সুন্দরবনের দুবলার চর: ৬ মাসের বসতিতে কোটি টাকার ব্যবসা
সুন্দরবনের শেষ সীমায় বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে ওঠা দুবলার চর বাংলাদেশের জন্য এক হিরকখণ্ড। সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ছয় মাসের জন্য ওই চরে গড়ে ওঠে শুঁটকি পল্লী। আর ওই শুঁটকি পল্লী থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছ যায় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি।
দেশে শুধু মাছের চাহিদা পূরণই নয় সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব পায় ওই চর থেকে। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছয় মাস চলে ব্যবসা।
দুবলার চরের মূলত পাঁচটি স্থানে ওই পল্লী গড়ে উঠেছে। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাগর কম উত্তাল থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে সেখানে শুকানো হয়। প্রতি বছর এ কাজে যুক্ত থাকেন ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। শুকানো শুঁটকি চলে যায় চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, রংপুর, ঢাকাসহ দেশের বড় বড় বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে। সরাসরি সাগর থেকে নিয়ে এসে কোনো রাসায়নিক ছাড়া তাৎক্ষণিক রোদে শুকাতে দেওয়া হয় বলে স্বাদ ও গুণাগুণে অনন্য ওই শুঁটকি।
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার জেলেরাই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। ছয় মাস ব্যবসা করার জন্য উন্মুখ হয়ে সারাবছর বসে থাকেন তারা।
দুবলার চরটি সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আওতায়। পূর্ব বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুবলার চর থেকে শুঁটকি আহরণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ১০৫ টন। ওই পরিমাণ শুঁটকি থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আয় হয়েছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৭১ টনের বিপরীতে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৯৮ টনের বিপরীতে ৩ কোটি ২ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫০০ টনের বিপরীতে ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ১০০ টনের বিপরীতে ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল। আর এবার শুঁটকি খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ কোটি টাকা। প্রতি কেজি শুঁটকির জন্য রাজস্ব দিতে হয় ১০ টাকা।
যেসব জেলেদের তিন থেকে পাঁচটি নিজস্ব মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে তাদেরকে বলা হয় মহাজন। আর যাদের ট্রলারের সংখ্যা অনেক বেশি তাদেরকে বলে বহরদার। এসব বহরদার ও মহাজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত লইটা, তেলফ্যাসা, ছুরি, বৈরাগী, চাকা চিংড়ি, রূপচাঁদা মাছের শুঁটকি করা হয়। মাছ শুকাতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ দিন। গড়ে ৫০০ টাকা কেজি দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন তারা। ওই চর থেকেই পাইকাররা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান।
তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছে ওই চর থেকে, তার আগের বছর যা ছিল ২১০ কোটি টাকা। এ বছরও প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার মতো মাছ আহরণ করা হবে সেখান থেকে।
এ তো গেল শুঁটকির কথা। এর বাইরেও প্রতিদিন শত শত মণ সাদা মাছ বরফ দিয়ে ট্রলারে করে চলে যায় খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন পাইকারি আড়তে। ওই মাছের হিসাব নেই কারও কাছে। জেলেরা বলেন, সাধারণ বড় মাছগুলোই বরফ দিয়ে পাঠানো হয়। ওই মাছ নিয়ে যাওয়ার কাজে নিয়জিত আছেন অন্য মহাজন। জেলেরা মাছ ধরে ঘাটে ফিরলেই মহাজনরা তাদের কাছ থেকে মাছ কিনে নেন।
