ফারহানার ৩ লাখ মানুষের শক্তিশালী লিংকডইন নেটওয়ার্ক তৈরির নেপথ্য-গল্প
পেশাদার জীবন ও ক্যারিয়ার সহায়তায় লিংকডইন-এর প্রয়োজনীয়তা আমরা হয়তো সকলেই জানি। অনেকেই এটিকে শুধু চাকরি পাওয়ার একটি অনলাইন মাধ্যম মনে করলেও জানেন না চাকরি ছাড়াও কীভাবে পেশাদার জীবনের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা রাখতে পারে। লিংকডইন-এ সঠিক প্রোফাইল তৈরি ও এর কার্যকর ব্যবহার নিয়েও ধারণা কম। তাই এ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে কথা হয় খান ফারহানার সঙ্গে, যার লিংকডইন-এ রয়েছে প্রায় তিন লাখ অনুসারী।
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় 'ইনফ্লুয়েন্সার' শব্দটি বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফলোয়ার আছে এমন ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের প্রোফাইল ব্যবহার করে সহজেই তাদের দর্শকদের প্রভাবিত করতে পারেন, বিভিন্ন ধরনের প্রমোশন ও ব্র্যান্ডিংয়ে অংশ নেন। সে হিসেবে ফারহানা লিংকডইন-এ বাংলাদেশের অন্যতম সফল ইনফ্লুয়েন্সার। তার ব্যক্তিগত প্রোফাইল ও লিংকডইন কমিউনিটি মিলিয়ে তিন লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে। তার বিশাল এই লিংকডইন কমিউনিটি ব্যবহার করে তরুণ-তরুণীরা যেভাবে তাদের পেশাদার দক্ষতা বৃদ্ধি করছেন, ঠিক তেমনি এ প্লাটফর্মে প্রোফাইল তৈরি করে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে নিজেদেরকে এক ধাপ এগিয়ে রাখছেন।
লিংকডইন-এ ফারহানার যাত্রা শুরু ২০১৪ সালের দিকে। প্রথমদিকে শুধু কৌতূহল থেকেই লিংকডইন অ্যাকাউন্ট খুললেও ২০১৬ সালের শেষের দিকে এসে অনেকখানি আগ্রহ ও মনোযোগ দিয়ে লিংকডইন ব্যবহার করা শুরু করেন। ফারহানা বলেন, 'লিংকডইন ভালোমতো বুঝতে আমি ইউটিউবে ভিডিও দেখা শুরু করি। তারপর নিয়মিত ব্লগ আপলোড দেওয়ার মাধ্যমে এ প্লাটফর্মে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে থাকি।'
বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামত ও পেশাদার জীবনের নানান অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য লিংকডইনকে একটি বিশ্বস্ত মাধ্যম বলে মনে করেন তিনি। কারণ এর অ্যালগরিদম বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেও এখানে কোনো নেতিবাচক বা হেয় মন্তব্য করার প্রচলন নেই, ফলে একটি সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকে।
ফারহানা ২০১৮ সালে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে লিংকডইন-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (বিআইআইডি)-এ তার প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। 'ব্যক্তিগত ব্যান্ডিং' ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি নিজের কাজেরও প্রচার করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ২০১৯ সালের শেষের দিকে এসে তার ২০ হাজার অনুসারী পূর্ণ হয় এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি লিংকডইন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ফারহানা জানান, অনুসারী বাড়ার সাথে সাথে তার কাছে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে প্রচুর মেসেজ আসতে থাকে ক্যারিয়ার পরামর্শ নিতে কিংবা সিভি কীভাবে তৈরি করতে হবে তা জানতে। তিনি অনেককে সাহায্যও করেন এবং অনেকেই তার নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই বিভিন্ন চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু যেহেতু তার অনুসারী সংখ্যা ইতোমধ্যে ছয় ঘর অতিক্রম করেছে তাই তার পক্ষে একজন একজন করে সবাইকে সাহায্য করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। এ সমস্যা এড়াতে তিনি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, অনলাইন ক্লাস ও বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন করা শুরু করেন। সেমিনারগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তার প্রশিক্ষণকারীদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন।
