ইঞ্জিন থেকে ঘর্ঘর শব্দ আসছে? কেউ হয়তো গাড়ির মূল্যবান ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরি করে নিয়েছে!
চলতি বছরের জানুয়ারির এক সকালে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সোহেল (ছদ্মনাম) তার প্রাইভেট কারের ইগনিশন চালু করলেন। এসময় গাড়ির নিচ থেকে আসা অস্বাভাবিক এক ঘর্ঘর শব্দ শুনতে পেলেন তিনি।
বিষয়টা অবাক করল সোহেলকে। কারণ মাত্র একদিন আগেই তিনি গাড়িটি মেরামত করিয়ে এনেছেন।
গাড়িতে পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় তিনি অকটেন দিয়ে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করেন। আর এসময়ই ঘর্ঘর শব্দ শুরু হয়। আরো অবাক হলেন সোহেল। কারণ ডিজেল বা অকটেনে চললে নির্ঝঞ্চাট চলার কথা গাড়ি। (গ্যাসের জায়গায় তেল দিয়ে গাড়ি চালালে ক্যাটালিটিক কনভার্টার আরো ভালো কাজ করে। ঘর্ঘর শব্দ হয় না।)।
অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকায় বিষয়টাকে অত পাত্তা দিলেন না সোহেল। পরেরদিন গাড়ি মাঝপথেই থেমে যায়। আবার চালু করতে হয় গাড়িটি। এই সমস্যা চলতেই থাকে।
আর কোন উপায় না পেয়ে গাড়ি আবার মেরামত করাতে নিলেন সোহেল। আলী নামে এক গাড়ি মেকানিক গাড়ি দেখলেন। আর ইঞ্জিনের কিছু যন্ত্রাংশ পাল্টে দিলেন। এরপর গ্যাসেও গাড়ি চালাতে আর সমস্যার সম্মুখিন হননি তিনি।
গাড়ি সারাতে নিয়েই ঘর্ঘর শব্দের কারণ জানতে পারলেন সোহেল। যার কাছে সোহেল মেরামত করতে নিলেন তিনি জানান, গাড়ির ক্যাটালিটিক কনভার্টারের স্টিলের বডিতে পলিশ তবে ঝালাই করার স্পষ্ট চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তার গাড়ির সাইলেন্সার পাইপের মাটি (ক্যাটালিটিক কনভার্টারের ফিল্টার) চুরি হয়ে গেছে।
সোহেল বলেন, আমি বুঝতে পারলাম না কেউ কেন ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরি করবে। কি থাকে এখানে? আমি গুগল ঘেঁটে বুঝলাম, গাড়ির এই নির্দিষ্ট যন্ত্র মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি।
এর আগে তিনটি দোকানে তার গাড়ি মেরামত করিয়েছেন সোহেল। তবে সেখানের কোন মেকানিক চুরির বিষয়টি স্বীকার করেননি।
ক্যাটালিটিক কনভার্টার লাগাতে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করতে হয় সোহেলকে। তিনি বলেন, এই যন্ত্রাংশ ঢাকাতে পাওয়াও যায় না। আমি চট্টগ্রাম থেকে পুরনো একটি ক্যাটালিটিক কনভার্টার লাগিয়েছি।
ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরি হওয়া গাড়ির মালিকদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা নতুন গাড়ি কিনেছেন। কালোবাজারে তুলনামুলকভাবে নতুন ক্যাটালিটিক কনভার্টারের দাম পুরনো গুলোর তুলনায় বেশি।
অভিযোগ কম থাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিষয়টিতে বেশি মনোযোগ দেয়নি। হয় গাড়ির মালিকরা চুরির বিষয়টি ধরতেই পারেন না বা ধরতে পারলেও চোরকে ধরা সম্ভব হয় না।
গাড়ির এই বিশেষ অংশটি চুরির বিষয় প্রথম সংবাদপত্রে আসে ২০২১ সালে। সে বছরের মার্চে সিলেটের এক দোকান মালিকসহ দুইজনকে ধরে পুলিশে দেন এক গাড়ি মালিক। পরের মাসেই ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরির দায়ে দুইজনকে আটক করে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।
ক্যাটালিটিক কনভার্টার কি?