জানা গেছে, এবার দুবলার চরের পাঁচটি স্থানে প্রায় এক হাজার মহাজন ও ৩৫ জনের মতো বহরদারকে মাছ ধরা ও শুঁটকি করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একেক মহাজন চাহিদা অনুযায়ী কমপক্ষে এক বিঘা আয়তনের জমি পেয়েছেন মাছ শুকানোর চাতাল করার জন্য। প্রতি মহাজনদের সঙ্গে গড়ে ২০ জনের মতো জেলে ও কর্মচারী থাকেন।
মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার লোকালয় থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল (১৩০ কিলোমিটার) দূরে বঙ্গোপসাগর উপকূলে অবস্থিত দুবলার চর। ওই চরের আলোরকোল, মাঝেরকেল্লা, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চরে হয় শুঁটকির কার্যক্রম। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এক কঠিন কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সবাই। কেউ রোদে মাছ শুকাচ্ছেন আবার কেউ ট্রলার নিয়ে গহীন সাগরে চলে যাচ্ছেন মাছ ধরার কাজে। ট্রলার মাছ ধরে ঘাটে আসার পর শুরু হয় আরেক ব্যস্ততা। কয়েকজন ঝুড়ি নিয়ে চলে যান ওই মাছ আনতে। মাছ নিয়ে এসেই শুরু হয় বাছাইয়ের কাজ। প্রজাতি অনুযায়ী মাছ আলাদা করা হয়। এরপর শুরু হয় শুকানোর পালা।
তেলা, ফ্যাইসাসহ অন্যান্য ছোট মাছ চাতালে শুকাতে দেওয়া হয়। আর একটু লম্বাটে লইটা, ছুরি মাছগুলোকে বাঁশের আড়ায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। রান্নার কাজেও ব্যস্ত থাকেন কেউ কেউ। তবে সবই করতে হয় পুরুষদের। শুঁটকি পল্লীতে কোথাও কোথাও শিশুশ্রমও দেখা যায়, তবে তা সামান্য।
কেন্দ্রীয়ভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে ওই চরে। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ওই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। দূর থেকে রাতে বিদ্যুতের আলোয় পুরো চরটি শহরের মতো মনে হয়। চরে রয়েছে কয়েকটি মসজিদও। সময় হলেই ওইসব মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে আযানের ধ্বনি। অনেক বহরদার বা মহাজনের চাতালের পাশে মন্দিরও দেখা যায়। বেশির ভাগ মন্দিরে রাখা হয়, বন বিবির মূর্তি। বন বিবি কোনো বেদি নয়। সুন্দরবনে সব ধর্মের মানুষে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। আবার কোনো কোনো মন্দিরে গঙ্গা দেবীরও দেখা মেলে। কোথাও কোথাও আবার রাখা হয় একাধিক দেবদেবী। আধুনিক সমাজের সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন ওই দ্বীপে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্রষ্টার সাহায্য ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যে কারণে সবার মধ্যেই ধর্মীয় অনুভূতি বেশি জাগ্রত।
একটু বিনোদনের জন্য কাজের ফাঁকে কোনো কোনো চাতালে উচ্চস্বরে গান বাজতে শোনা যায়। প্রতিটি চাতালেই রয়েছে নিজস্ব সৌর আলোর ব্যবস্থা। থাকার জন্য খড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কুঁড়েঘর। ওই চরে যতদূর চোখ যায় শুধু দেখা যায় শুঁটকির চাতাল আর চাতাল।
আলোরকোলে কথা হয় এমনই এক মহাজনের সঙ্গে। তার নাম জাহান আলী সরদার। বাগেরহাটের রামপাল থেকে ওই চরে গিয়েছেন তিনি। ৩৫ বছর ধরে ওই চরে ব্যবসা করছেন।
তিনি জানান, সবকিছু দিয়ে ছয় মাসের জন্য ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আশা করছেন, ৩৫ লাখ টাকার মতো শুঁটকি বিক্রি করতে পারবেন। অন্যান্য বছর ছয় মাস কাজ করতে পারলেও এবার এক মাস কম হচ্ছে বলে কিছুটা আফসোস করেন তিনি।
আরও বলেন, "যারা সাগরে মাছ ধরার কাজে থাকেন তাদের ওপরই নির্ভর করে মাছের পরিমাণ। একটু গহীন সাগরে যেতে পারলে মাছের পরিমাণ বাড়ে। অনেক সময় জেলেরা অলসতার কারণে তা না করে উপকূলের কাছাকাছি কোনো জায়গায় জাল ফেলেন। এতে মাছের পরিমাণ কম হয়। আর ক্ষতিতে পড়েন মহাজনরা।"
আলোরকোলের পূর্ব দিকে ট্রান্সপোর্ট ঘাট। ওই ঘাটে দেখা যায়, বিশাল একটি কার্গোজাহাজ বাঁধা। তাতে শুঁটকি বোঝায় করা হয়েছে। ওই ঘাটের কাছেই কথা হয় মেসার্স খান শফিউল্লাহ ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপক মো. কুতুবুদ্দিন মোল্লার সঙ্গে।
তিনি বলেন, দুবলার চর থেকে শুঁটকি নেওয়ার জন্য আট থেকে ১০টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি রয়েছে। এসব এজেন্সির মাধ্যমে রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকা অঞ্চলে শুঁটকি সরবরাহ করা হয়। দেশের শুঁটকি খাতের একটি বড় অংশ যোগান দেয় দুবলার চর।
দুবলার চর-কেন্দ্রিক সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের কিছু সম্ভাবনার কথাও জানান জেলেরা। তারা বলেন, অন্যান্য দেশ প্রচুর পরিমাণ শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। কিন্তু বাংলাদেশ তা পারে না। এর একমাত্র কারণ শুঁটকি কেন্দ্রগুলোতে ফ্রিজ ড্রয়ার ও কোল্ড স্টোরেজ নেই। বিদেশে রপ্তানি করা মাছ শুকাতে হয় অন্যভাবে, যে ব্যবস্থা কোথাও নেই।
জেলেদের জালে যে বড় বাগদা চিংড়ি ধরা পড়ে, তা বরফ দিয়ে খুলনা বা বাগেরহাটের চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় নেওয়া হয়। শুধু সেগুলোই ওই কারখানাগুলো বিদেশে পাঠায়। যদি শুঁটকি মাছ রপ্তানির জন্য সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে ওই চরের শুঁটকি রপ্তানি করে প্রতি বছর হাজার হাজার ডলার আয় করা যেত বলে মনে করেন জেলেরা।
দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস
সাগর থেকে সৃষ্ট যে কোনো ধরনের ঝড়-ঝঞ্ঝা সবার আগে আঘাত হানে দুবলার চরে। বাংলাদেশে আঘাত হানা বড় প্রাকৃতিক দুযোগের বেশিরভাগই হয় সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে। আর ওই সময়ই দুবলার চরে চলে শুঁটকির কাজ। এ কারণে যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা শুনলেই আঁতকে উঠেন দুবলার চরবাসীরা। ট্রলারসহ যাবতীয় মালামাল ও কয়েকদিনের জন্য খাবার নিয়ে ছুটতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এসময় বহর নিয়ে কেউ কেউ আশ্রয় নেন সুন্দরবনের ছোট খালগুলোতে। তবে সেটিও খুব বেশি নিরাপদ নয়। এ কারণে দুবলার চরে কাজ করা অধিকাংশ মানুষের দাবি, ওই চরে যেন বেশ কিছু সাইক্লোন সেল্টার তৈরি করা হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচতে পারলে অনেকটাই নিরাপদ তারা। এর আগে, ওই চরে কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা ব্যবহারের অনুপযোগী।
খাবার পানিরও তীব্র সংকট রয়েছে ওই চরে। শুঁটকি পল্লীর মানুষের জন্য কিছু পাতকুয়া তৈরি করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে সেখানে পানি এসে জমা হয়। ওই পানি খাওয়ার অনুপযোগী ও জীবানুমুক্ত নয়। কিন্তু তারপরও ওই পানিই ভরসা শুঁটকি পল্লীবাসীদের। তবে ওই পানিতে মাত্র এক মাস চলতে পারেন চরের মানুষ। এরপরই শুরু হয় খাওয়া ও রান্নার পানির কষ্ট। ট্রলারে করে দূর থেকে পানি নিয়ে এসে ব্যবহার করতে হয় তাদের। এমন পরিস্থিতে ওই এলাকায় কয়েকটি পুকুরও খনন করার দাবি জানান চরের মানুষ।
দুবলা চরের নিউ মার্কেট এলাকায় প্রায় ১৫টি ফার্মেসি রয়েছে। সেখানে অধিকাংশ ওষুধের দোকানদাররা অসুস্থতার ধরন শুনে জেলেদের চিকিৎসা দেন।
সেখানে চিকিৎসা সেবা দেওয়া গ্রাম্য চিকিৎসক ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, "অধিকাংশ রোগী আসেন পেটের ব্যাথা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়ে। কারণ এখানের জেলেরা বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারেন না।"