]একবার জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) পর্যালোচনার একটি কার্যক্রম চালানো হলে তার কাছে প্রায় দুই হাজারের মতো সিভি জমা হয়। সিভিগুলো দেখতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, তার এরকম একটি কমিউনিটি তৈরি করা প্রয়োজন যাদেরকে তিনি নিজে প্রশিক্ষণ দেবেন এবং তারাও পরবর্তীসময়ে অন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করবে। এ আগ্রহের জায়গা থেকেই তিনি 'ফারহানাসব্রেইনস্টেশন' নামক একটি লিংকডইন গ্রুপ চালু করেন যেটি বর্তমানে লিংকডইন-এ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ যুব নেটওয়ার্ক।
ফারহানার ব্যক্তিগত প্রোফাইলে এখন পর্যন্ত এক লাখ তেইশ হাজার এবং লিংকডইন কমিউনিটিতে তিন লাখেরও বেশি অনুসারী রয়েছে। কোনো ধরনের স্পন্সর কিংবা বুস্টেড পোস্ট ব্যবহার না করেই একে অপরের সহযোগিতা, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তিনি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশাল এ কমিউনিটিকে ১০০ জনের দলে ভাগ করে উদ্যোক্তা উন্নয়ন, ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও নেতৃত্ব গুণাবলীতে দক্ষ করতে ছয়মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণে প্রতিটি ব্যাচের অংশগ্রহণকারীদের সাতটি দলে সংগঠিত করা হয় এবং প্রতিটি দল বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার এক হয়ে কমপক্ষে একটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে কাজ করে। এভাবে এখন পর্যন্ত ফারহানা বারোশ'র বেশি ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
পরবর্তীসময়ে 'ফারহানাসব্রেইনস্টেশন' বিওয়াইএলসি এবং বিডিজবস-এর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করা শুরু করে। এসব প্লাটফর্মের আয়োজন করা বিভিন্ন মেলা এবং কর্মশালাতে তার সদস্যরা সক্রিয়ভাবে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। সীমিত আর্থিক সুবিধা থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীরা শিল্প-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দলগতভাবে কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এছাড়া এসব কার্যক্রম তাদেরকে ভালো নেটওয়ার্ক তৈরির সুযোগও করে দেয়।
ফারহানার নিজের ক্যারিয়ার গঠনেও লিংকডইন ভুমিকা রাখে। তিনি ২০২১ সালে একটি সরকারী প্রকল্পে ব্যবসা বিশ্লেষক হিসেবে যোগদান করেন। কোভিড-১৯-এর সময় শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় একই সালে তাকে 'নেক্সট জেন লিডার' (ইয়ুথ স্পিরিট এওয়ার্ড)-এ সম্মানিত করা হয়। ২০২২ সালে পূর্ব তিমুরে ইউএনডিপির অধীনে আইসিটি ইনোভেশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। যদিও বিদেশে চাকরির পাশাপাশি তিনি তার কমিউনিটির জন্য দূর থেকে কাজ করে গেছেন। ইউএনডিপি ও মোইয়েস-এ কাজ করার সময় 'আইওটি ফর বিগিনার্স' নামক একটি বইও লেখেন। বইটির বিষয়বস্তু ইন্টারনেট অভ থিংস (আইওটি)-এর যুগে টিকে থাকতে সম্ভাবনাময়ী তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব, জ্ঞান অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা।
ফারহানা জানান, তার কমিউনিটির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি ইউএনডিপি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেই দেশে ফিরে আসেন। সকল ব্যস্ততার মধ্যেও এ কমিউনিটির জন্য কাজ করে যেতে চান তিনি। বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন ফারহানা। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে বিআইআইডি, ই-জেনারেশন, অক্সফ্যাম, জিএআইএন এবং সিম্মিট বিডি-এর মতো বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠনে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখেছেন।
বিগত সাত বছরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, সেমিনার, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে প্রায় ১৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন ফারহানা। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠনে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্যও প্রদান করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ফারহানা বিনামূল্যেই তার এ পেশাদার উপদেশ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও তিনি বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন যাতে তার শিক্ষার্থীরা আরও বিস্তৃতভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারে।