‘আজকে আমি যা, তার অনেকটাই বেগমের জন্য!’ বেগম পত্রিকা কি এখনও আছে?
'এক সন্ধ্যায় আব্বা অনেকগুলো ম্যাগাজিন পত্রিকা বের করলেন, বাছাই করে রাখার জন্য। সবগুলো বাছাই হওয়ার পর 'বেগম' এর বান্ডেলটা খুললেন, তারপর দেখছি একে একে পাতা উল্টে কি যেন খুঁজছেন! আমরা দুইভাই দুই পাশে বসা কিছুই বুঝতে পারছিনা। একটা সময় হঠাৎ আব্বা বলছেন এই দেখতো চিনতে পারস কিনা??? আমিতো অবাক!! আরে আব্বা আম্মার বিয়ের ছবি!!!'
কথাগুলো ২০২২ সালের একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া। 'বেগম পত্রিকা' লিখে খুঁজলেই সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটিতে অনেকের অনেক স্মৃতিচারণ চোখে পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার কিছুদিন আগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৎকালীন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরউদ্দিন। আর প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। তার সঙ্গেই কাজ করতেন নাসিরউদ্দিনের একমাত্র কন্যা নূরজাহান বেগম। কিছুদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর কবি সুফিয়া কামাল নিজের ব্যস্ততার কারণে কাজ ছেড়ে দেন। আর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নূরজাহান বেগম। সেই থেকে ২০১৬ সাল অবধি নূরজাহান বেগমের হাতেই বেগম-এর বেড়ে ওঠা।
বাংলাদেশের নারীদের ছবি তোলা, লেখালেখি, সম্পাদনা, সাংবাদিকতা — এ সবকিছুর যাত্রা শুরু হয়েছিল বেগম পত্রিকার হাত ধরে। নারীদের চিন্তাচেতনা, জানার আগ্রহ, সময় কাটানো, সাংসারিক পরামর্শ, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নিয়ে সচেতনতা — এ সবকিছু বেগমপাঠের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। গোটা তিনটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এ বেগমকে ঘিরে। সে প্রজন্মের অনেকেই আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আবার অনেকেই আছেন, যারা এখনও বেগমকে মনে ধারণ করে রেখেছেন। এখনও অনেকের কাছেই যত্নের সাথে সংরক্ষিত আছে এ পত্রিকার কোনো কোনো সংখ্যা।
'আজকে আমি যা, তার অনেকটাই বেগম-এর জন্য'
মুজতবা সৌদ ফেসবুকে লিখেছেন: 'সম্ভবত জন্মের পর থেকেই এর সঙ্গে আমার পরিচয়। বাবা একটা দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে আরও যে দুটি পত্রিকা ঘরে রাখতেন তার একটি 'চিত্রালী' অন্যটি 'বেগম'। বাবা এ দুটো পত্রিকা ভ্রু কুঁচকে পড়লেও, মা'র পেটের ভাত হজম হতো না এই দুই পত্রিকা ব্যাতিরেকে।'
মুজতবার মায়ের মতোই তখনকার মায়েদের কাছে বেগম মানেই ছিল এক টুকরো স্বস্তি, আনন্দ আর জ্ঞান আহরণের আকর। শুধু মায়েদের নয়, মেয়ে–বৃদ্ধ সকল বাঙালি নারীর মনের জানালা ও কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল এ পত্রিকা। ঘর-সংসার সামলানো থেকে শুরু করে নারী মুক্তি, নারী জাগরণ, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা — এ সবকিছুই তুলে ধরা হতো বেগম পত্রিকায়। কুসংস্কার বিলোপের কথা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ নারীদের লেখনীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছিল বেগম-এ।
