উত্তরা, মিরপুর এলাকায় মেট্রোরেলের আশেপাশে কোটি টাকার নিচে ফ্ল্যাট নেই
রাজধানী ঢাকাতে জামাল হোসেনের একটি ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন থমকে আছে।
অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংকার উত্তরায় মেট্রোরেলের আশেপাশে ফ্ল্যাট কেনার জন্য যথেষ্ট সঞ্চয় করেছেন। হাতে ১ কোটি টাকা নিয়ে তিনি আগারগাঁওয়ে সম্প্রতি শেষ হওয়া আবাসন মেলায় এসেছিলেন। আশা ছিল, এই টাকায় ১,৩৫০ বর্গফুটের তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট বাসা কিনতে পারবেন।
তবে এক ডজনেরও বেশি রিয়েল এস্টেট স্টল ঘুরে তিনি দেখলেন, পছন্দমতো জায়গায় তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট কিনতে গেলে তাকে কমপক্ষে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা গুনতে হবে— এক বছর আগেও যে ফ্ল্যাট আরও অন্তত ১০-১৫ লাখ টাকা কমে পাওয়া যেত।
একই স্বপ্ন নিয়ে মেলায় এসেছিলেন ব্যবসায়ী সৈয়দ ইফতেখার আলি। মেট্রোরেল দিয়ে সহজে যাতায়াত করা যায় এমন জায়গা— মিরপুর, উত্তরা এলাকায়— ফ্ল্যাট কেনার জন্য হন্য হয়ে ঘুরেছেন মেলার স্টলগুলোতে। কিন্তু ৬০ লাখ টাকা বাজেটে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান ঘুরেও ফ্ল্যাট নিতে পারেননি তিনি। তার পছন্দ অনুসারে কোটি টাকার নিচে কোনো ফ্ল্যাটের সন্ধান তিনি পাননি।
মেলার আবাসন ব্যবসায়ীরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মূলত মেট্রোরেলের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এসব এলাকায় আবাসনের চাহিদা বেড়েছে। আর তারা এখানে যে ফ্ল্যাটগুলো তৈরি করছেন, সেগুলো প্রজেক্ট শুরু হওয়ার পর থেকেই কিস্তিতে বিক্রি হতে থাকে।
দেখা যায়, প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তাই মেট্রোরেল প্রকল্পকে ঘিরে মিরপুরে আবাসন প্রকল্প করছে বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠান।
ব্যবসায়ীরা আরও জানিয়েছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি ও নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর কারণে এক বছরের ব্যবধানে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। তবে, ড্যাপ পুনঃবিবেচনা না করা হলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা আবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের।
নাভানা রিয়েল এস্টেটের সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজার (সেলস) কাওসার হোসেন সুমন টিবিএসকে বলেন, "মিরপুরে ৩ বছর আগে যেই ফ্ল্যাট ৫,৫০০ টাকা থেকে ৭,০০০ টাকা বিক্রি হয়েছে প্রতি স্কয়াফিট। এখন এরকম ফ্ল্যাটের (প্রতি স্কয়াফিট) দাম বেড়ে হয়েছে ১০,০০০ থেকে ১৩,০০০ হাজার টাকা।"
তিনি বলেন, "মিরপুরে চাহিদা বাড়ার ক্ষেত্রে মেট্রোরেল একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ নাগরিক সুবিধায়ও মিরপুর রয়েছে। চাহিদার কারণে মিরপুরে নতুন নতুন প্রজেক্ট নেওয়া হচ্ছে। ক্রেতারা এখন ১,৬০০ বর্গফুটের ফ্লাটের চাহিদা বেশি দেখাচ্ছেন।"
র্যানকন রিয়েল এস্টেটের হেড অব সেলস দেবব্রত রায় বলেন, "মিরপুরে আমাদের অনেক প্রজেক্ট আছে। রানিং আমদের শেওড়াপাড়াতে একটি বড় প্রকল্প আছে, এটা কন্ডোমিনিয়াম। এখানে প্রতি স্কয়ারফিট ১২,৫০০ টাকা। সবচেয়ে ছোট ফ্ল্যাটের আকার ১,৬৫০ আর বড়গুলো হচ্ছে ২,১৮০ স্কয়ারফিট।"
