ইদ্রাকপুর দুর্গ: বিস্ময়কর মাটির কলস ও পর্যবেক্ষণ মঞ্চ
মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরের যে জায়গাটায় ইদ্রাকপুর দুর্গ, তার নাম কাছারি। জায়গাটার নাম পুরনো দিনের বাতাস বইয়ে দেয়। 'কাছারি' শব্দটি মারাঠি বা হিন্দি থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিদের মারফত বাংলায় ঢুকে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 'কাছারি'র সোজা অর্থ আদালত। ১৬৬০ সালে মুঘল সেনাপতি মীর জুমলা মাত্র দুই বছরের মাথায় ইদ্রাকপুর দুর্গের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছিলেন।
১৬১০ সালে ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী। তার আগে সুলতানি আমলে রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। তখনো হার্মাদ আর মগদের আক্রমণে জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। ওরা ছিপনৌকা নিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা থেকে মেঘনা হয়ে ধলেশ্বরীর মোহনা দিয়ে শীতলক্ষ্যায় ঢুকে পড়ত। মোগলরা রাজধানী ঢাকায় নিয়ে এলে জলদস্যুদের নজর পড়ে ঢাকার ওপর।
শীতলক্ষ্যা দিয়েই আরো উত্তরে এগিয়ে তারা ডেমরার কাছে চলে আসে। বালু নদীর শাখা নদী দোলাই এখান থেকে ঢাকার বুক চিড়ে বুড়িগঙ্গায় পড়েছে। তাই দোলাই হয়ে ওঠে তাদের চলাচলপথ। মোগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ঢাকায় রাজধানী সরিয়ে আনার পর থেকে জলদস্যুরা তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ইসলাম খান অবশ্য বেশিদিন সময় পাননি, ১৬১৩ সালে তার মৃত্যুর পর কাসিম খান সুবাদার ছিলেন চার বছর। তার পরের পাঁচ বছর ছিলেন ইব্রাহীম খান ফাতেহ জং। একে একে মোহাব্বাত খান, মোকাররম খান, ফিদাই খানও ছিলেন ঢাকার সুবাদার বা প্রশাসক।
সবার আমলেই জলদস্যুরা ছিল চিন্তার কারণ। সব সুবাদারই পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছেন। প্রকৌশলী, স্থপতি আর নৌপথ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সভাও হয়। তবে সুবাদার মীর জুমলার আগে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি নদীর তীরে যে তিনটি প্র্রতিরক্ষা দুর্গ গড়ে তোলেন তা জলদুর্গ নামে পরিচিত হয়। প্রথম দুর্গটি নির্মিত হয় সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইছামতি-ধলেশ্বরী-মেঘনা- শীতলক্ষ্যার মিলনস্থল ইদ্র্রাকপুরে। এখানে পরে যে শহরটি গড়ে ওঠে তার নাম মুন্সিগঞ্জ। অন্য জলদুর্গ দুটিই নারায়ণগঞ্জে, একটি হাজীগঞ্জে অন্যটি সোনাকান্দায়। মোগল দুর্গ মানে দেয়াল, মিনার ও দরজা, লাল বেলে পাথর ও সাদা মার্বেলের ব্যবহারও মোগল স্থাপনার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাংলায় পাথর সহজলভ্য না হওয়ায় ইট, চুন ও চুনের প্লাস্টার দিয়ে নির্মিত হয়েছে দুর্গগুলো। ইদ্রাকপুর দুর্গের পুব দেয়ালের পাশে তৈরি করা হয় উঁচু প্রশস্ত এক মঞ্চ। তার ওপরে ধলেশ্বরীর দিকে মুখ করে বসানো হতো কামান। এটি পর্যবেক্ষণ মঞ্চও বটে।
