রাজিয়া বানু: এক বিস্মৃত নাম, সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র নারী সদস্য
'এই জেনারেশন তো শেরে বাংলাকেও চেনে না। ভাসানিকে চেনে না। আমার মাকে চিনে কী করবে?'
[বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বিশেষ করে সাংবিধানিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে নারীর কথা না বললে, তাঁর নাম রাজিয়া বানু। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, যাঁরা এখন প্রবীণ, তাঁদেরও কতজন এই নারীকে মনে রেখেছেন, তা বলা কঠিন। কেননা, রাজিয়া বানু সম্পর্কে বইপত্র কিংবা ইন্টারনেট দুনিয়ার কোথাও তেমন কোনো তথ্য নেই। অল্পবিস্তর যা আছে, তাও ভুলে ভরা। এরকম বাস্তবতায় দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানের ফল এই রচনা।]
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একমাত্র নারী সদস্য রাজিয়া বানু। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতনি। যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছিল, তাঁর স্বামী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান তখন সংসদ বিষয়ক সচিব।
রাজিয়া বানু রাজনীতিতে আসেন তাঁর নানা শেরে বাংলার হাত ধরে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ নির্বাচনে তিনি প্রত্যক্ষ ভোটে বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) থেকে মুসলিম মহিলা আসনের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তাঁর আসনে মোট ভোটার ছিল ১২ হাজার ৭৯২। তিনি পেয়েছিলেন ১ হাজার ৭৯৮ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৪৩.৬৩ শতাংশ। প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে মুসলিম নারী আসন ছিল মোট ৯টি। রাজিয়া বানু ছিলেন বাকেরগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্টের সদস্য।
১৯৭০ সালের নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পরিষদে নারী আসনের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সময় জাতীয় পরিষদে নারী আসন ছিল ৭টি। আধুনিক ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ হিসেবে রাজিয়া বানু ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিলেন। যদিও ১৯৭৪ সালের পরে তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি।
জন্ম, শিক্ষা ও রাজনীতি
রাজিয়া বানুর জন্ম কলকাতায় ১৯২৬ সালের ২৪ জুন। মা নাফিসা বেগম। তাঁর বাবা প্রথম বাঙালি মুসলমান এসডিও এএইচএম ওয়াজীর আলী ছিলেন শেরে বাংলার ভাগ্নে ও জামাতা।
রাজিয়া বানুর লেখাপড়া শুরু হয় কলকাতায়। সেখানে লেডি ব্রেবর্ন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। প্রসঙ্গত, মুসলিম মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজিয়া বানুর নানা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের উদ্যোগেই। এরপর রাজিয়া বানু আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সংসার সামলাতে গিয়ে পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হলেও সেটিও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। ২৮ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য হন। পার্লামেন্টে তিনি কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি শিক্ষা দপ্তরের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিও ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
রাজিয়া বানুর ছোট মেয়ে তাসনিম করিম বেবী বলেন, '১৯৫৪ সালে মা যখন বরিশাল থেকে এমএলএ (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ এসেম্বলি) নির্বাচিত হলেন, তখনও আব্বা ওনাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। চার সন্তান নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এমএলএ হওয়ার পরে ওনাকে লন্ডনে এক মাসের জন্য শিক্ষা সফরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। তখন একজন নারীর একা বিদেশ যাওয়া বিরাট ব্যাপার। নানা মানা করেছিলেন। এক মাসের জন্য ঘর সংসার ফেলে বিদেশে যাওয়াটাকে তিনি মানতে পারেননি। কিন্তু মা বললেন এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। নানা তখন আমার আব্বাকে চিঠি লিখলেন যে, তিনি যেন যেতে না দেন। লিখলেন, স্বামী হিসেবে ওকে বোঝানো তোমার কর্তব্য। কিন্তু আব্বা উত্তর দিলেন, এটা ওর (রাজিয়া বানু) প্যাশন। আমি বাধা দিতে চাই না। তারপর মা গেলেন। এক মাস পরে এলেন। আসলে মায়ের রক্তেই রাজনীতি ছিল।'
