আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অন্দরে: ভাষার প্রতি ভালোবাসা, নতুন গন্তব্যের আশা
ফারজানা রহমান (কাল্পনিক নাম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এমিলি কুপারের মতো প্যারিসের রোমাঞ্চকর জীবন উপভোগের জন্য নয়, বরং ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করতে পারায় তিনি এখন ফরাসি ভাষা নিয়ে পড়াশুনা করছেন।
ফারজানা বলেন, "আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইন অথবা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করতে চেয়েছিলাম। প্রথম দিকে আমি এই বিষয় নিয়ে পড়ার তেমন কোনো আগ্রহ পাইনি, পরবর্তীতে শুধু ঢাবিতে পড়ার সুযোগ লাভের জন্যই এই বিভাগে ভর্তি হই"।
তিনি জানান, অনেকেই আছে যারা অন্যান্য বিভাগে সিট না পেয়ে শুধুমাত্র ঢাবিতে পড়ার খাতিরেই এখানে ভর্তি হয় এবং ফলশ্রুতিতে তাদের নতুন একটি ভাষাও রপ্ত হয় যা তাদের একাডেমিক জীবনে ভূমিকা রাখে।
দেশের বাইরে ফরাসি ভাষার শিক্ষার্থীদের চাকরির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান ফারজানা। যেমন, বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অনেক সামরিক কর্মকতারা যান, যেখানকার অনেকেই ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। তাই ওইসব দেশে অনুবাদক হিসেবে চাকরির ভালো সুযোগ রয়েছে। ফারজানা আরো বলেন, "ফরাসি ভাষা অনেক সুন্দর।"
ফারজানার মতো অনেকেই ভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে তাদের জীবনের নতুন পথ তৈরি করছেন। ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই হোক কিংবা ব্যতিক্রমধর্মী ক্যারিয়ার গঠনের উদ্দেশ্যে হোক, ভাষা ইনস্টিটিউট উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।
নাফিস তেহামি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী তিনি চীনা (ম্যান্ডারিন) ভাষায় পড়ায় সুযোগ পান। প্রথমে তিনি জানতেন না ম্যান্ডারিন ভাষা তার কী কাজে লাগবে। নাফিস বলেন, "কিন্তু এখন এই ভাষা নিয়ে পড়ার অনেক সুবিধা দেখতে পাচ্ছি। নানা ধরনের চাকরির সুযোগ আছে অথবা আমরা চাইলে উদ্যোক্তাও হতে পারি। কিংবা নিজের ব্যবসা চালু করতে পারি বা কপিরাইটার হিসেবেও কাজ করতে পারি। যদিও আমি প্রথমে না বুঝেই এখানে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা ভালোই ছিলো।"
চীনা ভাষায় কথা বলার জন্য তারা নিজেরা মিলে একটি কমিউনিটি তৈরি করেছেন। তাদের সাংস্কৃতিক কোর্সে তাদেরকে চারটি চীনা নাটক দেখানো হয়। এছাড়াও চীনা ভাষা সাবলীল ভাবে বলতে পারার জন্য শিক্ষকরা তাদেরকে নিয়মিত চীনা ভাষা শোনার পরামর্শ দেন।
নাফিস আরো বলেন, "আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে চীনে গিয়ে ব্যবসা করা কারণ চীন এখন ব্যবসা বাণিজ্যের শীর্ষে অবস্থান করছে। আর যদি ব্যবসা করতে না পারি তাহলে দেশের বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অনুবাদক হিসেবেও কাজ করতে পারি।" বাংলাদেশের বেশিরভাগ বৃহৎ উন্নয়নমূলক কাজগুলো চীনের দ্বারাই নির্মাণ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এখন পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাচ চীনা ভাষায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। নাফিস তার ডিপার্মেন্টের সিনিয়র দ্বারা অনুপ্রাণিত হন যারা ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় মাস্টার্স করার জন্য চীনে অবস্থান করছেন এবং অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। নাফিস বলেন, "বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই চীনা বৃত্তি (স্কলারশিপ) পাওয়ার সুযোগ নিতে চায়।"