দুর্গটি একটি বিস্ময়কর স্থাপনা কারণ এর পর্যবেক্ষণ মঞ্চের ভিত তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল অগুনতি মাটির কলস যা বাংলার আর কোনো স্থাপনায় দেখা যায়নি। ইট নির্মিত এ দুর্গ উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত। এটি দৈর্ঘ্যে ৮৭ মিটার আর প্রস্থে ৬০ মিটার।
কার্তিকের মিষ্টি হাওয়ার দুপুরে গিয়ে দেখি সামনের দীঘিটিতে রাজহাঁস ভাসছে। গোসলও সারছে অনেকে। তবে দুপুর একটা গড়িয়েছে বলে সদর দরজা বন্ধ, মধ্যাহ্ন বিরতি। দেড়টায় আবার খুলবে। গ্রীষ্ম ও শীতকালে দুর্গ ভ্রমণের সময় আলাদা। তবে সব মৌসুমেই ছুটি রোববার। বিরতির সময়ে বাইরে থেকে দুর্গটি দেখে নেওয়ার জন্য ঘুরতে থাকলাম। বাইরে থেকেই এর বিশালত্ব বোঝা যায় ভালো।
দুর্গটির চারটি বাহু, উত্তর-পশ্চিম বা পূ্র্ব-দক্ষিণ বাহুগুলো যে জায়গায় এসে মিলেছে সেখানে একটি করে বুরুজ তৈরি করা হয়েছে। এমন বুরুজের সংখ্যা চারটি। বুরুজ- প্রাচীরের ওপরের খিলানগুলোয় চারটি করে ছিদ্র আছে, প্রাচীর গাত্রেও চারটি করেছিদ্র, যা দিয়ে গুলি ছোঁড়া যেত।
স্থপতি হোসনে আরা রুমা জানাচ্ছেন, তখনকার গাদাবন্দুকে গুলি হিসেবে লোহার বল লোড করার আগে বারুদ ঢোকাতে হতো ভালোমতো চেপে চেপে, তাই সময় লাগতো বেশি। প্রতিটি ছিদ্রের পেছনে একাধিক সৈন্য দাঁড়াত। একজন গুলি করে সরে গেলে অন্যজন তার জায়গা দখল করত। দূরের শত্রুর জন্য ব্যবহৃত হতো ওপরের দুই ছিদ্র আর নিচের ছিদ্র দুটি কাছের শত্রুর জন্য।
১৮৫৭ সালে দুর্গটি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ব্রিটিশরা মঞ্চটিতে মহকুমা প্রশাসকের বাংলো নির্মাণ করে। ১৯০৯ সাল থেকে এটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত হতে থাকে, পরে বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগের আওতায় আসে।
দেড়টায় দরজা খুললে টিকিট কাটতে যেতে হলো। উত্তর দিকের বুরুজটি টিকিট ঘর। বড় ছিদ্রটি দিয়ে অনায়াসে টিকিট দেওয়া-নেওয়া করা যায়। দ্বাররক্ষীকে ২০ টাকা দামের টিকিট দেখিয়ে দুর্গের ভেতরে ঢুকলাম। সদর দরজাটি উঁচু খিলান আকৃতির। শান্ত, ছায়া সুনিবিড় ভিতরভাগ। বড় একটা ডিম্বাকার পুকুর প্রথমে, যার পাড়ে নারকেল গাছের সারি, ছায়া পড়েছে পুকুরের গায়ে। কিছুটা এগিয়ে গেলে উত্তরের ড্রাম বা মঞ্চটিতে ওঠার সিঁড়ি পাওয়া গেল। পনেরটির বেশি সিঁড়ি পেরিয়ে গেলে তবে মঞ্চের দরজায় পৌঁছানো যায়। এটিও একটি সুদৃশ্য খিলান। মঞ্চের ওপরভাগ খোলা ময়দানমতো।
ওই দুপুরে একা ছিলাম, অতীতে চলে যেতে বাধা ছিল না। মীর জুমলার সৈন্যরা দেখলাম ধ্যানী বকের মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখ তাদের দূরে মেঘনার জলে নিবদ্ধ, জলদস্যু দেখা গেলে আর আস্ত রাখবে না।