রাজিয়া বানু অনেক দেশ সফর করেছেন। ইংল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য তিনি ১৯৫৬ সালে এসব দেশ সফর করেন। তিনি একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন সফর করেন এবং ১৯৫৭ সালে শ্রীলংকায় নারী সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৪ সনে কোপেনহেগেনে আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন (আইপিইউ) সম্মেলন, ১৯৬৬ সালে কানাডায় কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন সম্মেলন এবং ১৯৭২ সনে রোমে আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও জার্মানিসহ আরও অনেক দেশ সফর করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের নারীদের জন্য যে সাতটি সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের ৭ জন নির্বাচিত হন, রাজিয়া বানু তাঁদের অন্যতম।
তাঁর ছেলে সৈয়দ আনিসুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মিরা বাংলাদেশে আক্রমণ শুরু করলে তারা রাজিয়া বানুকে দিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার সপক্ষে একটা বিবৃতি দেওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় তিনি পাকিস্তানি আর্মিদের এড়াতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি আর্মিরা হয়তো ভেবেছিল যে, শেরে বাংলার নাতনিকে দিয়ে এরকম একটি স্টেটমেন্ট দেওয়ানো গেলে সেটি তাদের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিতে রাজিয়া বানু ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য।
রাজিয়া বানুর স্বামী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশেই চাকরি করেছেন। সবশেষ ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় সংসদের যুগ্ম সচিব। ১৯৬৯ সালে বদলি হয়ে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। এর দুই বছর পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালে তিনি অবসরে গেলেও সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, 'নাগর সাহেব (ডাক নাম) আপনাকে আমার লাগবে।' সৈয়দ মাহবুব ছিলেন সংসদ বিষয়ে অভিজ্ঞ। ফলে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সচিব হিসেবে যোগ দেন। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাসনিম করিম বেবী বলেন, 'আব্বা সংবিধান প্রণয়নের ওই সময়টায় প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। দেখেছি সারা দিন ভীষণ ব্যস্ত। আব্বা অহেতুক কারো প্রশংসা করতেন না। কিন্তু দেখতাম যে ড. কামালের (সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি) খুব প্রশংসা করতেন। ড. কামাল তখন যুবক। আব্বা বলতেন, সে খুবই মেধাবী।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে আসার পরে আমিও অনেক সময় স্কুল শেষ করে আব্বার অফিসে যেতাম। বাসায় মায়ের সঙ্গে আব্বার কথা হতো রাজনীতি, সংসদ ও সংবিধানের নানা বিষয়ে। সংসদ সচিব থাকার কারণে আব্বা ভেতরের অনেক কিছুই জানতেন। সেসব নিয়ে কথা হতো। সংসদে কে কী বললো, কী করলো—এসব নিয়ে খাবারের টেবিলেও তারা কথা বলতেন।'
গণপরিষদে রাজিয়া বানু
আনিসুর রহমান বলেন, 'আব্বা আম্মা দুজনই সংসদ বিষয়ে ছিলেন অভিজ্ঞ। আব্বা প্রাদেশিক আইন পরিষদের সচিব ছিলেন। আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসি চালুর পরে রাওয়ালপিন্ডিতে যখন আইয়ুব হাউজ তৈরি করলেন, সেখানে সংসদে অধিবেশন চালানোর মূল কাজটি করেছেন আব্বা। আইয়ুব খান তাঁকে বলেছিলেন, ইউ আর দ্য আর্কিটেক্ট অব মাই অ্যাসেম্বলি।'
তিনি জানান, স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধু যখন লাহোর গিয়েছিলেন, তখন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ও রাজিয়া বানুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁদেরকে বলেন, দ্রুত দেশে চলে আসুন। আনিসুর রহমান বলেন, '১৯৬৯ সালে আব্বা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বদলি হয়ে আসেন। এখানে এসে তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। সিনিয়র অফিসার ছিলেন বলে তাঁকে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে জাতীয় সংসদের সচিব নিযুক্ত করেন।'
আনিসুর রহমান মনে করেন, তাঁর মা রাজিয়া বানুকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে যুক্ত করার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। যেমন– তিনি বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। যে কারণে এমএনএ হিসেবে তাকে তৎকালীন সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্ত করেছে। বিশেষ করে, বিদেশে পাঠাতো বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও সম্মেলনে যোগদানের জন্য। তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। তাঁর ভাষাদক্ষতা এবং তখনকার বাস্তবতায় অত্যন্ত স্মার্ট একজন নারী ছিলেন। সংসদ বিষয়ে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে এমএনএ হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ছিলেন সংসদ বিষয়ে অভিজ্ঞ। ফলে তাঁর কাছ থেকেও রাজিয়া বানু অনেক কিছু শিখেছেন।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ জানান, সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে রাজিয়া বানুকে যুক্ত করার পেছনে তাঁর নিজের যোগ্যতার বাইরেও তিনি শেরে বাংলার নাতনি এবং নারী হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিশেষভাবে বিবেচনা করেছিলেন।
বাল্য ও বহুবিবাহ বন্ধে বিধান করার প্রস্তাব
১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর দেওয়া বক্তৃতায় রাজিয়া বানু নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, 'সংবিধানে লেখা আছে যে, নারীরা সমান অধিকার ভোগ করবে কিন্তু ধর্মের অজুহাতে, কোরআন-সুন্নাহর অজুহাতে তাঁরা সমান অধিকার ভোগ করতে পারেন না। সুতরাং সংবিধানে এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার, যাতে তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে এবং তার দ্বারা বহু-বিবাহ, মৌখিক তালাক, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যেতে পারে।'
রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে তিনি বলেন, 'তাঁদের দিকে আমাদের সম্পূর্ণ খেয়াল আছে। তাঁদের কোনো অধিকার খর্ব হবে না। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে এবং খেয়াল রাখা হবে। আপনার লাঠি ভর করে চলার অধিকার আছে, কিন্তু সেই লাঠি বগলদাবা করে চলতে গেলে পিছনের লোকের যে খোঁচা লাগবে, তার কী হবে? My right begins where your right ends. কারও অধিকার খর্ব করা চলবে না।'
আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান এবং সমান বিচার লাভের অধিকারী—এমন বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে রাজিয়া বানু বলেন, 'প্রত্যেকের দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকার থাকবে। এটাও আমাদের একটা অত্যন্ত প্রগতিশীল পদক্ষেপ। দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারের ব্যবস্থা থাকবে। কাউকে অনর্থক আটক করা হবে না বা কাউকে অহেতুক কষ্ট দেওয়া হবে না।'