আর এসব লেখা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নাড়া দিত আফরোজা নাজনিন রেখাকে। রেখা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। পোশাক বা সাজগোজ নিয়ে এত মাথাব্যথা নেই অন্যদের মতো। বেগম হাতে আসামাত্রই চলে যেতেন মলাট উলটে প্রথম পাতায়, নূরজাহান বেগমের সম্পাদকীয়তে। অন্যরা যেখানে বুঁদ হয়ে গল্প উপন্যাসের পাতায় ডুবে যেত, সেখানে রেখার চোখ আটকাত সম্পাদকীয় পাতায়। চলমান বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা, মতামতগুলোই তাকে টানত সবসময়। ড. আনোয়ারা হকের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর লেখাগুলো পড়তে ভালোবাসতেন তিনি সবচেয়ে বেশি। এসব লেখায় তুলে ধরা হতো সমসাময়িক নারী সমাজের অবস্থা। সে সঙ্গে নারীসমাজকে পশ্চাৎপদ অবস্থা, অধস্তন অবস্থা, সমস্যা ও অধিকার বিষয়ে সচেতন করা হতো। পুরুষের বাধা ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হতো।
সে লেখাগুলো পড়ে পড়েই রেখার মনে তীব্র ইচ্ছে জাগে স্বাবলম্বী হওয়ার। সংসার, পরিবারের পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছেন তিনি বেগম থেকেই। বর্তমানে রেখা সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত আছেন। রেখা মনে করেন, আজ তিনি যা হয়েছেন, সেখানে বেগম পত্রিকার অবদান অনেকখানি।
সাংসারিক জীবনের নানা বিষয় জানতে পেরেছেন বেগম পড়েই
নারীদের জন্য সচিত্র এ পত্রিকাটির পথচলা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে। প্রায় পঁচিশ–ত্রিশ পৃষ্ঠার এ পত্রিকাটির ভেতরে থাকত বিভিন্ন বিভাগ। এতে যেমন সম্পাদকীয় ছিল, প্রবন্ধ ছিল, কবিতা, জীবনী, গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস ছিল, তেমনি থাকত সচিত্র মহিলাজগতের খবর, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য, প্রশ্ন ও উত্তর, ডাক্তার বলেন, রম্য রচনা, সেলাই, রান্না, ভ্রমণকাহিনী, শিশুমঙ্গল, শিশুদের পাতা, রান্না বান্না, স্বাস্থ্য সুন্দর হালচাল, চিঠিপত্র, পুস্তক সমালোচনা, ছায়াছবির কথা, সংক্ষিপ্ত সংবাদের মতো বৈচিত্র্যময় সব বিভাগ। যেন নারী তার বহির্জগতের পাশাপাশি মনের খোরাক, সাংসারিক জীবনের নানা বিষয়ে জানার সুযোগ পান।
এই যেমন হোসনে আরা বেগমের কথাই ধরা যাক। বয়স সত্তরের কোঠায়। বেগম পত্রিকার সঙ্গে তার পরিচয় তেরো বছর বয়সে নানির মাধ্যমে। কোনো সপ্তাহ বাদ গেলেই নানির কাছে কান্নাকাটি করতেন এনে দেওয়ার জন্য। হাতে পাওয়া মাত্রই বসে যেতেন পত্রিকা নিয়ে। সে পড়া আজও চলছে। সাংসারিক জীবনের নানা বিষয় জানতে পেরেছেন তিনি বেগম পড়েই। হোসনে আরা জানান, 'শিশুবিষয়ক লেখাগুলো পড়ে জেনেছি কেমন করে বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়, সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হয়।'