দেবব্রত আরও বলেন, "২,১০০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্লাট এখানে ৪ কোটি টাকা হবে। ৩০ শতাংশ ডাইন পেমেন্ট দিয়ে বাকিগুলো কিস্তিতে টাকা পরিশোধের সুবিধা আছে।"
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মিরপুর হয়ে ঢাকা মেট্রোরেলের উত্তরা-মতিঝিল রুট সম্পূর্ণ চালু হয়।
দেশে ভূমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনাবেচার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বি-প্রপার্টির করা এক সমীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় আবাসন খোঁজা মানুষের মধ্যে মিরপুরে খুঁজেছেন সর্বোচ্চ ২৬.৬৮ শতাংশ, এরপর উত্তরাতে ১২ শতাংশ, বসুন্ধরাতে ৮.৩৬ শতাংশ এবং ধানমন্ডিতে খুঁজেছেন ৭.৪৮ শতাংশ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বি-প্রপার্টির কাছে চাহিদা আসা ৬৫ হাজার গ্রাহকের তথ্য পর্যালোচনা করে এসব তথ্য দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ট্রপিক্যাল হোমসের জেনারেল ম্যানেজার (সেলস) মোহাম্মদ তাকিব হোসেন জানান, মেট্রোরেলকে ঘিরে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তারা।
"এরমধ্যে মিরপুর, মাটিকাটা এবং ইসিবি চত্তরের মতো এলাকাগুলো রয়েছে। উত্তরায় আমাদের তিনটি প্রকল্প আছে— যার মধ্যে একটি ১৩ নম্বর সেক্টরে; সেখানে প্রতি বর্গফুটের দাম ১২,৫০০ টাকা।"
গেল দুই মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে বলে জানালেন তাকিব হোসেন। গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির মতো এলাকায়– যেখানে খালি জমি নেই বললেই চলে– সেখানে ফ্ল্যাটের দাম এখন ৮ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নির্মাণ খরচ, ড্যাপ, ঋণের সুদহারের কারণে ব্যয় বাড়ছে
ফ্ল্যাটের দাম বাড়ার বিষয় রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট (অর্থ) আব্দুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, ডলারের দাম একটা সময়ে ছিল ৯০ টাকা, সেটা এখন ১২৫ টাকা হয়েছে।
তিনি বলেন, "ফলে আমাদানি করা পণ্যর দাম এখন ৪৫-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। দুই বছর আগে দক্ষ শ্রমিক মজুরি ছিল প্রতিদিন ৬০০ টাকা এখন সেটা হয়ে গেছে ১,০০০ টাকা। এর ফলে দুই বছর আগে যে ফ্লাটের দাম ছিল ১ কোটি টাকা ছিল, সেটা এখন ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা হয়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "রাজধানীতে ফ্লাট কেনা মানে আপনাকে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) বিধিনিষেধ ও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আবাসন খাতে সংকট চলছে।"
আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, "ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০০৮ মেনে আমরা ভবন তৈরি করতাম। তখন সাড়ে তিন কাঠা জমিতে ৮তলা করা যেত। এখন ড্যাপ হওয়াতে ৫তলা করা যাচ্ছে। এর ফলে ওই জমি ডেভলপার নিতে পারছে না। কারণ মালিককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়ে আর লাভ থাকছে না।"
"আমরা মনে করি, ড্যাপ সংশোধন হলে ফ্ল্যাটের মূল্য কিছুটা কমবে," যোগ করেন তিনি।
এছাড়া, দুই বছর আগে ৯ শতাংশ সুদে ফ্ল্যাট কেনার ঋণ পাওয়া গেলেও এখন সেটি ১৪ শতাংশ হয়ে গেছে। অনেকে ৫০ শতাংশ ঋণ নিয়েও ফ্ল্যাট কিনতেন। এখন তার খরচ বেড়ে গেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।