নিজের জমি নেই, তারপরও শীতের সবজি ফলাতে পারবেন যেখানে
চারদিকে ভেজালের ভিড়ে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই হয়তো প্রতিনিয়ত ভাবেন একটুকরো জমি থাকলে অন্তত নিজের খাবারটা নিজেই ফলাতেন। আর কিছু না হোক পছন্দের শাকসবজি তো সহজেই চাষ করতে পারতেন। কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল আর ব্যস্ত শহরে চাষ করার মতো খালি জায়গা বা ফুরসত কোনোটাই মেলে না বেশিরভাগ মানুষের। নাগরিক জীবনের এই আফসোস মেটাতেই দেলোয়ার জাহানের প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের অভিনব উদ্যোগ 'নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করি।'
ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাউটিয়া গ্রামে অবস্থিত প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্র ও প্রাণ বৈচিত্র্য খামার। যেখানে বিষমুক্ত ফসলের আবাদ করেন দেলোয়ার জাহান। নয় বছর ধরে যাবতীয় রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, হরমোন আর এগ্রো কেমিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে ফসল উৎপাদনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার চাষাবাদ করা বিভিন্ন ফসল বিক্রি হয় ঢাকার মোহাম্মাদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের বিক্রয়কেন্দ্রে। এই প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২১ সালে শুরু করেছিলেন নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের আয়োজন।
এই আয়োজনে কার্তিকের শুরু থেকে মাঘের শেষ পর্যন্ত, প্রায় চার মাস প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের খামারে শীতের সবজি আবাদের জন্য জমি লিজ দেওয়া হয় চাষাবাদে আগ্রহী পরিবারকে। প্রতি পরিবারের জন্য সাধারণত বরাদ্দ থাকে এক শতাংশ জমি। যেখানে বিষমুক্ত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারবেন যে কেউ।
'প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে শহরের মানুষকে যুক্ত করার প্রচেষ্টার একটি অংশ এই উদ্যোগ। কয়েক প্রজন্ম ধরে যারা নগরবাসী, চাষাবাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, গ্রামের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ তো হয় না তাদের। তাদেরকে কৃষির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য,' বললেন দেলোয়ার।
কৃষি কাজ করতে চাইলেই তো আর শহরের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে নিয়মিত গ্রামের ক্ষেতে গিয়ে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। সেই সমস্যারও হাল বের করেছেন দেলোয়ার। প্রাকৃতিক কৃষির এই আয়োজনে ফসল বুনে রেখে যাওয়ার পর গ্রাহকেরা চাইলে তাদের জমির দেখভাল করবেন সেখানকার স্থানীয় কৃষি কর্মীরাই। ফসল তোলার সময়ও যদি কেউ না আসতে পারেন তবে সেই ফসল পাঠিয়ে দেওয়া হবে ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষির বিক্রয়কেন্দ্রে। যেখান থেকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন গ্রাহকেরা।
তবে নিজের হাতে ফসল বোনার পর বেশিরভাগ মানুষই খুব আগ্রহ নিয়ে ফসলের দেখাশোনা করতে বা ফসল তুলতে আসেন পরিবারের সকল সদস্য আর বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। দেলোয়ার জাহানের ভাষ্যে, 'বীজ বোনা, ফসল তোলা সহ বিভিন্ন কাজে বারবার যাতায়াত করতে করতে গ্রামের সঙ্গে নগরের মানুষের দূরত্ব কিছুটা হলেও কমে। পরিবারের বড় সদস্যরা শিশু-কিশোরদের এখানে নিয়ে আসেন, যেন প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়। গ্রামীণ পরিবেশে নিজেদের একটু খানি জমি আছে- এটাও একটা ভালো অনুভূতি দেয় মানুষকে।'
প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রে চার মাসের জন্য ১ শতাংশ জমি লিজ নেওয়ার খরচ ৪০০ টাকা। বীজ কেনা, ফসলের দেখাশোনা ও যত্ন নেওয়ার জন্য কৃষি কর্মীদের মজুরি ও যাবতীয় বাকি সব কাজে প্রতি শতাংশ জমিতে সবজি চাষে গতবছর গ্রাহকদের ব্যয় হয়েছিল ২১০০ টাকা। অর্থাৎ, চার মাস জুড়ে প্রাকৃতিক উপায়ে শীতকালীন চাষাবাদের মোট খরচ পড়ে ২৫০০ টাকার মতো। দেলোয়ারের হিসেব মতে, এভাবে গড়ে প্রতি কেজি শীতের সবজির উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ২০-৩০ টাকা।
২০২১ সালে প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের ১০ শতাংশ জমিতে ১০টি পরিবারকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই উদ্যোগের যাত্রা। ধীরে ধীরে আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে নিজের খাদ্য নিজে চাষ করছেন নগরবাসী মানুষেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ফ্যাশন ডিজাইনার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশা ও অঙ্গনের ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন এই আয়োজনে।
প্রাকৃতিক কৃষির এই উদ্যোগের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত আছেন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শর্মি হোসেন। এবছরও দেলোয়ার জাহানের সহায়তায় নিজের খাদ্য নিজে চাষ করেছেন তিনি। শর্মি হোসেনের মতে, মানুষ হিসেবে পুরোপুরি স্বাধীন-স্বনির্ভর হতে হলে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিজে সংযুক্ত থাকার বিকল্প নেই। করোনাকালীন লকডাউনে থেকে এই উপলব্ধি আরো গভীর হয়েছিল তার। সেজন্যই মূলত প্রাকৃতিক কৃষির সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
'জীবনে প্রথমবারের মতো কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম এই উদ্যোগে যোগ দিয়ে। এক শতাংশ জমিতে চাষ করে আমি এত শাকসবজি পেয়েছিলাম যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে বিলিয়ে দিয়েও অনেক ফসল বাকি ছিল নিজেদের জন্য। এখান থেকে পাওয়া ফসল দিয়ে চার মাসব্যাপী অন্তত দুই-তিনটি পরিবারের শীতকালীন সবজির চাহিদা মিটে চায়,' বললেন শর্মি।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদের এই উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
এবছর প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার ফাইজা আহমেদ। পরিবারের জন্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি তার নিরামিষ রেস্তোরাঁর জন্যও সবজি চাষ করেছেন এখানে। মোট চার শতাংশ জমি চাষাবাদের জন্য লিজ নিয়েছেন তিনি।
ফাইজা আহমেদের ভাষ্যে, 'প্রিয়জনদের জন্য নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার ইচ্ছা সবারই থাকে। কিন্তু ঢাকায় বসে সেই সুযোগ পাই না আমরা। একারণেই এখানে যুক্ত হওয়া। ছেলেকে নিয়ে নিজেদের খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করছি। এখানকার পরিবেশ, গ্রামের বাড়িতে মাটির চুলায় রান্না করা খাবার খাওয়া- সবকিছু মিলে এই আয়োজনটিকে আরো বিশেষ করে তুলেছে।'
শীতকালীন সবজির চাষাবাদের প্রথম ধাপে রোপণ করা হয় মূলা, শালগম, গাজর, পালং শাক, লাল শাক, মটরশুঁটি, বিটের মতো সবজি। পরবর্তী ধাপে চাষ হয় ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস, লাউশাক, ব্রোকলি ইত্যাদি। বীজবপণের প্রায় ১৫-২০ দিন পরই ক্ষেত থেকে শাকসবজি তোলা শুরু হয়।
শীতকালীন সবজির বাইরে বছরের অন্যান্য সময়ও এমন চাষাবাদের ব্যবস্থা করার দাবি জানান প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক গ্রাহক। কিন্তু বছরের অন্য সময়ের চাষাবাদে আবহাওয়া থাকে অনেকটাই প্রতিকূল। দেলোয়ারের মতে, তীব্র রোদ বা বৃষ্টির ভেতর কৃষি কাজে অনভ্যস্ত মানুষজনের জন্য মাঠে গিয়ে ফসল ফলানো অনেকটাই দূরূহ। তাই শুধু শীতকালীন ফসলের সময়টাতেই সীমাবদ্ধ রাখছেন এই উদ্যোগ।