তবে তার বেশি ভালো লাগত গল্প ও উপন্যাসগুলো পড়তে। এখনো কিছু কিছু গল্প মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝে। আবার তার ছেলে মীর শামসুল আলম বাবুর প্রিয় ছিল সিনেমাকেন্দ্রিক বিভিন্ন খবরে ভরপুর চলচ্চিত্র পাতা। বেগম-এর ঈদসংখ্যাগুলো বাবুই এখন তাকে এনে দেন মাঝে মধ্যে।
'অনেক আনাড়ি লেখা থাকত'
কার আগে কে পড়বে সে নিয়ে চলত ফাহমিদা বারীর বোনেদের মাঝে কাড়াকাড়ি। ফাহমিদা জানান, বাসায় বেগম এলেই শুরু হতো কাড়াকাড়ি। যে-ই নিত, একেবারে শেষ করে এরপর ফেরত দিত। তিনি জানান, সেলাই, নকশা ও রান্না সম্পর্কে নিয়মিত লেখা হতো বেগম-এর পাতায়। 'আমার বোনেরা সেলাই-নকশার পাতাগুলো কেটে কেটে রেখে দিত। পরে নিজেরা সেলাই কর ওগুলো দেখে দেখে।'
ফাহমিদা নিজে পছন্দ করতেন গল্প ও উপন্যাস পড়তে। ধারাবাহিক গল্পগুলো যেন ছিল জীবনের প্রতিচ্ছবি। 'তবে কিছু গল্প হতো একদম আনাড়ি, অপরিপক্ক হাতের। সাধারণ পাঠকেরাই লিখতেন।', স্মৃতিচারণ করেন ফাহমিদা।
বেগম পত্রিকায় প্রায় ১৫–১৬ বছর সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছে হোমায়রা খাতুন হুমা। তিনি বলেন, 'বেগম-এর মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম।'
সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, শামস রশীদ, জোবেদা খানম, ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরী, রাজিয়া মাহবুব, জাহানারা আরজু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, রিজিয়া রহমান, মকবুলা মনজুর, জুবাইদা গুলশান আরা, ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, সাইদা খানম, মালিকা আল রাজী, ফোরকান বেগম, দিল মনোয়ারা মনুর মতো বিখ্যাত লেখিকারা লিখতেন বেগমের পাতায়। হুমা বলেন, 'আজ যারা বড় লেখিকা, তাদের বেশিরভাগই তো উঠে এসেছেন এই বেগম-এর হাত ধরে। আমি নিজে সাংবাদিকতা শিখেছি আপার (নূরজাহান বেগম) হাত ধরে।'
'হুমা, লেখা পাঠাও'
১৯৪৮ সাল, ভারত কেবল স্বাধীন হয়েছে। ওরকম একটি সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ছবি তোলাও ছিল একরকম নিষিদ্ধ। আর সেখানে সাপ্তাহিক বেগম-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ছবি। সে বছরই কলকাতায় বেগমের প্রথম ঈদসংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছিল ৬২ জন নারী লেখকের লেখা, যা তৎকালীন অবরুদ্ধ সমাজব্যবস্থায় ছিল দুর্লভ ও বিস্ময়কর। সে লেখিকাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজিয়া খাতুন, শামসুন্নাহার মাহমুদ, প্রতিভা গাঙ্গুলী প্রমুখ। তখন থেকেই ঈদসংখ্যা নিয়মিত বেরোতো। আর সঙ্গে থাকত সকল লেখিকাদের ছবি। এ ধারা এখনো চলমান, এটি বেগম-এর ঐতিহ্যেরই একটি অংশ।
