মেট্রোরেল যেভাবে জনবহুল এলাকার বাসিন্দাদের উত্তরার আবাসিক এলাকায় আগ্রহী করে তুলছে
দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীসহ ঢাকার তেজকুনিপাড়ার ভাড়া বাসায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী কামরুল হাসান। দুই বেডরুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসার জন্য ভাড়া গুনতে হয় ২০ হাজার টাকার বেশি। ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে, সারাদিন বাসার ভেতর বন্দী থাকতে চায় না তারা। এলাকায় কোনো খেলার মাঠও নেই যেখানে নিশ্চিন্ত মনে তাদের খেলতে ছাড়বেন। প্রায়ই ভাবেন সাজানো গোছানো এলাকায় খোলামেলা একটা বড় বাসা নিতে পারলে একটু স্বস্তিতে থাকতে পারতেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু ফার্মগেটে অফিস হওয়ায় এদিকটা ছাড়া সাধ্যের ভেতর বাসা ভাড়া পাওয়া মুশকিল। আশেপাশের এলাকায় একটু বড় খোলামেলা বাসা খুঁজতে গেলে এখনের চেয়ে অন্তত দুইগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হবে প্রতি মাসে। তাই ১০ বছর ধরে বাধ্য হয়ে এই ঘিঞ্জি এলাকার ছোট বাসাতেই মানিয়ে নিচ্ছিলেন কামরুল আর তার পরিবার।
গত মাসের শুরুতে ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে বাণিজ্যিক যাতায়াত শুরু হওয়ার পরপরই নতুন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস করেন কামরুল। ইদানিং মেট্রোরেলে করে উত্তরায় বসবাস করা বোনের বাসায় যাতায়াতে তার সময় লাগছে আধাঘণ্টারও কম। সেখানে মেট্রোরেল স্টেশনের আশেপাশে বাসা ভাড়াও তার সাধ্যের নাগালে। পরিবেশটাও খোলামেলা। বোনের পরামর্শে তাই তিনিও সপরিবারে আগামী জানুয়ারি থেকেই দিয়াবাড়ি এলাকায় স্থায়ী হবেন বলে ঠিক করেছেন।
কামরুল হাসানের ভাষ্যে, "আমার বর্তমান বাসার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বড় বাসার ভাড়া উত্তরা দিয়াবাড়িতে ১৫ হাজার টাকার আশেপাশে। মেট্রোরেলে অফিসে আসা-যাওয়া করলে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ চার-পাঁচ হাজার টাকা লাগবে যাতায়াত খরচ। আমার বর্তমান বাসার খরচেই যদি এরচেয়ে ভালো বাসা আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে পারি, তবে এই সুযোগ হাতছাড়া করব কেন?"
রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের আংশিক যাত্রা। তবে এবছর নভেম্বরের ৪ তারিখে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের স্টেশন খুলে দেওয়ার পরই কামরুল হাসানের মতো আরো অনেকেই নিজেদের থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন নতুন করে। সাধারণ যানবাহনে জ্যামের ভোগান্তি পেরিয়ে যে পথটুকু পেরোতে আগে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লেগে যেত, বর্তমানে মেট্রোরেলে করে একই পথ পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে ৩০-৪০ মিনিটে। এতদিন যারা কাজের খাতিরে মতিঝিল-ফার্মগেটের মতো জনবহুল এলাকাগুলোতে থাকতেন বাধ্য হয়ে, তাদের সামনে হাজির হয়েছে নতুন রাস্তা। অপরিকল্পিত, ঘিঞ্জি এলাকা ছেড়ে সাজানো-গোছানো মনোরম পরিবেশে বাসা বদল করার পরিকল্পনা উঁকি দিচ্ছে অনেকের মনেই।