চলাচলের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তিনি সংবিধানের বিধান উল্লেখ করে বলেন, জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। এখানে 'বাধানিষেধ সাপেক্ষে' বলে যে কথাটা বলা হয়েছে, তাতে ভয়ের কোনো কারণ নাই। ধরুন, কোনো জায়গায় বাবু সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত একটা সভা করবেন। সেখানে কিছু লোক সেই সভা ভাঙার জন্য লাঠি-সোঁটা নিয়ে গেল; সেখানে সুরঞ্জিৎ বাবু কি বলবেন যে, সভা ভাঙার অধিকার দেওয়া হোক? তখন কি আইন-দ্বারা বাধা দেওয়া ঠিক হবে না? এই আইন করলে ভয়ের কী আছে? এতে কারও অধিকার খর্ব হল না। আইনের বাইরে কেউ কোনো কাজ করলে তাতে কারও মঙ্গল হয় না। যা কিছু করা হয়েছে, তা দেশের মঙ্গলের জন্য এবং দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্যই করা হয়েছে।'
রাজিয়া বানুর বক্তৃতার পরে পাবনা-৪ আসনে থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য গোলাম হাসনায়েন বৈধতার প্রশ্ন তুলে বলেন, 'পরিষদের ৭ জন মহিলা সদস্যের মধ্যে চিফ হুইপ সাহেব ৪ জনকে বক্তৃতা দেবার জন্য তালিকাভুক্ত করেছেন। তাতে করে হিসাব করলে দেখা যাবে, শতকরা ৬০ জন মহিলা বক্তৃতা দেবার সুযোগ পাবেন। অথচ, পুরুষদের বেলায় শতকরা ১২ জনের বেশি বলবার সুযোগ পাচ্ছেন না। আমি এ সম্বন্ধে আপনার রুলিং চাই।' এ সময় স্পিকার বলেন, 'মহিলারা সব সময় বেশি সুবিধা পান।' (ব্যারিস্টার মো.আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৩৯৩)।
বাহাত্তর-পরবর্তী জীবন
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসন (৪)-এর সদস্য ছিলেন রাজিয়া বানু। ওই বছর সংরক্ষিত নারী আসন ছিল মোট ১৫টি। এরপরে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি। তিনি মহিলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিলেন (সম্ভবত ১৯৭৪)। যদিও ১৯৭৪ সালের পরে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না।
তাসনিম করিম বেবী বলেন, 'আব্বা অবসরে যান ১৯৭৪ সালে। ওই বছর পড়ে গিয়ে ভীষণ আহত হন। শয্যাশায়ী হয়ে যান। মা তখন আব্বার দেখাশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারমধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ১৯৭৮ সালে ছেলের মৃত্যু এবং তার এক বছরের মধ্যে ১৯৭৮ সালে স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সংসারের চাপের কারণেও তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি বা থাকতে চাননি। ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন।'
বেবী জানান, তাঁর মা রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার পরে শেষদিকে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয়ও খুব একটা যেতেন না। বলেন, 'একবার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। সবাই মাকে সামনের সোফায় বসার অনুরোধ করলেন। কিন্তু মা বসলেন না। তিন নম্বর লাইনের একটা সোফায় গিয়ে বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সবাই তো আপনাকে সামনে বসতে বললেন। মা কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলেন। তিনি মাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে ''ফুপু কেমন আছেন'' বলে সালাম দিলেন।'
বেবী বলেন, 'আসলে মা কারো কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিতে চাইতেন না। নিজেকে আড়ালে রাখতেন। আমার আব্বা-আম্মা দুজনই সব সময় লো-প্রোফাইল মেইনটেইন করতেন। পরিচয় দিয়ে কোনো সুবিধা নেওয়া, নিজের পরিচয় বলে অহমিকা দেখানো, এগুলো ওনাদের মধ্যে ছিল না। খুবই মার্জিত মানুষ ছিলেন। সৎভাবে জীবন-যাপন করে গেছেন। আব্বাও খুব সৎ অফিসার ছিলেন। সৎ থাকলে যেসব অর্থনৈতিক সংকট আসে, সেগুলোও আমরা মোকাবেলা করেছি। আমাদের ভাইবোনদের বিয়ে দিয়েছেন জমি বিক্রি করে। আসলে আব্বা-আম্মা দুজনই ঝামেলামুক্ত থাকতে চাইতেন। এসব কারণে আমরা ভাইবোনদের কেউই রাজনীতিতে যুক্ত হইনি।'
পরিবার
১৯৪৩ সালে সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজিয়া বানু। এই দম্পতির দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। তাঁরা হলেন ১. নাসরিন রহমান, ২. সৈয়দ আমিনুর রহমান (মৃত্যু ১৯৭৮), ৩. সৈয়দ আনিসুর রহমান, ৪. সৈয়দ জহির রহমান, ৫. তাসনিম করিম বেবী।