ঈদসংখ্যা নিয়ে হুমা বলেন, "রমজানের প্রথম থেকেই আপা লেখিকাদের ফোন দিতেন লেখা পাঠানোর জন্য। সবচেয়ে কষ্টের কি জানো? মারা যাবার এক সপ্তাহ আগেও তিনি ফোন দিয়েছিলেন আমাকে: 'হুমা, লেখা পাঠাও। তোমার বোনকেও বলো লেখা পাঠাতে'।"
'যে বলতে পারবে এটি কার উক্তি, তাকেই করব আমার পত্রমিতা'
সেকালের অন্য ম্যাগাজিনগুলোর মতো বেগম পত্রিকায় একটি অংশ বরাদ্দ ছিল পত্রমিতালীর জন্য। সে সময় ছিল না টিভি, মোবাইল ফোন কিংবা প্রযুক্তির ছোঁয়া। ফলে অদেখা অজানার প্রতি আগ্রহ থেকেই মানুষ বন্ধুত্বের সন্ধান করত। আর ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকের তরুণ-তরুণীদের মাঝে পত্রমিতালী ছিল অজানা-অচেনা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মাধ্যম। বাংলাদেশের প্রায় সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই বন্ধুত্বের প্রত্যাশায় নাম ও ঠিকানা দিয়ে ছোট ছোট বিজ্ঞাপন ছাপা হতো, বিশেষ করে ম্যাগাজিনগুলোতে। পত্রমিতার জন্য চিঠি লিখতে লিখতে ছেলেমেয়েরা দুটি উদ্ধৃতি দিত, তিনটা কবিতা পড়তো, হাতের লেখা সুন্দর করার একটা চেষ্টা থাকত।
আফরোজা নাজনীন রেখা জানান, আশি–নব্বইয়ের দশকে বেগম পত্রিকাতেও একটি অংশ ছিল পত্রমিতালী নিয়ে। সেখান থেকে তিনজন মিতার খোঁজ পেয়েছিলেন রেখা। পত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো রেখার। 'আমার তিনজন মিতাই ছিল সমরেশ মজুমদারের ভক্ত। একজন পড়তেন ঢাকা ইডেন কলেজে। আমি থাকতাম চট্টগ্রামেই। আমরা বই নিয়ে অনেক আলোচনা করতাম,' জানান রেখা।
'এর মধ্যে একজন সমরেশের সাতকাহন-এর দীপাবলির একটি উক্তি দিয়ে লিখেছিলেন: যে বলতে পারবে এটি কার উক্তি, তাকেই করব আমার পত্রমিতা। আমি সাথে সাথে কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেছিলাম। এখন তো জানিওনা কে কই আছে,' যোগ করেন তিনি।
তবে বেগম-এর পত্রমিতালী নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা আছে পাঠকদের মাঝে। কারও কারও মতে, মূলত বেগম থেকেই নাকি অনুপ্রাণিত হয়ে পত্রমিতালী বিষয়টার ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। আবার কারও কারও মতে, বেগম-এ পত্রমিতালী নিয়ে আলাদা কোনো অংশই ছিল না।
রাস্তায় মিছিল করতে দেখেছিলেন
বেগম নিয়ে গবেষক ও লেখক আফসান চৌধুরীর ছোটবেলার একটি ঘটনা মনে আছে। দুপুরেবেলা সব কাজ সেরে তিনি মাকে দেখতেন বেগম নিয়ে বসতে। তার মা ছিলেন বেগম-এর দারুণ ভক্ত। একবার বেগম-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন পত্রিকাটির অফিসে। তখন তার চার-কি-পাঁচ বছর বয়স। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, 'বিশাল এক অডিটোরিয়ামে সভায় বক্তৃতা হচ্ছিল। এরপর 'আমাদের লেখনীর মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়ে আমাদের নিজেদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে' — এই বলে সবাই জয়ধ্বনি দিতে দিতে রাজপথে নেমে এল। 'বেগম জিন্দাবাদ', 'বেগম জিন্দাবাদ' করতে করতে রাস্তায় মিছিল করতে লাগল।'
স্কুল পালিয়ে বেগম-এ ছবি!