সাধারণত ইঞ্জিন অস্বাভাবিক শব্দ না করা এবং ধোঁয়া বের না হওয়া পর্যন্ত গাড়ির মালিকরা বুঝতেই পারেন না কি হয়েছে।
ক্যাটালিটিক কনভার্টার হল গাড়ির নিচে থাকা একটি ছোট, স্ফীত ধাতব নল যা ইঞ্জিন দ্বারা উত্পাদিত দূষিত গ্যাসকে ফিল্টার করে।
মূলত, এটি একটি সিরামিক ফিল্টার যা হিট শিল্ড এবং একটি শক্তিশালী ইস্পাত বডি দ্বারা আবৃত। ফিল্টারটি প্যালাডিয়াম, প্ল্যাটিনাম এবং রোডিয়ামসহ মূল্যবান ধাতু দ্বারা গঠিত।
যখনই একজন চালক ইঞ্জিন চালু করেন, তখন ইঞ্জিনের প্রতিটি সিলিন্ডারে হাজার হাজার দাহ গাড়িকে নড়াচড়ার শক্তি জোগায়। একই সময়ে, সেগুলো ধোঁয়া তৈরি করে যার জন্য একটি প্রস্থান পথ প্রয়োজন। ক্যাটালিটিক কনভার্টার ধোঁয়া গ্রহণ করে এবং তাদের পানি, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও অক্সিজেনের মতো গ্যাসে রূপান্তরিত করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ এহসান বলেন, ক্যাটালিটিক কনভার্টারে দুই ধরনের ক্যাটালিস্ট থাকে- রিডাকশন ও অক্সিডেশন। রিডাকশন ক্যাটালিস্ট ছাড়া গাড়ি চালাতে বড় কোনো সমস্যা হয় না। তখন কেবল ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে। কিন্তু অক্সিডেশন ক্যাটালিস্ট সরিয়ে নেওয়া হলে বা চুরি হলে তখন চালক সমস্যার সম্মুখিন হবেন।
ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরি হয় কেন?
বাংলাদেশের সমস্ত অটোমোবাইল মেকানিক এবং যন্ত্রাংশ বিক্রেতা ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরির বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই সাংবাদিকদের এই সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য দিতে অনুৎসাহী ।
তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলেন যন্ত্রাংশ আমদানিকারক তানভির। মোবাইলে কথোপকথনে তিনি ভেতরের কিছু খবর জানালেন। বাংলাদেশ সাধারণত জাপান থেকে রিকন্ডিশন গাড়ি কেনে এবং যন্ত্রাংশ আমদানি করে দুবাই থেকে। দুবাইও জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে থেকে পুরনো গাড়ি কেনে। এরপর সেখানের যন্ত্রাংশগুলো তারা বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে।
তানভির বলেন, দুবাই সাধারণত ক্যাটালিটিক কনভার্টার রপ্তানি করে না। কারণ কালোবাজারে এর চাহিদা বেশি। যেমন আমাকে নতুন ক্যাটালিটিক কনভার্টার আনতে হলে খরচ করতে হয় ৭০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে পণ্যের মানের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে চুরি করা ক্যাটালিটিক কনভার্টার পাওয়া যায় ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়।
তানভির বলেন, বাংলাদেশে ক্যাটালিটিক কনভার্টার চুরি বাড়তে থাকলেও সেগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। কারণ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সেগুলো রপ্তানি করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারত ও আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশে এগুলো রপ্তানি হয়।
সাইলেইন্সার পাইপের মূল্যবান মাটি পুনঃস্থাপন করা যায়? হ্যাঁ সম্ভব। তবে সেগুলো দুষ্প্রাপ্য বললেই চলে। কিছু মার্কিন এবং ইউরোপীয় ওয়েবসাইটের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স (১ আউন্স সমান ২৮.৩৫ গ্রাম) রোডিয়ামের দাম ৫,০০০ ডলার আর প্রতি আউন্স প্যালাডিয়াম, প্ল্যাটিনামের দাম ১,০০০ ডলারের কাছাকাছি।
প্রতিটি ক্যাটালিটিক কনভার্টারে রোডিয়াম থাকে ১ থেকে ২ গ্রাম। প্লাটিনাম থাকে ৩ থেকে ৭ গ্রাম আর প্যালাডিয়াম থাকে ২ থেকে ৭ গ্রাম। এ থেকেই ক্যাটালিটিক কনভার্টার কতটা ব্যয়বহুল তা বোঝা যায়।
সোহেলের মতো অনেক গাড়ি মালিক চুরি হওয়া ক্যাটালিটিক কনভার্টারের চোরাচালান র্যাকেট সম্পর্কে অবগত নন। গাড়ি মেরামতের সময় মেকানিকদের উপর নজর রাখা ছাড়া আর তেমন কিছু করারও থাকে না।