উত্তরায় মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর আশপাশে নতুন করে গড়ে উঠছে অনেক আবাসিক এলাকা। স্থানীয়দের ধারণা, দিয়াবাড়ির মতো এলাকাগুলো মফস্বল ভাব ছাড়িয়ে খুব শীঘ্রই পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় রূপ নেবে। ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলো ছেড়ে নতুন এলাকায় বাসস্থান বদলের চিন্তা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে রাজধানীবাসী ও নগর-পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়া চান সাধ্যের নাগালে
রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বাসা ঠিক করার সময় খেয়াল রাখতে হয় অনেক বিষয়। শুধু ভালো পরিবেশই নয়, যাতায়াত ব্যবস্থা, সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তার পাশাপাশি সবচেয়ে বড় চিন্তা হয় বাসা ভাড়াটা সাধ্যের ভেতর হবে কি না। মেট্রোরেলের কারণে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা কমলেও বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বসবাসের এলাকা পরিবর্তনে ইচ্ছুক অধিকাংশ পরিবার।
তেমনই এক পরিবারের কর্তা জয়নাল আবেদীন। মতিঝিলে অফিস, পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন অফিসের কাছাকাছিই। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর একবার ভেবেছিলেন উত্তরা ১৮ নং সেক্টরের দিকে বাসা বদল করবেন। কয়েক মাস আগেও শুনেছিলেন ১৫-১৬ হাজার টাকার ভেতর বেশ ভালো বাসা পাওয়া যায় সেদিকে। কিন্তু ইদানিং নাকি সেই এলাকাতেও বাসা ভাড়া বাড়ছে হুহু করে! জয়নালের ভাষ্যে, "উত্তরার পুরোনো সেক্টরগুলোতে আগে থেকেই বাসা ভাড়া বেশি ছিল। ১৮ নং সেক্টর যেহেতু নতুন, আর একটু দূরে তাই ভেবেছিলাম সেখানে ভাড়া কম থাকবে। কিন্তু সেখানে থাকা পরিচিতদের কাছে শুনেছি নতুন বছরে বেশিরভাগ বাসায় দুই-তিন হাজার টাকা ভাড়া বেড়েছে। সার্ভিস চার্জ-টার্জসহ ভালো বাসাগুলো সব ২০ হাজার টাকার ওপর ভাড়া। তাই আপাতত বাসা বদলের চিন্তা বাদ দিয়েছি। গোছানো এলাকায় সাধ্যের মধ্যে বাসা ভাড়া পেলে ইচ্ছা ছিল সেখানে চলে যাওয়ার।"
তবে সব দিক বিবেচনা করে ভালোভাবে খুঁজলে উত্তরায় মেট্রোরেল স্টেশনের আশেপাশে কম ভাড়াতেও ভালো বাসা পাওয়া সম্ভব মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। রাজধানীর বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা সৈয়দ আল সাহাফ বলেন, "আমার পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সামনের মাসে মতিঝিলের বাসা ছেড়ে উত্তরার বাসায় উঠছেন। একই ভাড়া কিন্তু বাসার সাইজ দ্বিগুণ."