ফয়সাল আর তার বাল্যবন্ধুদের বেগম-এর সঙ্গে 'মোলাকাত'-এর গল্পটা বেশ মজার। সময়টা '৬৫–'৬৬ সালের দিকে। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে স্কুল ফাঁকি দিয়ে পাঁচ বন্ধু মিলে গিয়েছিল গুলিস্তান হলে সিনেমা দেখতে। হঠাৎ একজন তরুণ এসে তাদের বললেন: 'খোকারা তোমরা একটু কাঁধে হাত রেখে পাশাপাশি দাঁড়াও তো। তোমাদের একটা ছবি তুলি।' তারাও মহাখুশি, ছবি তোলা হবে তাদের। তখনকার দিনে তো বিশেষ কোনো উপলক্ষ্য ছাড়া ছবি তোলা যেত না। তাই মহানন্দে পাঁচ বন্ধু দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে, নড়াচড়ায় যেন ছবি খারাপ না আসে! চার–পাঁচদিন পর ফয়সালের বাড়িতে এলেন এক প্রতিবেশি। হাতে তার বেগম পত্রিকা। পত্রিকা খুলে ফয়সালের বাবা-মাকে দেখানো হলো — তাদের ছেলের স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার ছবি। সেবার ফয়সাল ও তার বন্ধুদের কান ধরে উঠবস করতে হয়েছিল কলোনির মুরুব্বিদের সামনে। এরপর থেকে বেগম পত্রিকা যম হয়ে দাঁড়ায় সেই পাঁচ খোকার কাছে। এ ছোট্ট ফয়সালই নিউমার্কেটের জিনাত বুক সাপ্লাই লিমিটেড-এর কর্ণধার সৈয়দ আবু সালেহ মোহাম্মদ ফয়সাল। বেগম পত্রিকায় নিজের ধরা পড়ার এ গল্প বলতে গিয়ে নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, 'ছবিটা হয়তো আমাদের মা-খালাদের সতর্ক করবার জন্যই ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু সেদিন যা রাগ উঠেছিল না ঐ ফটোগ্রাফারের ওপর!'
বেগম কি এখনও আছে?
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও চরম অস্থিরতার মধ্যে বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ঢাকায় আসতে হয়েছিল নূরজাহান বেগমদের। বেগম-এর নতুন ঠিকানা হলো পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলির ৬৬ লয়াল স্ট্রিট। সেই ৬৬ নম্বর পাটুয়াটুলির ঠিকানাতেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছাপাখানাটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। বর্তমানে এখান থেকেও ছাপাখানাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন স্মৃতি ভবনের ম্যানেজার মাসুম জানান, ছাপাখানাটি এখন বনানীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বেগম-এর একসময়ের নিয়মিত পাঠকদের অনেকেই আজ জানেন না বেগম-এর বর্তমান হাল-হকিকত। বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরীন খান জানান, পত্রিকাটি এখনও বের হচ্ছে মাসিক হিসেবে। তবে আগের মতো পত্রিকার আকারে না, বরং বইয়ের মতো ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। একসময় যারা লিখতেন — যেমন তাহমিনা সাঈদা, জাহানারা আরজু, আমিনা আখতার, জাহানারা পারুল, বেগম রাজিয়া হোসেইন, শাহান আরা জাকির, সাহানা সুলতানা, শায়লা রহমান প্রমুখ — এখনও তারাই লিখছেন।
তেইশ বছর বয়স থেকে বেগম পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন হোমায়রা খাতুন হুমা। এখনও তিনি নিয়মিত লিখছেন বেগম-এ। হুমা বলেন, 'আগে ঘরে-বাইরে বিশাল কর্মীবাহিনী ছিল, বিশাল প্রেস রুম ছিল, আপার সম্পাদনার রুমটাও বিশাল ছিল। লেটার ব্লকের জন্য আলাদা রুম ছিল। এখন তো আর সেই বড় পরিসরে নেই। তবে এখনও এর গ্রাহক সংখ্যা অনেক। কোনোরূপ অনুদান ছাড়াই প্রকাশনার প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত বেগম প্রকাশিত হয়ে আসছে। গ্রাহকদের ডোনেশন ও বিজ্ঞাপনের টাকাই বেগম-এর চালিকাশক্তি।'
বেগম ছিল বাঙালি নারীদের জন্য এক আন্দোলন। সময়, যুগ, কাল পেরিয়ে এ পত্রিকার চাহিদা আজও বহমান। ২০১৬ সালে নূরজাহান বেগমের মৃত্যুর পরও হাল ছাড়েনি বেগম-এর পরিবার। ফ্লোরা নাসরীন খান নিজেই এখন দেখছেন সবটুকু। একসময় তার মা, নানাভাই (মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন) এবং বাবার (রোকনুজ্জামান খান) হাত ধরে প্রগতিশীলতার যে আলোর মশাল জ্বলেছিল, তা যেন কখনো নিভে না যায় এ সংকল্পেই এখনো প্রকাশিত হচ্ছে বেগম।