বর্তমানে ফিরে আরো কিছুক্ষণ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলাম। চললাম জাদুঘরের দিকে। নতুন এই জাদুঘর গত বছরের মার্চ মাসে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
কামান রাখার ড্রাম পেরিয়ে নারকেল-জাম-আম গাছের ছায়া বিছানো পুকুর ধারের সরু পথ ধরে হেঁটে গিয়ে দক্ষিণের শেষ মাথায় 'জাদুঘর' লেখা সরু বোর্ডটি পেয়ে গেলাম। বিরাট এক উঁচু পাচিলের গায়ে লাগানো সেটি। পাচিলটি যেমন উঁচু, তেমনি শক্তও; প্রস্থেও হবে হাতখানেক। ঢোকার দরজাটি পাওয়া যায় আরো বিশ-পঁচিশ কদম এগিয়ে গেলে। পাচিলের গা কেটে তৈরি করা হয়েছে চার কোনা সে দরজা। দরজা পেরিয়ে বাঁধানো একটু খোলা জায়গা, তারপর বাংলোসদৃশ একতলা ভবন। তার গায়ের রং হলুদ। ভবনটি ছোটমোট। বাঁ দিকে ঢোকার দরজা, প্রথম গ্যালারি।
শুরুতে মীর জুমলার (১৫৯১-১৬৬৩) পরিচয় লেখা একটি বোর্ড পেলাম। তা থেকে জানলাম- ইরানের ইস্পাহানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। মোগল প্রশাসনে কেরানি হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে উদ্যম আর মেধাগুণে হয়ে ওঠেন একজন সমর নায়ক এবং দক্ষ প্রশাসক। তার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথও উন্মুক্ত হয়। বিশেষ করে ডাচ ও ইংরেজ বণিকরা সুযোগ-সুবিধা লাভ করে।
সৈন্য চলাচলে গতি বৃদ্ধি ও গোলা-বারুদ প্রেরণের নিমিত্তে তিনি রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করেন ঢাকায়। ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করেন তিনি যার উদাহরণ ওই ইদ্রাকপুর সেতু। জলদস্যু ঠেকাতে বুড়িগঙ্গার তীরে ২টি কামান স্থাপন করেছিলেন যার একটির নাম ছিল কালে খাঁ জমজম। আসাম অভিযান শেষে ফেরার পথে তিনি নৌকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তারপর জলদুর্গের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষার কথা মাথায় রেখেই দুর্গগুলোর নকশা ও পরিকল্পনা করা হয়। শক্তিশালী কাঠামোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা কৌশল যুক্ত করে দুর্গগুলোকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়। অবস্থান হিসাবে নদ-নদী বেছে নেওয়ার কারণ ছিল নদীর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা আর জলের সহজপ্রাপ্যতা। বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে পালানোর পথ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো নদীগুলো। এছাড়া নদীতে চলাচলকারী বাণিজ্যতরী সুরক্ষিত রাখাও ছিল জলদুর্গের কাজ।