চরটিতে কোনো আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ফলে ছয় মাসের জন্য চলে আসা মানুষগুলো জটিল কোনো রোগ ব্যাধিতে ভুগলেও কোনো চিকিৎসা পান না। শর্তভঙ্গ করে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে যে এলাকায় আসবেন, সে উপায় নেই তাদের। এ কারণে বছরের ওই ছয় মাসের জন্য এলাকাটিতে একটি ভাসমান হাসপাতাল রাখারও দাবি তাদের।
দুবলার চর ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, "সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে দুবলার চর থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। অন্যদিকে, দেশের মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করে চরটি। কিন্তু ওই কাজে যারা সহযোগিতা করেন, তাদের ন্যূনতম কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। যে ছয় মাস জেলেরা চরে থাকেন, ওই ছয় মাসজুড়েই নিদারুণ দুর্ভোগে পড়তে হয় তাদের।"
এক সময় জলদস্যু আতঙ্কে ভুগতেন জেলেরা। তবে এখন সেটি নেই। খাবার ও রান্নার পানির সমস্যা প্রকট। ওই সমস্যা সমাধানের জন্য চরজুড়ে ৮ থেকে ১০টি পুকুর খনন করে দিলে জেলেদের খুবই উপকার হবে। তাছাড়া, একটি ভাসমান হাসপাতাল ও পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার দরকার বলে জানান কামাল উদ্দিন আহমেদ।
ছয় মাসের মার্কেট
দুবলার চরের আলোরকোলের পূর্ব দিক ঘিরে গড়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান। একটি বাজারে যত দোকান থাকে সবই রয়েছে সেখানে। সেলুন, লেদ মেশিন, খাবারের হোটেল, কসমেটিকস, মুদি ও কাপড়ের দোকানসহ অসংখ্য দোকানের পসরা পুরো বাজারজুড়ে। জেলেরা ওই বাজারের নাম দিয়েছেন 'নিউ মার্কেট'। ওইসব দোকান থেকে ছয় মাসের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটান জেলেরা।
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ দোকান বসিয়েছেন ওই মার্কেটে। আছে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানও। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে দোকানগুলো সাজানোও হয়েছে নান্দনিকভাবে। যে যার মতো করেই সেটি করেছেন। বাজারটি দেখে বোঝার উপায় নেই মাত্র কয়েক মাসের জন্য সেখানে দোকানগুলো দেওয়া হয়েছে। মাছ তো রয়েছেই পাশাপাশি মুরগি, ডিম ও শাকসবজির দোকানও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে ছয় মাসের এক জমজমাট বাজার সেটি। খুলনা ও বাগেরহাটের লোকালয় থেকে প্রায় শত কিলোমিটার দূরে নির্জন এলাকায় গড়ে ওঠা ওই বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম শহরের মতোই সামজাস্যপূর্ণ।
কয়েকজন দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোকানগুলোতে কেনাকাটার ক্ষেত্রে রয়েছে এলাকার টান। সাধারণত দোকানদার যে এলাকার ওই এলাকারই ক্রেতা বেশি। প্রতিবছর বাকিও পড়ে অনেক। এলাকায় গিয়ে বাকির টাকা তুলতে হয়।
ওই বাজারের 'উত্তম হেয়ার ড্রেসার' নামের এক সেলুনের দোকানে চুল কাঁটতে ব্যস্ত ছিলেন সেলুনের মালিক বিপ্লব রায়। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে গিয়েছেন তিনি।
বিপ্লব রায় বলেন, ডুমুরিয়ার থুকড়া বাড়ারে তার সেলুন রয়েছে। কিন্তু দুবলার চরে আসার সময় হলেই আর বসে থাকতে পারেন না। গত ১০ বছর ধরে আলোরকোলে আসছেন। ছয় মাসে ভালোই আয় হয় বলে জানান তিনি।
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রাম থেকে আলোরকলে মুদি দোকানের পাশাপাশি খাবার হোটেল দিয়েছেন সুরাজ রায়। তিনি বলেন, সাধারণত যেসব দ্রব্যের চাহিদা থাকে ওইসব দ্রব্যই দোকানে রাখেন তারা। চরগুলোতে সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ রয়েছে। ওই মানুষের চাহিদার দিকটি লক্ষ্য রেখেই দোকান দেওয়া হয়। প্রতিটি দোকানেই কম বেশি বেচা-কেনা হয়। পণ্য ফুরিয়ে গেলে ট্রলারে করে আবার আনতে হয়।
চরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকে শত শত ট্রলার। এসব ট্রলারের যন্ত্রাংশে নানান ধরনের ত্রুটি দেখা যায়। ওইসব যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য চরজুড়ে রয়েছে কয়েকটি লেদ মেশিন। নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থায় সেটি চালানো হয়।
রাস উৎসব
দুবলার চরটি দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে রাস উৎসবের কারণে। শত শত বছর ধরে সুন্দরবনের শেষ সীমায় বঙ্গোপসারের তীরে দুবলার চরের আলোরকোলে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে রাস পূজা ও পূণ্যস্নান। তিথি অনুযায়ী দুর্গাপূজা শুরুর ৪০ দিন পর পূর্ণিমা রাতে ওই পূজা ও পরদিন ভোরে পাপ মোচনের আশায় সাগরের পানিতে স্নান করে ফিরতে শুরু করেন পূণ্যার্থীরা। প্রতি বছর রাস পূজা উপলক্ষে আলোরকোলে বড় আকারে আয়োজন করা হয় মেলার। মেলা ও পূজা দেখতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন সেখানে। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের রাস পূজা ও পূণ্যস্নান করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও রাস পূজা উপলক্ষে সেখানে প্রায় অর্ধলাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল বলে জানান আয়োজকরা।
সব মিলিয়ে ছয় মাসের জন্য প্রাণ পায় দুবলার চর। মানুষের পদচারণায় মুখোর থাকে চরটি।
নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় মৎস্য বিভাগ, বন বিভাগের 'না'
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, সুন্দরবনসহ দুবলার চরে মাছ সংক্রান্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হয় বন বিভাগের মাধ্যমে। এ কারণে মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে কোনো তথ্য থাকে না। তবে জেলেরা বনের জায়গায় অবস্থান করলেও মাছ ধরে সাগর থেকে। সুতরাং ওই মাছ মৎস্য বিভাগের আওতায় পড়ে।
সেখানে মৎস্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থাকলে একদিকে যেমন জেলেদের জীবনমানের উন্নয়ন হতো, অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি বা কৌশল ব্যবহার করে শুঁটকির গুণাগুণও নিশ্চিত করা যেত।
তিনি বলেন, "মাছে কোনো ধরনের জীবাণু বা ভাইরাস রয়েছে কী না তা যাচাই করেই বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু দুবলার চরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাটি বা বালির ওপর মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। যা কোনোভাবেই মানসম্মত নয়।"
তিনি বলেন, "সেখানে যদি বন বিভাগের পাশাপাশি আমাদের সংশ্লিষ্ট করা যায়, তাহলে মাছের গুণগত মান উন্নয়ন করা যাবে।"
জানতে চাইলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, "পুরো সুন্দরবনটিই একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এখানে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ করার সুযোগ নেই। বন বিভাগই জেলেদের উন্নয়নে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এতে জেলেদের যে খাবার পানির সমস্যা রয়েছে, সেটি অনেকটা সমাধান হবে।"
চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপারে তিনি বলেন, "চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মতো কোনো সুযোগ বন বিভাগের নেই। দুর্গম বনের মধ্যে বন বিভাগের লোকরাও চিকিৎসা পান না।"
"তবে বন বিভাগের পক্ষ থেকে 'সুরক্ষা' নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বন বিভাগের লোকদের পাশাপাশি জেলেরাও চিকিৎসা সেবা পাবেন," যোগ করেন তিনি।