উত্তরায় নিজেদের বাড়িতেই পরিবারসহ বসবাস করেন মাহিমা রিতু। তিনি জানান, গত কয়েকমাসে তাদের বাড়ির আট-নয়টি ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে ফার্মগেট-মতিঝিল এলাকা থেকে। মেট্রোরেলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতির কারণেই তারা এলাকা বদল করেছেন বলে ভাবছেন রিতু।
ঢাকার আরেক বাসিন্দা মঈম ইসলামের মতে, "যাতায়াত ব্যবস্থা যেহেতু ভালো তাই সামর্থ্য থাকলে ঘিঞ্জি এলাকায় না থেকে ভাড়া বেশি হলেও মানুষ পরিকল্পিত পরিবেশে থাকতে চাইবে।"
নির্মাণাধীন আবাসিকগুলো নিয়ে স্থানীয়দের আশা
উত্তরা দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের শেষ স্টেশন উত্তরা উত্তর। স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বেই হাজী আরব আলী মেম্বার রোড। এখনও মফস্বল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি এলাকাটি। কাঁদা আর খানাখন্দে ভরা ইট-মাটির রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন সুউচ্চ দালানের কাজ চলছে। নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে, এমন এক বিল্ডিং এ টু-লেট লাগানো দেখে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল ৩ বেড রুমের এক-একটি ফ্ল্যাট ২৫-৩০ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখা মিললো এই এলাকার গোড়াপত্তন যার হাত ধরে সেই আরব আলী মেম্বারের ছেলে আলেক মিয়ার। জানালেন, এলাকায় বর্তমানে ১১টি বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে তাদের। এই এলাকায় বাসা ভাড়া এখনও নির্দিষ্ট নয়। পুরোনো বাসাগুলোতে বাড়ি মালিকের পরিচিতরা উঠতেন যে যেমন পারেন তেমন ভাড়া দিয়ে। তবে সামনের বছরই এই অবস্থার আমুল পরিবর্তন হবে বলে আশাবাদী তিনি।
আলেক মিয়ার ভাষ্যে, "আশেপাশে যে নতুন বাড়িগুলো হচ্ছে সেগুলোর সব ফ্ল্যাট কিন্তু বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সাথেসাথেই। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এদিকে আসতে আগ্রহী হচ্ছে। এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ ছিল, সেগুলো ঠিক করারও কাজ চলছে। এই পুরো এলাকার চেহারাই বদলে যাবে সামনের বছর। বাড়ি ভাড়াও অনেকটাই বাড়তে পারে।"
ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরার নতুন আবাসিক এলাকাগুলোর পাশাপাশি রাজধানীর মিরপুরের দিকে বসবাসেও নাগরিকদের আগ্রহ বাড়বে। তবে মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশনের আশপাশে পল্লবী, বর্ধিত পল্লবীর মতো আবাসিক এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। মতিঝিল-ফার্মগেটের মতো এলাকা থেকে এই এলাকায় বাড়ি বদলের সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না স্থানীয়রা। উত্তরার নতুন এলাকাগুলোর তুলনায় মিরপুরের আবাসিক এলাকায় বাড়িভাড়াও তুলনামূলক বেশি।
নগর-পরিকল্পনাবিদের ভাবনায়
মেট্রোরেলের কল্যাণে রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায় পরিবর্তন নগরবাসীর বসবাসের এলাকা নির্বাচনের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরাও। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদের ভাষ্যে, "যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে সাধারণ মানুষজন যোগাযোগ ব্যবস্থার করিডোরে বসবাস করতে চায়। বাসস্থানের এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু জিনিস বিবেচনা করে। যার মধ্যে বাড়ি ভাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি অন্যতম। পাশাপাশি পরিকল্পিত অবকাঠামো, খোলা জায়গা, বাজারঘাটের সুবিধাও প্রাধান্য পায়। বাড়ি ভাড়ার কথা বিবেচনা করে আবাসিক এলাকা হিসেবে শহরের মাঝামাঝি এলাকার চেয়ে সাইডের এলাকাগুলো বেশি পছন্দ করে মানুষেরা।"
তার মতে, উত্তরা দিয়াবাড়ির দিকে এলাকাগুলো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে দ্রুত গড়ে উঠছে। নাগরিক সুযোগ সুবিধাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে সেখানে। তাই নগরবাসীও মনোরম, শান্ত পরিবেশের টানে এদিকটায় বসবাসে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
তিনি আরও বলেন, "মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশন ও স্টেশনের ৫০০-৮০০ মিটারের মধ্যে যেসকল বাড়িগুলো আছে সেগুলোর চরিত্রও কয়েকবছরের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন হবে। হেঁটে এসেই মেট্রোরেলে যাতায়াত করার সুবিধার্থে মানুষ বাসস্থান হিসেবে এই জায়গাগুলোকে বেশি বেছে নেবে।"