ভর্তি পরীক্ষায় কম র্যাংকিং থাকায় ফাহমিদা বিনতে ফারুক ভর্তি হন জাপানিজ ভাষা বিভাগে। ফাহমিদার জাপান সম্পর্কে খুবই কম ধারণা আছে, জাপানি সংস্কৃতির মধ্যে তিনি শুধু ডোরেমনের মতো বিভিন্ন এনিমে কার্টুনের সাথেই পরিচিত।
ফাহমিদা বলেন, "আমি এই বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই ভর্তি হয়েছি, কিন্তু আসার পর এখন নানা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।" ফাহমিদা জানান, শুরুর দিকে শিক্ষকরা জাপানি ভাষা লেখা এবং পড়ার তিনটি লিপি বা স্ক্রিপ্ট এর মধ্যে হিরাকানা, কাটাকানা ও কাঞ্জি নিয়ে লেকচার দেন। তিনি বলেন, "তিনটি লিপির মধ্যে কাঞ্জি সবচেয়ে কঠিন, হিরাকানা ব্যবহার করা হয় নেটিভ জাপানিজ ভাষা লেখা শিখতে এবং কাটাকানা ব্যবহার করা হয় বিদেশি শব্দ লেখা শিখতে। কাঞ্জি হচ্ছে মূলত চীনা ভাষা।"
ফাহমিদা আরো বলেন, "চীন এবং জাপান বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কাজ করছে, তাই এখানে ভালো সুযোগ আছে অনুবাদক হিসেবে কাজ করার।"
আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. এবিএম রেজাউল করিম জানান, তাদের ইনস্টিটিউটে ১৬টি ভাষা শেখার কোর্স আছে। তন্মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে চারটি ভাষার: ইংরেজি, ফরাসি, চীনা এবং জাপানিজ। ড. এবিএম রেজাউল করিম বলেন, "আমাদের জার্মান, হিন্দি, পর্তুগীজ, কোরিয়ান এবং রাশিয়ান ভাষার জন্যও স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর কোর্স খোলার পরিকল্পনা আছে।"
বিসিএস স্বাস্থ্য অফিসার ডা: কাজি শাফায়েত মাসুম গত ১৯ বছরে ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, তুর্কিশ, ইতালিয়ান, চীনা, জাপানিজ এবং কোরিয়ানসহ ১৪টি ভাষা শিখেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অধীনে কেন্দ্রীয় মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজের পাশাপাশি শখ হিসাবে নতুন ভাষা শেখেন। মাসুম বলেন, "এই বছর আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট মালয় ভাষার কোর্সের উপর প্রজ্ঞাপন দিয়েছে, তাই আমি সেখানেও ভর্তি হয়েছি।"
২০০৪ সালে মাসুম তার ভাষার শেখার যাত্রা শুরু করেন। ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে তিনি ফার্সি শিখেছিলেন। এরপরেই তিনি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট সম্পর্কে জানতে পারেন, যেখানে তিনি আরবি ভাষা শিখতে যান। এরপর থেকে প্রতি বছরই তিনি নতুন ভাষা শেখার জন্য ভর্তি হন। ২০১৬ সালে, তিনি একটি হিন্দি ভাষার কোর্সে ভর্তি হন।
৪৭ বছর বয়সী মাসুম বলেন, "আমার কাছে নতুন নতুন ভাষা শেখাটা অনেক মজাদার লাগে।" নন-গ্র্যাজুয়েট কোর্সে, চার বছরের কোর্স রয়েছে: প্রাথমিক, প্রি-ইন্টারমিডিয়েট, ডিপ্লোমা এবং উচ্চতর ডিপ্লোমা। মাসুম ১৫টি ভাষায় সব প্রাথমিক কোর্স শিখেছেন। কিন্তু পরের কোর্সগুলো করেননি। ঢাবির অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও তাদের পোর্টফোলিওতে একটি নতুন দক্ষতা যোগ করার জন্য ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।
ঢাবির অ্যাকাউন্টিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আশাফুল বলেন, "এটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য একটি বিকল্প সুযোগ তৈরি করে দেয়। আমি যদি জাপানে যাওয়ার সুযোগ পাই, আমি যাব এবং আমার ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারব।" তিনি সম্প্রতি জাপানি ভাষায় জুনিয়র লেভেল কোর্স সম্পন্ন করেছেন এবং শীঘ্রই পরবর্তী লেভেলের কোর্সটি করবেন। একই বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।