প্রাচীন আমলে বিক্রমপুর পরগনার অংশ ছিল মুন্সিগঞ্জ। বৌদ্ধ চন্দ্রবংশীয় রাজাদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর, হিন্দু সেন রাজাদেরও রাজধানী ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, গুপ্ত ও সেন আমলের কোনো কোনো স্থাপনায় ব্যবহৃত ইট পুনরায় ইদ্রাকপুর দুর্গে ব্যবহৃত হয়েছে। ইটের আকৃতি এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়। এটাও ধারণা করা হয় যে মোগল আমলের আগে থেকেই এখানে দুর্গ বর্তমান ছিল যা মীর জুমলা সংস্কার করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিস্মিত হয়েছিলেন ইদ্রাকপুর দুর্গের পর্যবেক্ষণ মঞ্চের মেঝেতে মাটির কলসের ব্যবহার দেখে। এর আগে দেশের অন্য কোনো স্থাপনায় এমনটা দেখা যায়নি। কলসগুলোর পুরুত্ব সাধারণ কলসের চেয়ে বেশি। স্তম্ভ বা পিলারের কাজ করত কলসগুলো। পাঁচ স্তরবিশিষ্ট ওই মেঝের প্রথম স্তরে চুন-সুরকি, দ্বিতীয় স্তরে কলসের সারি, তৃতীয় স্তরে বালি, চতুর্থ স্তরে চারকোনা টালি, পঞ্চম স্তরে আবার চুন-সুরকি ব্যবহৃত হয়েছে।
গবেষকরা ধারণা করেন, ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা এবং আর্দ্রতার ফলাফলে তৈরি হওয়া স্যাঁতস্যাঁতে ভাব দূর করতে সারি সারি কলস ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৫ সালে ইদ্রাকপুর দুর্গ সংস্কারকালে মাটির কলসের ব্যবহার দেখে গবেষকরা অবাক ও বিস্মিত হয়েছিলেন। তখন মঞ্চের নিম্নভাগে গোলাবারুদ রাখার গোলাঘরও আবিষ্কৃত হয়।
এক নম্বর গ্যালারির ঠিক মাঝখানে বড় এক ছয় কোনা কাঁচের বাক্সে উঁচু বেদির ওপর কয়েকটি কলস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেয়ালের ধারে দুর্গ খননে প্রাপ্ত লোহার তরবারি, মাটির প্রদীপ, বাসনের ভাঙা অংশ, সিরামিকের পাইপ ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এখানে দেশের আরো সব দুর্গ যেমন লালবাগ, এগারসিন্দুর প্রভৃতি খননে প্রাপ্ত উপকরণসমূহও প্রদর্শন করছেন। লালবাগ দুর্গ খননে প্রাপ্ত পোড়ামাটির বল এবং পোড়ামাটির খেলনা দেখারও সুযোগ আছে। দেয়ালের উপরিভাগে বাঁধানো ফ্রেমে সতের শতকের মুঘল সৈন্যের ছবিটি আকর্ষণীয়, অন্দরমহলে মীর জুমলা নামের ছবিটিও মনোযোগ কাড়ে। তাতে একজন নারীকে হার্প বাজাতে এবং অন্যজনকে বীণা বাজাতে দেখা যায়। প্রধান নারী চরিত্রগুলোর পরনে মসলিন দৃশ্যমান।
মুন্সিগঞ্জের কিছু প্রত্নস্থানের ছবিও ঝোলানো হয়েছে দেয়ালে, যেমন টঙ্গিবাড়ির সতীদাহ মঠ, সোনারং মন্দির, শ্রীনগরের শ্যামসিদ্ধির মঠ, মুন্সিগঞ্জ সদরের মাহাকালি মঠ ইত্যাদি। মোগল আমলে ব্যবহৃত ছোরা, চাকু, ঢাল, বর্ম, বল্লমের ছবিও আছে প্রদর্শনীতে, আছে শায়েস্তা খানের কামানের ছবি।
দ্বিতীয় গ্যালারিরও প্রধান আকর্ষণ কলসগুলো। এছাড়া আছে এগারসিন্দুর দুর্গ খননে প্রাপ্ত জালের কাঠি, পোড়ামাটির পিরিচ, ধাতব গোলক ইত্যাদি। দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলছে হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা দুর্গ। দ্বিতীয় গ্যালারিটি প্রথমটির চেয়ে ছোট। দেখতে তাই সময় বেশি লাগল না। দুর্গ জাদুঘরটি স্বল্প আয়তনের, প্রত্নবস্তুতে সমৃদ্ধও নয়; তবে দুর্গ দর্শনের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে মন্দ বলা যাবে না।