন্দর চালু করা হয়েছে। কিন্তু তাতে খুশি নন ভ্রমণকারীরা।
গত বছর অরল্যান্ডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি নতুন টার্মিনাল চালু করা হয়, কিন্তু সেখানেও চলন্ত ওয়াকওয়ে রাখা হয়নি। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসার পর বিমানবন্দরের নেতৃস্থানীয়রা এখন চলন্ত ওয়াকওয়ে বসানোর জন্য একটি ভোটাভুটির আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সলট লেক সিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন একটি টার্মিনাল চালু করা হয়, কিন্তু গেট পর্যন্ত অনেকটা রাস্তা- প্রায় ২০ মিনিটি হাটাপথের জন্য এটি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। বর্তমানে এই বিমানবন্দরে একটি টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে যেখান দিয়ে যাত্রীরা কম সময় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন।