অবরোধের দিনে কেমন আছেন তারা, যাদের সংসার চলে প্রতিদিনের আয়ে
রাজধানীর ব্যস্ত এলাকাগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত শান্ত ইস্কাটনের অলি-গলি। গাড়িঘোড়ার আধিক্য এখানে খুব বেশি না থাকলেও সবজির ভ্যান, ফেরিওয়ালা, ফল বিক্রেতা, খাবার বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখর থাকে এলাকা। ধারণা ছিল, হরতাল বা অবরোধের সময়ও এই এলাকা তার নিজস্বতা বজায় রেখে চলবে। কিন্তু, এই ভুল ভাঙল বিএনপি, জামায়াতের চলমান অবরোধের দ্বিতীয় দিন রাস্তায় বেরিয়ে। মূল সড়কের দু'ধারে যেসব সবজির ভ্যান, ফলের দোকান, খাবারের দোকান ছিল- সেগুলো আচমকাই সরে গেছে। বরং সেখানে দেখা মিলেছে কিছু সিএনজি আর রিক্সার।
ইস্কাটনের রাস্তাতেই সিএনজি নিয়ে অলসভাবে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। অবরোধের সময় যাত্রী কম, যদি কোনো যাত্রী পাওয়া যায়– সে আশাতেই এদিক-সেদিক চোখ বুলাচ্ছিলেন। প্রায় ১৮ বছর ধরে ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে সিএনজি চালান রফিকুল। বলতে গেলে, অনেক বছর পরে হরতাল কিংবা অবরোধের দিন ফেরত এসেছে। তাই যাত্রীহীন অলস সময় কাটাতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, 'যাত্রী নরমাল দিনের তুলনায় অনেক কম, অর্ধেকই নাই। আর জায়গায় জায়গায় পুলিশ তল্লাশি করে। এজন্য এখন অতি প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হয় না।'
সাধারণ দিনের তুলনায় অবরোধের দিন যাত্রী তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসে রফিকুলের। সাধারণত বিকেল পর্যন্ত ১২-১৩ বার যাত্রীবহন করতে পারলেও, অবরোধের দিন ৩/৪ বারের বেশি 'ট্রিপ' দিতে পারেন না।
হরতাল-অবরোধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অতীতে ফিরে যান রফিকুল। উল্লেখ করেন, কয়েক বছর আগের আর বর্তমানের সময়ের ফারাকের কথা। কোনো জায়গায় জ্বালাও-পোড়াও হলে প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আগেভাগেই টের পেয়ে যান তিনি। তখন মূল রাস্তা ছেড়ে বেছে নেন গলিপথ।
রফিকুল বলেন, 'আগের দিনের হরতাল একরকম ছিল, আর এখনকার দিনেরটা একরকম। এখন যেমন বাংলামোটরে একটা গণ্ডগোল হইলে এখানে বইসা খবর পাই। নেটওয়ার্কের যুগ এখন। তখন তো আর নেটওয়ার্কের যুগ ছিল না। আমরা কোনো খবরও পাইতাম না। তখন দেখা যাইতো, আমরা যাত্রী নিয়া যাইতেছি, আর হঠাৎ কইরা ঝামেলায় পইড়া গেছি। এখন মনে করেন, আগের থেকে খবর পাইতেছি। কোনো ভাই রাস্তায় গণ্ডগোল দেখলে খবর দিয়া জানাইতেছে। আমিও কিছু দেখলে ফোন দিয়া জানাই।'
মোবাইল ফোনের মারফতে এখন আগে থেকেই সতর্ক থাকছেন, এবং ভাঙচুরও কিছুটা এড়ানো যাচ্ছে বলে জানান রফিকুল।
সিএনজিচালকদের মতো যাত্রীহীনতায় ভুগছেন অ্যাপ-ভিত্তিক রাইড সেবাদাতা পাঠাও চালকেরাও। এমনই একজন চালক শাহীন আলম। অবরোধের দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বনানীতে তীর্থের কাকের মতো যাত্রীর আশায় বসেছিলেন তিনি। প্রথম যাত্রী পেলেন দুপুর ১২টা নাগাদ। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ১৫ মিনিটে চলে এলেন বনানী থেকে মগবাজার। এতে যাত্রীর সময় বাঁচলেও চালক শাহীনের সমস্যা মেটেনি।
হতাশার সুরে শাহীন বলেন, 'সাধারণ দিনে জ্যাম ঠেলে বনানী থেকে মগবাজার আসতে সময় কম করে হইলেও ৪০-৪৫ মিনিট লাগে। আজকে রাস্তা ফাঁকা থাকায় সময় লাগছে ১৫ মিনিট। এতে ভাড়াও অনেক কম আসছে। নরমাল দিনে যেখানে ২০০ টাকা ভাড়া পাই, আজকে সেখানে উঠতেছে ১২০-১৩০ টাকা। সব ঠিক থাকলে এই সময়ের মধ্যে ৩/৪ জন যাত্রী পেয়ে যাই। আজকে মাত্র একজন পাইলাম।'
ভ্যানে করে যারা শাকসবজি বা ফলমূল বিক্রি করেন- ক্রেতার সংকটে ভুগছেন তারাও। 'বেচাবিক্রি নাই', বলে বিরস মুখে দিন পার করছেন বিক্রেতারা।
আগে মূল রাস্তার পাশে ভ্যান নিয়ে শাকসবজি বিক্রি করলেও, এখন গলির পথে ঠাঁই হয়েছে বিক্রেতা রিপন মিয়ার। তিনি বলেন, 'মনে করেন, গত তিন-চারদিন ধইরা বিক্রি-বাট্টা কমছে। আগে রাস্তার উপর ভ্যান নিয়া বসলে গাড়ি যাতায়াত করতো আর শাকসবজি বেচতে পারতাম। এখন গলির ভিতরে বেচা-বিক্রি কম। কাস্টমার যেই কয়জনেই আহে, হেরাই নেয়।'
ফল বিক্রেতা জালালের গলাতেও একই সুর। মূল রাস্তা ছেড়ে গলির ভিতরে ঢুকে পড়ায় বিক্রি কমে গেছে অনেক বেশি।
চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পাশে বসেছিলেন চা বিক্রেতা আবুল কালাম। হেঁটে হেঁটে চা, সিগারেট এবং বিস্কুট বিক্রি করেন তিনি। পথচারীরাই মূলত তার ক্রেতা। সাধারণ দিনে রাস্তা মানুষে ভরপুর থাকলেও অবরোধে পথচারীও কমে গেছে। তাই অলস সময় কাটাতে নিজেই ফ্লাক্স থেকে ওয়ান টাইম কাপে চা ঢেলে খাচ্ছিলেন তিনি।
আবুল কালাম বলেন, 'এমনে দিনে ৬ ফ্লাক্স চা বিক্রি হয়। আর আজকে ৩ ফ্লাক্সও বিক্রি হইতেছে না। বিক্রি একেবারেই কইমা গেছে।'
রাজধানীর বেইলি রোডের ধারে বসে থাকা ফুল বিক্রেতাদের কণ্ঠেও ছিল হাহাকারের সুর। এমনই একজন ফুল বিক্রেতা গালিব। অবরোধে ফুল বিক্রি করতে বেরিয়ে লাভের মুখ সেভাবে দেখতে পাননি তিনি। তাই বেইলি রোডে বসে তার নজর ছিল সামনে অবস্থিত রেস্তোরাঁর দিকে। কেউ বের হলেই ফুল বিক্রির চেষ্টা করবে- এমনই বাসনা তার।
সাধারণত বেলি ফুলের মালা এবং গাজরা বিক্রি করেন গালিব। অন্যান্য দিন বিকেল চারটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কেএফসি এবং কাচ্চি ভাইয়ের সামনে থেকে প্রচুর ফুল বিক্রি হয় তার। সাধারণ দিনে ২ হাজার বা ৩ হাজার টাকার বিক্রি হলেও অবরোধের কারণে বিক্রি নেমেছে ৫০০-৬০০ টাকায়।
তার ভাষ্যে, 'মানুষই বাইর হয় না, ফুল কিনব কেডা। সব জিনিসের দাম যা বাড়ছে, রেগুলার আয়েই চলতে পারতাম না, এই অবস্থা চলতে থাকলে তো না খাইয়া থাকা লাগব। এইসব হরতাল-অবরোধ হইলো গরীবের মরণ।'