বড় ছেলে আমিনুর রহমানের মৃত্যুর পরের বছর ১৯৭৯ সালে মারা যান মাহবুবুর রহমান। এরপরে রাজিয়া বানু মূলত একা থাকতেই পছন্দ করতেন। ছেলেমেয়েদের বাসায় নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল। বেশি যেতেন ছোট মেয়ে বেবীর বাসায়। পরে শান্তিনগরের পৈত্রিক বাড়িটা বিক্রি করে বেবীর বাসার কাছে আরেকটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। শান্তিনগরের ওই বাড়িটা কিনেছিলেন রাজিয়া বানুর বাবা ১৯৪২ সালে।
বেবী বলেন, 'আমরা পাকিস্তান থেকে দেশে আসার পরে আব্বা যখন জাতীয় সংসদ সচিব হিসেবে জয়েন করলেন তখন খুব সুন্দর একটা সরকারি বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু মা সেখানে থাকতে রাজি হলেন না। মা বলতেন, সারা জীবন সরকারি বাড়িতে, ভাড়া বাড়িতে থেকেছি। এখন নিজের বাড়িতে থাকতে চাই। আব্বাও রাজি হয়ে গেলেন। ফলে আমরা উঠলাম শান্তিনগরের বাড়িতে। যদিও বাড়িটা ছিল বেশ পুরোনো। আব্বার মৃত্যুর পরে মা ওখানে থাকতেন। কিন্তু এত বড় বাড়িতে তাঁর একা থাকা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এত বড় বাড়ি দেখভাল করাও কঠিন। তখন আমরা তাঁকে অনুরোধ করলে তিনি বাড়িটা বিক্রি করে দেন। তারপর গুলশানে আমার বাসার কাছে আরেকটা বাসা ভাড়া করে তিনি থাকতেন। ছেলেমেয়েদের কাছে স্থায়ীভাবে থাকতে চাইতেন না। খুব আত্মসম্মানবোধ ছিল। তবে ছেলেমেয়েদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। আমার বাসায় এসে তিন-চারদিন থাকতেন। আবার নিজের বাসায় চলে যেতেন।'
মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৈয়দ আনিসুর রহমান জানান, রাজিয়া বানু পঞ্চাশের দশকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বন্দুক চালাতে জানতেন। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন দক্ষ শিকারী। তাঁর সংগ্রহে বিভিন্ন দেশের বন্দুক ছিল। রবিবার ছুটির দিনে তিনি এগুলো পরিস্কার করতেন। আনিসুর রহমান বলেন, 'আব্বার পোস্টিং তখন ময়মনসিংহে। একটা উঁচু তাল গাছে একটা বড় চিল এসে বসলো। আম্মাকে বললাম তুমি কি পাখিটা মারতে পারবে? মা একটা বন্দুক লোড করলেন। গুলি করলেন। পাখিটা পড়ে গেলো।'
শেরে বাংলার সঙ্গে কিছু স্মৃতি মনে আছে আনিসুর রহমানের। বললেন, 'তাঁকে দেখেছি। আমরা তখন ছোট। পুরোনো ঢাকায় এ কে দাস লেনে তাঁর বাড়িতে যেতাম। তাঁর পেটের উপরে উঠতাম। তিনি সাঁতার কাটতেন। বিস্মিত হতাম যে, এত ভারী একজন মানুষ কী করে সাঁতার কাটেন? আমরা যেতাম তার কারণ ওই বাড়িতে ব্যাপক খানাপিনা হতো। আমার আরেকটা আকর্ষণের জিনিস ছিল মোহন চাঁদের মিষ্টির দোকান। ওদের আমিত্তিটা খুব মজার ছিল।'
মৃত্যু
স্বামীর মৃত্যুর পরে আরও ২০ বছর বেঁচেছিলেন রাজিয়া বানু। তিনি মারা যান ১৯৯৮ সালে। ওই বছর তাঁর ছোট মেয়ে বেবী শিলংয়ে গিয়েছিলেন শাশুড়িকে নিয়ে। তখন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে থাকার জন্য রাজিয়া বানু রাজধানীর গুলশানে বেবীর বাসায় ছিলেন। বেবী ফিরে আসার পরে তিনি নিজের বাসায় চলে যেতে চাইলে মেয়ের জামাই তাঁকে আরও কিছুদিন এই বাসায় থাকার অনুরোধ করেন। ওই বাসায় থাকা অবস্থায় ১৯৯৮ সালের ৯ মে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। নেওয়া হয় গুলশানের কার্ডিও কেয়ার নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে পরদিন ১০ মে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
বেবী বলেন, 'মা চাইতেন না যে তাঁকে নিয়ে কেউ লিখুক। সে কারণে তাঁকে নিয়ে কোনো বইপত্র লেখা হয়নি। কোনো স্মৃতিচারণমূলক লেখাও নেই। এসব ব্যাপারে মায়ের কোনো আগ্রহ ছিল না।' বেবী আক্ষেপ করে বলেন, 'ভারত মহাত্মা গান্ধীকে ভোলেনি। আমরা শেরে বাংলাকে ভুলে গেছি। এই জেনারেশন শেরে বাংলাকে চেনে না। ভাসানিকে চেনে না। আমার মাকে চিনে কী করবে?'
রাজিয়া বানুর খুব বেশি ছবি পাওয়া যায়নি। বেবী জানান, একবার বাসা বদলের সময় ছবির অ্যালবামটা হারিয়ে গেছে।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও সঞ্চালক, নেক্সাস টেলিভিশন।