ডিমের দাম কি আর কখনো ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ফিরবে?
২০২২ সালে প্রতি ডজন ডিমের দাম মোটামুটি ১২৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে ছিল। এক পর্যায়ে অবশ্য তা ১৫৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। ২০২৩ সালের আগস্টের আগ পর্যন্ত প্রতি ডজন ডিমের গড় দাম ছিল ১৩০-১৪০ টাকা। তবে আগস্টেই তা বেড়ে ১৭০ পর্যন্ত পৌঁছায়।
সারাদেশে ডিমের এমন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ধীরে ধীরে দাম কমতে থাকে, তবে খুচরা বাজারে এখন তা ১৫০-১৫৫ টাকায় এসে থেমেছে। অর্থাৎ গত বছরের ডিমের দামের (১৫৫ টাকা) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ২০২৩ সালে 'স্বাভাবিক' হয়ে উঠেছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রতি ডিম ১২ টাকা (ডজন ১৪৪ টাকা) নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। খুচরা বাজারে এখনো প্রতি ডিম গড়ে ১২.৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সম্প্রতি স্থানীয় খামারিদের ক্ষোভের মধ্যেই সরকার ডিম আমদানি অনুমোদন দিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশে দৈনিক ৪ কোটি ডিমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ৩.৭৫ কোটি। আশা করা হচ্ছে, আমাদানি করা ডিমের মাধ্যমে ৪০ দিনের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানো যাবে।
খামারি এবং বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি আপাতত হয়তো আকাশছোঁয়া দাম নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরিণামে সংকট দীর্ঘ হবে।
তবে সরকার রাতারাতি ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাম কমাতে বারবার সতর্ক করার পর সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কয়েকজন খামারি ও ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তাদের দাবি, ফিড ও মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কর্পোরেটদের কারণে দাম বাড়ছে। তারা বলছেন, সরকার প্রকৃত সমাধান যেখানে, সেখানে পদক্ষেপ না নিয়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা শেষ পর্যন্ত প্রান্তিত খামারিদের ক্ষতি করবে।
সংশ্লিষ্ট একজন টিবিএসকে বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় (১২৫-১৩০ টাকা) দাম ফেরানো সম্ভব। যদি ফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করা কর্পোরেশনগুলো তাদের পণ্যের দাম কমায়। কারণ এক বছরের মধ্যে ফিড ও মুরগির দাম প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধির কারণে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।
ময়মনসিংহের ভালুকার কৃষক রশিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, মুরগির খাচির দাম এখন ২৭০ টাকা, যা আগে ১২৫ টাকা ছিল। প্রতি পিস মুরগির বাচ্চা এক বছর আগেও ২৫ টাকা ছিল, এখন তা ৫৫-৬০ টাকা।
তিনি বলেন, আমি আজ ঢাকার মহাজনের কাছে প্রতি পিস ডিম ১১.১০ টাকায় বিক্রি করেছি। আপনি যদি আমাকে এখন এই হারের নিচে বিক্রি করতে বলেন, আমি এই খাতে টিকতে পারব না, আমরা কৃষকরা বাঁচব না। এক বছর আগে অনেকেই ব্যবসা ছেড়েছে, অনেকে দেউলিয়া হয়ে বিদেশে চলে গেছে, অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পালিয়েছে।
এক বছর আগে রশিদুলের ৩,০০০ মুরগি ছিল, এখন তার আছে আছে ১,০০০ মুরগি।
রশিদুল বলেন, ১,০০০ মুরগির জন্য প্রতিদিন আড়াই বস্তা খাদ্য প্রয়োজন হয়। প্রতি বস্তা ফিডের দাম ছিল ১,৭০০ টাকা, এখন তা ২,৫০০ এর বেশি। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমরা কীভাবে টিকে থাকব?
আরেক কৃষক ফজলুল হক বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে দাম কমাতে বলা হলে আমাকে লোকসান গুণতে করব। আগের দামে ফিরে যেতে, ফিডের খরচ কমাতে হবে।
কীভাবে স্বাভাবিক দামে ফেরা সম্ভব?
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, 'হ্যাঁ, আগের দামে ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু আইনে যেখানে বলা আছে কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলো ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করতে পারবে সেখানে এখন মুরগির বাচ্চায় ১০০-২০০ শতাংশ, ফিডে ৫০ শতাংশ এবং মুরগি ও ডিমে ৬০ শতাংশ মুনাফা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করছে না। যদি ফিড এবং ছানার দাম না কমানো হয়, এবং তারা তাদের লাভের মার্জিন না কমায়, তাহলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কর্পোরেটরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে
টিবিএসে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এর মধ্যে ব্রয়লার ফিডের দাম ৫১ শতাংশ এবং লেয়ার (ডিম দেওয়া মুরগি) ফিডের দাম ৫৮.৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে গড় উৎপাদন খরচ ১২০-১৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুমন হাওলাদার বলেন, বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য কাজী ফার্মস, প্যারাগনস, নুরিশ এবং আফতাবের মতো কোম্পানিকে উৎপাদিত মুরগির ছানা এবং ফিডের দাম কমাতে হবে।
তিনি বলেন, সমস্যা শুরু হয় মহামারির পর। কোভিডের আগে কোম্পানিগুলো ডিম এবং মুরগি উৎপাদন করেনি। তারা কেবল ফিড এবং মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করত। কিন্তু কোভিডের পরে তারা ১৫ শতাংশ ডিম এবং মুরগি উৎপাদন শুরু করে। তবে তারা শতভাগ ছানা ও ফিড উৎপাদন করায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
সুমন বলেন, সমাধানের জন্য, কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই ১৫ শতাংশ ডিম এবং মুরগির উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। মুরগি এবং ফিডের দাম যুক্তিসঙ্গতভাবে কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিন এবং আমি আবার প্রতি পিস ১০.৫০ টাকায় বিক্রি করব। এবং খরচ কমানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে সব জায়গায় দাম কমেছে। বাংলাদেশের বাজারে কেন নয়?
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ টিবিএসকে সম্প্রতি জানান, প্রকৃত চাহিদা নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন পরিকল্পনা তৈরি করা অপরিহার্য। ফিডের দাম কমাতে সরকারকে ভারত থেকে শূন্য শুল্কে কিছু বিকল্প ফিড উপাদান আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সুমন হাওলাদার বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়ার বিষয়টি সমাধান না করে ডিম আমদানি প্রান্তিক খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্পোরেটদের জবাবদিহি না করে সরকার খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। দাম বৃদ্ধির সাথে প্রান্তিক কৃষকদের লাভের মার্জিনের খুব বেশি সম্পর্ক নেই। আমদানি একটি অস্থায়ী সমাধান, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি এই শিল্পকে ধ্বংস করবে।